নিরক্ষর হয়েও আস্ত একটা বইয়ের লেখক, প্রান্তিক মানুষদের লড়াইয়ের আখ্যান 'নিরক্ষরের গল্পগুচ্ছ'

Nirokkhorer Golpoguccho Bangladesh : বইয়ের পাতায় টিপছাপ দিচ্ছেন তাঁরা! যিনি বই লিখেছেন, যিনি লেখক, তিনিই আবার টিপছাপ দিচ্ছেন! কেন?

ছোট বড় যে কোনও বইমেলায় যাওয়া মানে, বিভিন্ন স্টল ঘুরে বইপত্র হাতে নেওয়া। পছন্দের বই কিংবা পত্রিকা দেখলেই সেটি কিনে নেওয়া। আর যদি সেই বইয়ের লেখক আশেপাশেই থাকেন, কিংবা পরিচিত হন, তাহলে আবদার আসে – একটা সই কিন্তু চাইই চাই। সমস্ত জায়গায় ছবিটা একই। ২০২৩-এর বাংলাদেশের অমর একুশে গ্রন্থমেলায়ও ছবিটা আলাদা কিছু হয়নি। তবুও কোথাও যেন একটা অন্যরকম হাওয়া সেখানে ঘুরে গিয়েছে। এমন এক দৃশ্য, এমন উদ্যোগ, যা সচরাচর চোখে পড়ে না আমাদের।

বাংলাদেশের অন্যতম পরিচিত প্রকাশনী সংস্থা হল বিদ্যানন্দ প্রকাশনা। সেখানেই হাজির হয়েছেন দুই বৃদ্ধ। ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি, চুলে পেকে গিয়েছে অনেকটা, চামড়াতেও ভাঁজ পড়েছে। নাম আশুতোষ চক্রবর্তী ও জয়নাল উদ্দিন। তাঁদের বাড়ি ফেনিতে। তাঁরা একটি গল্প সংকলনের লেখকও বটে। মানুষজন আসছেন, সেই বই কিনছেন, সই চাইছেন। তাঁরা সই দিচ্ছেনও; কিন্তু কলম নয়, চাইছেন স্ট্যাম্প প্যাড। বুড়ো আঙুল দিয়ে বইয়ের পাতায় টিপছাপ দিচ্ছেন তাঁরা! যিনি বই লিখেছেন, যিনি লেখক, তিনিই আবার টিপছাপ দিচ্ছেন! কেন?

আরও পড়ুন : বাংলাদেশের কালীমূর্তি চুরি হয়ে রাজস্থানের দুর্গে! যেভাবে পুজো হয় যশোরেশ্বরী কালীর

এখানেই লুকিয়ে আছে সেই উদ্যোগের প্রাণভোমরা। লুকিয়ে আছে সমাজের প্রান্তিক মানুষের গল্প। আর সেখান থেকেই উঠে এসেছে এই গল্প সংকলনটি। বইয়ের নাম ‘নিরক্ষরের গল্পগুচ্ছ’। আশুতোষ, জয়নালের মতো ১২-১৩ জন প্রান্তিক মানুষের গল্প উঠে এসেছে এই বইয়ে। এবং আসল ব্যাপার হল, এঁরা প্রত্যেকেই অক্ষরজ্ঞানহীন। পরিস্থিতির চাপে, জীবনের জাঁতাকলে পড়ে এই মানুষগুলির আর পড়াশোনা হয়নি। অক্ষর পরিচয়ও হয়নি। সেই মানুষগুলিই এই বইয়ের ‘লেখক’। তবে এখানেই থেমে নেই। বইয়ের প্রচ্ছদেও রয়েছে সেই ভাবনার ছোঁয়া। প্রচ্ছদে বড় একটি আঙুলের ছাপ, সেটি করেছেন এক রিকশাচালক, নাম সেলিম ভূঁইয়া। তাঁরও অক্ষর পরিচয় নেই। ‘নিরক্ষরের গল্পগুচ্ছ’ নামাঙ্কন করেছেন এমতাজুল হোক। ঢাকায় একটি অফিসে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এমতাজুল পড়াশোনা করতে না পারলেও কষ্ট করে দেখে দেখে একটু লিখতে পারেন। তাঁর সেই লেখাতেই আরও উজ্জ্বল হয়েছে বইটি।

কিন্তু কেন এই উদ্যোগ? বিদ্যানন্দ প্রকাশনা ও বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন প্রথম থেকেই বিভিন্ন সামাজিক কাজে নিজেদের নিয়োজিত করে রেখেছে। এই প্রকাশনাই ম্রো ভাষার প্রথম বই বের করেছিল। সামাজিক কাজের জন্য বাংলাদেশের ‘একুশে পদক’ সম্মানও পেয়েছে এই ফাউন্ডেশন। তাদের ভাবনা ছিল, বাংলাদেশ তো বটেই, এই উপমহাদেশের একটি বিরাট বড় অংশের মানুষের কাছে এখনও শিক্ষার আলো পৌঁছয়নি। তাঁদের জীবনযুদ্ধ অনেকের থেকে আলাদা। কষ্ট করে বেঁচে থাকতে হয় সেই প্রান্তিক মানুষদের। কিন্তু ভাষা তো তাঁদেরও। বাংলা ভাসাত তাঁদের মুখেও শব্দ ফুটিয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা দিবস মানে তো তাঁদেরও উদযাপন। তাঁরা কেন পিছিয়ে থাকবেন?

আরও পড়ুন : স্টল নয় টেবিল, লিটল ম্যাগাজিনের স্পর্ধা আজও আকাশছোঁয়া

সেখান থেকেই এই বিশেষ বইয়ের কাজ শুরু। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের তরফ থেকে স্বেচ্ছাসেবকরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে এই মানুষগুলোর কথা শুনেছে। তাঁদের গল্প শুনেছেন। সেই সব গল্প রেকর্ড করে এনে লিখেছেন তাঁরা। অবশ্য ওই ‘নিরক্ষর’ মানুষগুলোর নামেই সেজে উঠেছে বইটি। তাঁরাই লেখক, তাঁরাই গল্পকথক। তারপর সেসবই বই আকারে সামনে এসেছে।

একুশের বইমেলায় হাজির হয়ে চোখ ধাঁধিয়ে যায় জয়নাল উদ্দিন, আশুতোষ চক্রবর্তীদের। প্রথমবার ঢাকায় আসা তাঁদের। এভাবে বই নিয়ে আস্ত মেলা হতে পারে, সেটা তাঁরা কল্পনাও করতে পারেননি। লেখক কপিও পেয়েছেন, সঙ্গে রয়্যালটির বন্দোবস্তও আছে। কিন্তু এই লেখাগুলো পড়বেন কী করে? একগাল হেসে উত্তর দেন জয়নাল, আশুতোষ। বাড়িতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। সেই নাতি-নাতনিদের মুখ থেকেই শুনবেন এই গল্প। এভাবেই জয় হয় বাংলা ভাষার। শিক্ষার আলো আর কত দেরিতে এই মানুষগুলোর কাছে পৌঁছবে? ‘নিরক্ষরের গল্পগুচ্ছ’ সেই প্রশ্নও সামনে রাখছে

More Articles