স্টল নয় টেবিল, লিটল ম্যাগাজিনের স্পর্ধা আজও আকাশছোঁয়া
Bengali Little Magazine Literature Movement : ন্যাপথালিন মুড়িয়ে, ঘর সাজানোর মাধ্যম নয় এটি। বরং লিটল ম্যাগাজিনের প্রতিটি ছত্রেই লেগে রয়েছে রক্ত, চিৎকার আর প্রতিবাদ।
সে ছোট, নামের মধ্যেই রয়েছে ‘লিটল’। লম্বা ছাউনির নিচে সার বেঁধে বসে থাকা একরাশ মানুষ। সামনে সাজিয়ে রাখা বই, ক্ষীণতনু কাগজ, পত্রিকা। কেউ আবার বসার জায়গাও পাননি, হাতে সেই ‘ছোট্ট’ পত্রিকা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাঁরা। কেউ আবার ধুলোবালির মধ্যে সামান্য একফোঁটা জায়গা পেয়ে বসে পড়েছেন। একগাল দাড়ি, শান্ত চশমার পেছনে একজোড়া চোখ। কারও আবার শরীর গিয়েছে ভেঙে, কাঁচাপাকা অবয়ব নিয়েই দাঁড়িয়ে আছেন ঠায়। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, এঁদের প্রত্যেকের চোখের ভেতর জ্বলছে একরাশ আগুন। সোজা শিরদাঁড়ায় চোখে চোখ রেখে কথা বলার স্পর্ধা এখনও রয়েছে অক্ষুণ্ণ। তাঁদের নাম আলাদা হতে পারে, পত্রিকার শিরোনামও ভিন্ন। কিন্তু প্রত্যেকের মঞ্চ একটাই। তাঁদের মাথায় প্রতিবাদের শিরস্ত্রাণও পরিয়েছে সেই মঞ্চ। লিটল ম্যাগাজিন – সাহিত্যের সেই আশ্চর্য আগুনের নাম।
সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কের বইমেলা প্রাঙ্গণের নয় নম্বর গেট দিয়ে ঢোকার পর নজর পড়বে বাঁদিকে। বড় একটি ছাউনির নিচে সার বেঁধে রাখা লিটল ম্যাগাজিনের টেবিল। এই গোটা চিত্রনাট্য জুড়ে রয়েছে এক স্পর্ধা। ‘আর কতদিন ছোট থাকবি?’ এই প্রশ্নের মুখে সজোরে থাপ্পড় মারতে পারে লিটল ম্যাগাজিন। তারা ক্ষমতাকে প্রশ্ন করে, প্রতিষ্ঠান ও তার রাজনীতিকে বিদ্ধ করে। সেই সমস্ত কাজে তাদের ‘অস্ত্র’ হল এই ছোট্ট, পাতলা কিছু পত্রিকা; এবং তার ভেতরে থাকা লেখা। শব্দ দিয়ে, কবিতা-গদ্য দিয়ে, তার প্রকাশ দিয়েই নিজের লড়াই চালিয়ে যেতে চায় লিটল ম্যাগাজিন। “ছোট ছোট পায়ে স্বপ্ন দেখায়” ঠিকই; কিন্তু সেই স্বপ্নের সঙ্গে মিশে আছে একটা দম্ভ, স্পর্ধা। মাথা না ঝোঁকানোর দম্ভ। চোখে চোখ রেখে কথা বলার স্পর্ধা।
লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাসের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে সেই বারুদ। সাহিত্যের এই ধারা বরাবরের আন্তর্জাতিক। পৃথিবী জুড়ে ঘটে চলা নানা ঘটনা এসে জুড়ে গিয়েছে এই বিশেষ রাস্তায়। ন্যাপথালিন মুড়িয়ে, ঘর সাজানোর মাধ্যম নয় এটি। বরং লিটল ম্যাগাজিনের প্রতিটি ছত্রেই লেগে রয়েছে রক্ত, চিৎকার আর প্রতিবাদ। বাংলারই এক কবি ফাল্গুনী রায় একসময় বলেছিলেন, “ম্যাগাজিন শব্দটি আমি লক্ষ্য করেছি রাইফেল ও কবিতার সঙ্গে যুক্ত।” তিনিই ‘মানুষের সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই’ কবিতায় লিখেছিলেন,
“আমি দেখেছি আমার ভিতর এক কুকুর কেঁদে চলে অবিরাম
তার কুকুরীর জন্যে এক সন্ন্যাসী তার সন্ন্যাসিনীর স্বেচ্ছাকৌমার্য
নষ্ট করতে হয়ে ওঠে তৎপর লম্পট আর সেই লাম্পট্যের কাছে
গুঁড়ো হয়ে যায় এমনকী স্বর্গীয় প্রেম – শেষ পর্যন্ত আমি
কবিতার ভেতর ছন্দের বদলে জীবনের আনন্দ খোঁজার পক্ষপাতী
তাই জীবনের সঙ্গে আমার কোন বিরোধ নেই– মানুষের সঙ্গে
আমার কোনো বিরোধ নেই”
লিটল ম্যাগাজিন কি কেবল ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানায়? তা নয়; সে প্রতিবাদ ছুঁড়ে দেয় ভাষার প্রতি। গড়পড়তা সাহিত্যের আবহাওয়া, পিঠ চাপড়ানো, ‘দাদা-দিদি’দের দিকেও। তার সমস্ত রূপ নিয়ে, সমস্ত আয়োজন নিয়ে, যাবতীয় ভাষা-শব্দ-ছন্দ-বড় দাদা-ছোট দাদা-প্রতিষ্ঠান সবার দিকেই আঙুল তোলে। সবসময় যে ম্যাগাজিন হতে হবে তাও নয়, একটা লিফলেটও নিজের চরিত্রগুণে লিটল ম্যাগাজিনে জায়গা করে নেয়। অন্তত তার ইতিহাস সেই দিকেই নিয়ে যায়।
আরও পড়ুন : সংরক্ষণ মানে অমরত্ব, কবে বুঝবে লিটল ম্যাগাজিন?
যেমন ধরুন আমেরিকার বিপ্লব। ১৮৪০ সাল। ক্ষমতাকে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্ত। মাত্র দুই দশক পরেই সেখানে শুরু হবে ভয়ংকর যুদ্ধ, ‘American Civil War’। সেই সময় বস্টনে প্রকাশিত হয় একটি ম্যাগাজিন। প্যামফ্লেট বললেও খুব একটা ভুল হয় না। র্যালফ এমারসন এবং মার্গারেট ফুলার ছিলেন সেই পত্রিকার সম্পাদক। পত্রিকার নাম ‘দ্য ডায়াল’। সরাসরি প্রতিবাদের রাস্তায় হাঁটে এই পত্রিকা। ইতিহাস বলে, ছোট্ট এই পত্রিকার হাত ধরে লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রা শুরু হয়। তারও কয়েক বছর পর ১৮৯৬ সালে লন্ডনে প্রকাশিত হয় ‘দ্য স্যাভয়’। আর্থার সাইমনসের সম্পাদনায় এই পত্রিকা সেই সময়ের ভিক্টোরিয়ান রাজনীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিল। একের পর এক লেখায় ক্ষমতার ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন এখানকার লেখকরা।
আমাদের বাংলার বুকেও হাংরি আন্দোলনের অন্যতম ভিত্তিভূমি ছিল লিটল ম্যাগাজিন। প্রচলিত সমস্ত ধারণা, সমস্ত লেখা, সাহিত্য, ভাষাকে নস্যাৎ করেন হাংরিরা। মলয় রায়চৌধুরী, সুবিমল বসাক, ফাল্গুনী রায়, দেবী রায়, বাসুদেব দাশগুপ্তেরা একজোট হয়ে শুরু করেন আন্দোলন। মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ, জ্যাক কেরুয়াকের প্রভাবও পড়েছিল এখানে। ভাষার আগল ভেঙে তাকে সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ছায়া থেকে মুক্ত করা – লিটল ম্যাগাজিনেরই তো বৈশিষ্ট্য এটা। এই আন্দোলনর পথ ও পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি থাকতেই পারে। কিন্তু অস্বীকার করা যাবে কি?
বাংলায় লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রা শুরুর কথা বলার আগে আরেকবার নজর দেওয়া যাক বিদেশি একটি পত্রিকায়। এজরা পাউন্ড ও হেরিয়েট মনরোর পত্রিকা ‘পোয়েট্রি’। ১৯১২ সালে শুরু হয় এর পথচলা। ‘পোয়েট্রি’-কে বলা হতো ‘দ্য ম্যাগাজিন অফ ভার্স’। বিখ্যাত এই পত্রিকার জয়যাত্রা শুরুর দুই বছর পরই খোদ বাংলায় একটি পত্রিকা বেরোয়। নাম ‘সবুজপত্র’, প্রকাশসাল ১৯১৪। প্রমথ চৌধুরীর এই পত্রিকার হাত ধরেই বাংলায় শুরু হয় লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রা। এখনও কেউ কেউ লিটল ম্যাগকে ‘সবুজপত্র’ বলে ডাকে। বাজারের প্রথাগত সাহিত্যের বাইরে গিয়ে অন্যরকম লেখা, গবেষণাধর্মী কাজ – বঙ্গ সাহিত্যের এই ধারার চরিত্রটা তখনই তৈরি হয়ে যায়।
‘সবুজপত্র’-এর পরই এক এক করে আসে ‘কল্লোল’, ‘শিখা’, ‘কালি ও কলম’, ‘শনিবারের চিঠি’, ‘পূর্বাশা’… সেইসঙ্গেই আসে ‘প্রগতি’ ও ‘কবিতা’। তিরিশের দশকে প্রকাশিত দু'টি পত্রিকারই সম্পাদক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। ‘কবিতা’ পত্রিকাটিকে কি কয়েক বছর আগে ইংরেজির ‘পোয়েট্রি’ লিটল ম্যাগের বাংলা সংস্করণ বলা যায়? কারণ এই একটি পত্রিকার হাত ধরে এক এক করে সামনে আসতে থাকেন সেই সময়ের বাংলার উল্লেখযোগ্য কবিরা। জীবনানন্দ থেকে সুনীল-শক্তি – অন্য ধারায় বেড়ে ওঠা কবিতার দর্শন, ভাষার সম্মুখীন হয় বাংলা কাব্য জগত। সেখানে রাবীন্দ্রিক ভাবধারা নেই; রয়েছে ‘ঝরা পালক’-এর পৃথিবী…
আরও পড়ুন : কেমন ছিল, কেমন হল বইমেলার লিটল ম্যাগাজিন প্যাভেলিয়ন
এরপর কেটে গিয়েছে বেশকিছু বছর। বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘটে গিয়েছে বিভিন্ন বিপ্লব। ঘটে গিয়েছে প্রযুক্তির বিস্ফোরণ। রাজনৈতিক অবক্ষয়, যুদ্ধ, রক্ত, ধর্ষণ – একের পর এক ঘটনা পেরিয়ে গিয়েছে। বদলেছে লিটল ম্যাগাজিনও। এখন বাংলার লিটল ম্যাগাজিন কেমন আছে? কীরকম তার চরিত্র? সেই প্রতিবাদ, স্পর্ধা কি এখনও অটুট, নাকি পরিস্থিতির চাপে শিরদাঁড়ায় তফাৎ এসেছে? এই প্রসঙ্গে আসার আগে আরও একটি প্রসঙ্গে আসা যাক। ১৯৫৩ সালে ‘দেশ’ পত্রিকার একটি প্রবন্ধে বুদ্ধদেব বসু লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্র নিয়ে কয়েকটি কথা বলেছেন। সেখানে তিনি লিখেছিলেন,
“এক রকমের পত্রিকা আছে যা আমরা রেলগাড়িতে সময় কাটাবার জন্য কিনি, আর গন্তব্য স্টেশনে নামার সময় ইচ্ছে করে গাড়িতে ফেলে যাই- যদি না কোনো সতর্ক সহযাত্রী সেটি আবার আমাদের হাতে তুলে দিয়ে বাধিত এবং বিব্রত করেন। আর এক রকমের পত্রিকা আছে যা স্টেশনে পাওয়া যায় না, ফুটপাতে কিনতে হলেও বিস্তর ঘুরতে হয়, কিন্তু যা একবার হাতে এলে আমরা চোখ বুলিয়ে সরিয়ে রাখি না, চেয়ে চেয়ে আস্তে আস্তে পড়ি, আর পড়া হয়ে গেলে গরম কাপড়ের ভাঁজের মধ্যে ন্যাপথলিন-গন্ধী তোরঙ্গে তুলে রাখি- জল, পোকা, আর অপহারকের আক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য। যেসব পত্রিকা এই দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্গত হতে চায়- কৃতিত্ব যেটুকুই হোক, অন্ততপক্ষে নজরটা যাদের উঁচুর দিকে, তাদের জন্য নতুন একটা নাম বেরিয়েছে মার্কিন দেশে; চলতি কালের ইংরেজি বুলিতে এদের বলা হয়ে থাকে লিটল ম্যাগাজিন।”
লিটল ম্যাগাজিন আদতে ক্ষণস্থায়ী। প্রতিষ্ঠানের ভিড়, তাদের আলোর রোশনাইয়ের বাইরে গিয়ে এক স্বতন্ত্র চলন। এমনটাই বক্তব্য রেখেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। আমেরিকার লিটল ম্যাগাজিন ‘দ্য ডায়াল’-এরও আয়ু ছিল মাত্র চার বছর। বাংলার অনেক লিটল ম্যাগাজিনেরই চরিত্র এমন। ‘এক্ষণ’-এর মতো পত্রিকা আজ আর্কাইভাল হয়ে গিয়েছে, প্রকাশিত হয় না। এরকমই কোনও লিটল ম্যাগের নাম আমরা জানি, অনেকের নাম জানিও না। কলকাতা কেন্দ্রিকতার বাইরে জেলার নানা প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে এমনই বহু অজানা, অচেনা লিটল ম্যাগাজিন। ‘এক দশকে সঙ্ঘ ভেঙে যায়’ ঠিকই, কিন্তু স্পর্ধা মরে না। সত্যিই কি তাই?
সাম্প্রতিক সময় কিংবা অতীতেও ভারত ও বাংলার বিভিন্ন ঘটনার কথা এসেছে লিটল ম্যাগাজিনের পাতায়। কবিতা হোক বা গদ্য, গল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, সেখানে সবেরই সমাহার। কাশ্মীর ইস্যু হোক বা বাবরি ধ্বংস, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি হোক বা এনআরসি-সিএএ, বগটুই গণহত্যা, জরুরি অবস্থা, নকশাল আন্দোলন, তেভাগা-খাদ্য আন্দোলন – লিটল ম্যাগাজিন সোচ্চার হয়েছে বারবার। আর এখন?
হুগলির উত্তরপাড়া থেকে প্রকাশিত হয় লিটল ম্যাগাজিন ‘মাস্তুল’। তারই সম্পাদক আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায় উঠে আসে সেই রাজনীতির প্রসঙ্গ। “বগটুই ইস্যুর সময় আমরা ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ নামে একটা ছোট্ট পুস্তিকা বের করি। একেবারেই ছোট, পাতলা একটি পত্রিকার মতো। কিন্তু সেই ছোট্ট পুস্তিকার পাতাতেই ধরতে চেয়েছিলাম সেই সময়ের অস্থির চিত্রটাকে। কেবল বগটুই নয়, সেই সময়ের অন্যান্য হিংসার পরিপ্রেক্ষিতও উঠে আসে লেখকদের লেখায়। অনেক লিটল ম্যাগাজিন কাশ্মীর নিয়ে কাজ করেছে। লিঙ্গ বৈষম্য নিয়েও কাজ হচ্ছে। রাজনীতির প্রসঙ্গ যে একেবারে আসছে না তা নয়। সেটা লিটল ম্যাগাজিনের স্পর্ধা, প্রতিবাদের ঐতিহ্য, দৃঢ়তা আর সাহস। তবে কে করবে আর কে করবে না, সেটা একান্তই তাদের চিন্তাভাবনা।”
আর সামগ্রিক পরিস্থিতি? লিটল ম্যাগাজিনে কি এখনও সেই প্রতিবাদের স্পর্ধা, প্রতিষ্ঠানের সামনে মাথা না ঝোঁকানোর দম্ভ দেখা যায়? পুরস্কার আর হাততালির ভিড় এড়িয়ে চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস দেখান লেখকরা? ‘মাস্তুল’-এর সম্পাদক আকাশ গঙ্গোপাধ্যায় এই প্রতিষ্ঠানের ব্যাখ্যা আর লিটল ম্যাগের সামগ্রিক পরিস্থিতিকেই নিজের মতো করে ধরলেন। তাঁর বক্তব্য, “প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার জায়গাটা একটু অন্যরকম। এখন তো আমরা নিজেরা বেছে নিই কে প্রতিষ্ঠান। একেকজনের কাছে তার চরিত্র, মুখ একেকরকম। তারপর তার বিরোধিতা করি, বাকিদের করি না। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে লিটল ম্যাগাজিন নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান। কৃত্তিবাস যখন এল, তখনও লিটল ম্যাগাজিন আর ক্লাসিকাল পত্রিকাগুলির মধ্যে একটা স্পষ্ট তফাৎ ছিল। কৃত্তিবাস কিন্তু এদের মাঝামাঝি একটা ধারাকে প্রতিষ্ঠা করল, সেটাকে কমার্শিয়ালও করল। সেই সময়টা হয়তো ফিরছে… মানে লিটল ম্যাগাজিনের লেখক কেবল সেখানেই লিখবেন, সেটা এখন নেই। তাঁরাও পুরস্কার নেন, চুপিচুপি হলেও নেন।”
বুদ্ধদেব বসু তো বটেই, আরও অনেক কবি-লেখকদের বক্তব্য হল, লিটল ম্যাগাজিন মানেই ক্ষণস্থায়ী। লম্বা, আলো ঝলমলে পরিবেশের জন্য তার জন্ম হয়নি। সেই জায়গাটা কি এখন একটু হলেও টাল খেয়েছে? আকাশের মতে, “হ্যাঁ হয়েছে। লিটল ম্যাগাজিনের একটা অস্বাভাবিক ভালো, ঝকঝকে বইয়ের দামও এখন বেশ বেশিই। যারা লিটল ম্যাগাজিন করতে চায়, তারাও ব্যবসার কথাটা ভেবেই করতে চায়। সেটা হলেই হয়তো ভালো। একটা বই বা পত্রিকা মানে কেবল কয়েকটা পাতা আর মলাট নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে লেখক, ডিটিপি, ছাপাখানা। যিনি বইগুলি ভ্যানে করে নিয়ে যাচ্ছেন, যিনি পুস্তানি, আঠা তৈরি করছেন, বাঁধাইয়ের কাজ করছেন… এতগুলো লোকের পরিবার বইয়ের সঙ্গে জড়িত। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। বইয়ের দাম বাড়লে এই পরিবারগুলোরও লাভ। কাজেই ব্যবসার জায়গাটা বাড়াতে চাওয়ায় কোনও অন্যায় নেই।”
আর পরীক্ষা নিরীক্ষা? লিটল ম্যাগাজিনের লেখালেখির মধ্যে একটা ঝকঝকে চিন্তা থাকে, গতানুগতিক চিন্তার বাইরে গিয়ে ভাবার স্পর্ধা থাকে। সেই ভাষা, শব্দ, ভাবনাও স্পর্ধা আর প্রতিবাদেরই একটা অঙ্গ। সেখানে রাজনৈতিক ভাবনাও থাকে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সেটা কি দেখা যায় বাংলার লিটল ম্যাগাজিনগুলোয়? ‘বোধশব্দ’ পত্রিকার সম্পাদক সুস্নাত চৌধুরীর বক্তব্য, “যে কোনও বিষয়ই লিটল ম্যাগাজিনের একটা প্রতিবাদ থাকে। অন্য বড় প্রতিষ্ঠান যেখানে একটু বুঝে পা ফেলে, সেখানে লিটল ম্যাগ অনেক নির্ভয়ে, স্পষ্ট করে কথা বলে। কেবল লিটল ম্যাগাজিনই যে প্রতিবাদ করে, সেটাও উচিত কথা নয়… তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জায়গাটা এখন নেই বললেই চলে। আমার অন্তত মনে হয়, লিটল ম্যাগাজিনের মধ্যে যে তুখোড় বুদ্ধিমত্তার জায়গা ছিল, তুমুল পরীক্ষা-নিরীক্ষার জায়গা ছিল, সেটি বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এখন পুরোপুরি মধ্যমেধার চাষ হয়… ভালো কাজ হয় না সেটা কিন্তু একবারও বলছি না। সেটা এখনও হয়। কিন্তু সেই কাজগুলো অসাধারণ হয় না। আজ থেকে ৩০ বছর আগেও কিন্তু এই এক্সপেরিমেন্টের জায়গাটা ছিল। ভাষা, ফর্ম, ডিজাইনিং – সবরকমভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। সেটা আজকের লিটল ম্যাগাজিনে প্রায় নেইই।”
কিন্তু এই ‘মধ্যমেধার চাষ’ তো সমাজের সর্বত্র! যে কোনও সংস্কৃতির আঙিনায়, সমাজে, রাজনীতিতে, খেলায় সর্বত্র এই মধ্যমেধার হুল্লোড়। আর লাইমলাইটের নিচে মঞ্চ খাটিয়ে তাদের আপ্যায়ন করছি আমরাই। সুস্নাত চৌধুরীর বক্তব্য, “সামগ্রিকভাবে এটা সময়েরই চরিত্র। এই অধঃপতন তো আমাদের সর্বত্রই হয়েছে। লিটল ম্যাগাজিনও সমাজের বাইরে নয়। তাই তার মধ্যেও এই ব্যাপারটা ঘটেছে। এক্সপেরিমেন্টেশনের জায়গা এখনও আছে, কিন্তু সেখানে হাতে গোনা কয়েকজনই নজর দিচ্ছে। সবথেকে বড় কথা, আমাদের একটা আন্তর্জাতিক মন ছিল। এই মনটা আজ বাঙালি জাতিই হারিয়েছে। আমি যা খুশি তাই করব, এটা কিন্তু খুব ভালো কাজেরও লক্ষণ নয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য কিছু পদ্ধতি, কিছু থিয়োরি জানতে হবে। সেটার চর্চা করতে হবে; তারপর তাকে ভাঙতে হবে। কিন্তু সেই ব্যাপারটা খুবই কম।”
সেইসঙ্গে রয়েছে ডিজিটাল প্রভাব। এখন কেবল ছাপা পত্রিকা নয়, অনলাইন ম্যাগাজিনেরও ভিড়। সেটা কি কোনওভাবে লিটল ম্যাগাজিনের জগতে প্রভাব ফেলছে? সেই ব্যাপারটিও তুলে আনলেন সুস্নাত। তাঁর বক্তব্য, “লিটল ম্যাগাজিন আর ডিজিটাল পত্রিকা – এটা আলাদা দুটি মাধ্যম। ডিজিটাল পত্রিকার প্র্যাকটিস, তার চিন্তা-ভাবনা, সেটাও তো লিটল ম্যাগের প্রতিফলন হতে পারে। প্রযুক্তির বাঁকবদল তো ঘটবেই। তবে আমি ছাপা পত্রিকায় যা করি, ডিজিটালেও সেটা করলে খুব সমস্যা। আমাকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মতো করে ভাবতে হবে, সেখানকার পাঠকদের কথা ভাবতে হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জায়গা এখানেও আছে। সেই চিন্তাভাবনা করে বাংলা ভাষায় ক’টা পত্রিকা হয়, সেটা আমি জানি না। করলে সেটা ভেবেই করা উচিত।”
এর বাইরে পশ্চিমবঙ্গের জেলার লিটল ম্যাগাজিনগুলির লড়াই হয়তো আরও কঠিন। কারণ, সমস্ত কিছুর পাশাপাশি তাদের উল্টোদিকে রয়েছে আরও একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান – যার নাম ‘কলকাতা’। বাংলা সাহিত্য ও বাঙালির এই কলকাতা কেন্দ্রিকতার ব্যামো আজকের নয়। জেলার লিটল ম্যাগাজিনগুলি ভালো কাজ করলেও লড়াই করতে হয় সেই কলকাতার সঙ্গে। আসানসোলের লিটল ম্যাগাজিন ‘উড়ান’-এর মধুরিমা দত্ত সেই জায়গাটিকেই তুলে ধরলেন। “কলকাতা একদিকে, বাকি সমস্ত জেলা আরেকদিকে। এটা চরম অসম একটা লড়াই। বাকি জেলাগুলি সৎ সন্তানের মতো হয়ে গিয়েছে। সবারই নিজের সন্তান হয়ে গিয়েছে কলকাতা। এখানে যেটা হচ্ছে, সেটাই যেন সর্বশ্রেষ্ঠ। লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রেও সেটা একই। আমরা আসানসোলে দাঁড়িয়ে যে কাজটা করছি, সেটা যতক্ষণ না নিজের থেকে প্রচার করছি, ততক্ষণ কিছু হচ্ছে না। অন্যদিকে, কলকাতায় অনেক সুযোগ। চারটে আড্ডায় গেলেই ভাবনাগুলো আদানপ্রদান হয়। প্রচার হয়। আমরাই এটা তৈরি করেছি। নন্দনে কোনও সিনেমা হল না পেলে উত্তর দিনাজপুরের মানুষও চিৎকার করেন। নিজের জায়গাটার দিকে তাকান না।”
মধুরিমার বক্তব্য, “এছাড়াও জেলার প্রচুর লিটল ম্যাগাজিন রয়েছে, যেগুলি অনেকদিন ধরেই বিষয়ভিত্তিক, গবেষণাধর্মী কাজ করে যাচ্ছে। আমার মনে হয়, চর্চার দিক থেকে জেলা অনেক এগিয়ে। চারজন হলেও লিটল ম্যাগাজিনের একটা গোষ্ঠী থাকে। তাঁরা আঞ্চলিকতাকেও বজায় রেখেছেন। ‘উড়ান’ যেমন লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে, তার বিরুদ্ধে কাজ করে। আমরা রাধাকে নিয়ে কাজ করেছিলাম, যিনি একজন গোয়ালিনী। যার একটা সংগঠন বা দল ছিল, খেটে খাওয়া শ্রমজীবী চরিত্র রাধা। অথচ তাঁকে সবসময় কৃষ্ণের দিক থেকে দেখা হয়েছে। পুরোটাই তো কাম দিয়ে দেখানো হল। বাকিরাই তো এটা তৈরি করলেন। এভাবেই নিজেদের কথাগুলো আমরা বলি। কিন্তু মফঃস্বল, জেলার কাজ তো কলকাতায় পৌঁছচ্ছেই না। এছাড়াও লিটল ম্যাগাজিন তো একসময় অনেক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে। সাহিত্যের জগতে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। সেই আন্দোলন, গোষ্ঠীভিত্তিক কাজ খুবই কম হচ্ছে। সবাই এখন কবিতা লিখছে, সবাই… এত এত বই বেরোচ্ছে। কিন্তু আলাদা কোথায় হচ্ছে?”
এই শেষ প্রশ্নের আড়ালে এসে জমাট বাঁধে অজস্র মেঘ। সত্যিই কি সেই স্পর্ধা আছে? নাকি ঝোলা ব্যাগ আর পাঞ্জাবির বাহারি ভিড়ে, ঝকঝকে আলো আর অনুপ্রেরণার ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে লিটল ম্যাগাজিনের সেই স্পর্ধা? যে প্রতিবাদকে ভয় পায় ক্ষমতা, যে মুষ্টিবদ্ধ হাত চোখে চোখ রেখে কথা বলে, তাদের ভাষা কি একটু হলেও দুর্বল হয়েছে? ‘লিটল ম্যাগাজিন’ নামের ব্র্যান্ডের লৌহবাসরে ঢুকে পড়ছে কালনাগিনী? অনেক প্রশ্ন, অনেক শব্দ – তবুও দিনের শেষে স্বপ্ন দেখায় লিটল ম্যাগাজিন। বইমেলার শেষদিন শেষ ঘণ্টা বাজার পর চোখ যায় ছাউনিটার দিকে। চারিদিকে শূন্য টেবিল, ইতিউতি ছড়িয়ে রয়েছে কাগজ, প্লাস্টিক, সিগারেটের ধোঁয়া, বাতিল চায়ের কাপ। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরছে সহযোদ্ধারা, কমরেডদের চোখের জল ভিজিয়ে দিচ্ছে জামা। গা-ঝাড়া দিয়ে উঠতে হবে আবার; শব্দই হোক আসল রাইফেল। লিটল ম্যাগাজিন হোক ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বলা সেই আওয়াজ। যে আওয়াজকে ভয় করেছে শাসকের ইতিহাস।