অশরীরীর মুখোমুখি বঙ্কিমচন্দ্র, না লেখা সেই গল্পটা...

'অলিগলি চলি রাম, ফুটপথে ধুমধাম, কালি দিয়ে চুনকাম', থ্রি মাস্কেটিয়ার্স চলেছে বারাণসীর নির্জন গলিপথ দিয়ে। ফেলুদার মুখে কবিতা, সুকুমার রায়। এভাবেই তো কাশীর স্তব্ধ রাত্রিচিত্রকে দেখাতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ। ওপাশ থেকে ভেসে এসেছিল লালমোহনবাবুর গলা, 'একটু ধুমধাম হলে ভালোই লাগত মশাই, এ একেবারে বেজায় থমথমে'। জনমানবহীন রাত, ভয় ভয় পরিস্থিতি। যে কোনও মুহূর্তে বেরিয়ে পড়তে পারে একটা ভ্যাম্পায়ার। বা নিদেনপক্ষে, মাথার পিছনে এসে দাঁড়াতে পারে 'স্ত্রী' সিনেমার, বিবাহসাজে সুসজ্জিত সেই 'চুরেইল'। 'ও স্ত্রী কাল আন', অমঙ্গলকে প্রতিহত করার এ যেন এক অব্যর্থ বাণী। মানুষের জীবনে যেমন অমঙ্গলের অন্ধকার থাকে, তেমনই থাকে মঙ্গলের বরাভয়। আর, এই মঙ্গল-অমঙ্গলের দোলাচল তো যুগের পর যুগ ধরে হয়ে আসছে তার যাপন সঙ্গী। এক কথায়, মানুষ ভয় করতে ভালোবাসে। অন্ধকার যেমন তার আজন্ম শত্রু, তেমনই সে এক নিষিদ্ধ বন্ধুও। রাত নেমে এলেই অবাঞ্ছিত সব শব্দ। পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দেয় বেওয়ারিশ ছায়ামূর্তি। এমন গল্পই তো কতকাল ধরে পালন করে এসেছে বাঙালি। আর, বাংলা সাহিত্যে তার সম্ভারও নেহাত কম নয়। অল্প কথায় তার লিস্ট দিয়ে শেষ করা যাবে না। কিন্তু প্রশ্ন হল, বাংলা ভাষায় এ যাবতীয় ভৌতিক কাহিনির প্রথম  নির্মাতা কে? বঙ্গের ভাণ্ডারে বিবিধ রতনের ঐশ্বর্য বৃদ্ধি করে, কোথা হতে আসিয়াছে  অশরীরীদের গল্প? একদল বলেন, রবীন্দ্রনাথ। বটেই তো। 'নিশীথে', 'ক্ষুধিত পাষাণ'-এর মতো গল্পরা অপ্রকাশিত থাকলে তো বাঙালির কল্প-ভূত কোনোদিনই গল্প-ভূত হয়ে ছাপার অক্ষরে জায়গা পেত না। কিন্তু, একা রবি ঠাকুরকে বোধহয় বাংলা ভূতের গল্পের জনকের ভূষণে পুরোপুরি ভূষিত করা চলে না। তাঁরও পূর্বসূরি ছিল, তিনি আর কেউ নন, গদ্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

ফাল্গুন, ১৩২০ বঙ্গাব্দে, 'ভারতী' পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে বঙ্কিম এবং শরচ্চন্দ্র ঘোষালের  প্রথম এবং শেষ ভূতের গল্প, 'নিশীথ রাক্ষুসীর কাহিনী'। এক গল্পের দু'জন লেখক, কী করে সম্ভব? সম্ভব হতে হয়েছিল, কারণ, বঙ্কিমের হাতে গা ছমছমে সেই গল্পের শুরুওয়াত ঘটলেও তার উপসংহার তিনি লিখে যেতে পারেননি। অবশেষে শরচ্চন্দ্র ঘোষাল দায়িত্ব নিয়ে শেষ করেন সে গল্প এবং তাকে পাঠকের দৃষ্টিগোচর করে তোলেন। শোনা যায়, প্রেতচর্চায় রীতিমতো আগ্রহ ছিল  প্যারীচাঁদ মিত্রের। বঙ্কিম নিজেও যে সে রসে সম্পূর্ণ বঞ্চিত ছিলেন না, তার প্রমাণ তো পাওয়াই যাচ্ছে। নইলে আর তিনি ভূতের গল্প লিখতে শুরু করলেন কেন? কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, তাঁর পরলোকচর্চা সংক্রান্ত বিস্তারিত  কোনও তথ্য আজ আমাদের হাতে নেই। সে সকল রহস্য সঙ্গে নিয়েই দেহত্যাগ করেছেন তিনি। তবে, ভৌতিক অভিজ্ঞতা তাঁর ঘটেছিল, এমনটাই জানা যায়। দাদামশায়ের জীবনের হাড় হিম করা সেই গল্পকেই আমাদের সামনে উপস্থিত করেছেন বঙ্কিমের দৌহিত্র, দিব্যেন্দুসুন্দর বন্দোপাধ্যায়। 

তখন কাঁথির হাকিম বঙ্কিমচন্দ্র। কর্মসূত্রে মাঝে মধ্যেই যেতে হয় মফস্সলের দিকে। রোদের তেজ একেবারেই সহ্য হয়না তাঁর, ফলত, দূরে কোথাও যেতে হলে পালকি ছাড়তেন হয় ভোরের দিকে, নইলে সূর্যাস্তের পরে। একবার কাঁথি থেকে প্রায় সাত আট ক্রোশ দূরে কাজ। ইচ্ছে ছিল, রাতের মধ্যেই কাজ সেরে বাড়ি ফিরে আসার, কিন্তু নানা কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠল না। থাকা খাওয়ার কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা অবশ্য ছিল না, কারণ তখনকার নিয়ম অনুযায়ী  গ্রামে হাকিম এলে জমিদারের বাগানবাড়িতেই তাঁকে তোলা হত। সঙ্গে তাঁর পাইক, বরকন্দাজ, পাচক, সকলেই উপস্থিত ছিল। অনেক দূরের রাস্তা, আর তাছাড়া পথে ডাকাতের ভয় প্রবল। গ্রামের গাঁয়ের মুরুব্বিরা তাদের হাকিমসাহেবকে পরামর্শ দিল রাত্রিটুকু জমিদার বাড়িতেই কাটিয়ে দেওয়ার। রাজকীয় সব বন্দোবস্ত হল। খাওয়া দাওয়া সেরে, ঠাকুর চাকুরকে বিদায় করে বঙ্কিম ঘরে দোর দিলেন। 

রাত তখন অনেক। চারিদিক নিঃঝুম। এমন সময়, দরজায় প্রবল করাঘাতের শব্দ। খানিক বিরক্তই হলেন বঙ্কিম। মনে ভাবলেন বুঝি তাঁর খাস ভৃত্য মুরুলী এসেছে মাঝরাতে বিরক্ত করতে। কিন্তু দরজা খুলে কোথায় কী, সব ভোঁ ভাঁ। আশ্চর্য, এত রাতে মস্করা করে কে? যাই হোক। কী আর করার, বিছানায় শুয়ে তিনি  নিদ্রাদেবীকে তুষ্ট করার চেষ্টা করতে লাগলেন। সময় বেশি পেরোয়নি, ঘড়ির কাঁটা এগোচ্ছে মাঝরাত থেকে গভীর রাতের দিকে। ফের সেই শব্দ। বাইরে থেকে সজোরে দরজা ধাক্কাচ্ছে কেউ। এবার কিছুটা সতর্ক হলেন বঙ্কিম। দূরে কোথাও গেলে তিনি সাথে একটা ছোরা রাখতেন। লণ্ঠনের আলোয় সেটা হাতে নিয়ে তিনি দরজা খুললেন, কিন্তু না, এবারেও শূন্য অলিন্দে যক্ষপুরীর অন্ধকার। কিছুক্ষণ পরে আবারও করাঘাত। তবে এবার তার ধরণ পেলব, অত্যন্ত ধীর স্থির। আগের দু'বার ছিল শূন্য রাত্রির জনমানবহীন অন্ধকার, কিন্তু এবার বিফল মনোরথ হতে হলনা বঙ্কিমকে। দরজায় বাইরে একজন অত্যন্ত সুন্দরী মহিলা, তাঁকে দেখেই তিনমহলা বাড়ির তৃতীয় মহলের দিকে দৌড় দিল। রোহিনী, কুন্দনন্দিনীর মতো চরিত্রদের স্রষ্টার বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হল না, যে এ নারী 'ব্যাভিচারিণী', দিব্যেন্দুবাবুর ভাষায় 'কুলকলঙ্কিনী'। কিন্তু সে গেল কোথায়?

বঙ্কিম তখন বিশেষ ক্ষমতাবান। সরকারি পদমর্যাদাতেও তিনি অনেকটা উঁচুতে। ফলত, এমন একজন 'পুঁচকে ছুঁড়ি'কে গ্রেফতার করতে একবারের জন্যও তাঁর হাত কাঁপবে না। সে এক্তিয়ারও তাঁর আছে। শেষে সেই পলাতক স্ত্রীলোককে উদ্ধার করা গেল, জমিদারবাড়ির তিন নম্বর মহলের বারান্দা থেকে। বঙ্কিমের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে ছিল সে। এমনকী, তার সঙ্গে কিছু কথাবার্তাও হল তাঁর, এবং সেখান থেকেই তিনি জানতে পারলেন যে এ মেয়ে জমিদারের পুত্রবধূ। রাতের আগমনের কারণ আর কিছুই নয়, যে ঘরে বঙ্কিম শুয়েছিলেন সেটা আসলে তার শয়নকক্ষ, অতএব রাতদুপুরে অধিকার বুঝে নেওয়া প্রখর দাবি নিয়েই সে হাজির হয়েছিল তাঁর দরজায়। বঙ্কিম হতবাক। এত রাতে কী করেন কিছুই ভেবে পাচ্ছেন না। একবার ভাবলেন এ ষোড়শীকে তাঁর স্বামীর হাতে তুলে দেওয়াই উচিত কাজ হবে, কিন্তু ব্যর্থ হলেন তিনি। হাওয়ার মতোই মেয়েটা পালাল সেখান থেকে। বাগান পেরিয়ে, পুকুর ছাড়িয়ে, ঘোর অন্ধকারের দিকে। দুলে উঠল বাগিচার গাছপালা। এবার ভয় পেলেন বঙ্কিম। এক বিন্দু হাওয়া নেই কোথাও, অথচ গাছ দোলে কী করে? হাঁক ডাক করে সকলকে জাগালেন তিনি।

আরও পড়ুন-সেলাম ডাক্তারবাবু! অ্যাম্বুলেন্স চালক, স্বাস্থ্যকর্মী আপনারা না থাকলে…

কোনও রকমে পালকি প্রস্তুত করে রওনা হলেন বাড়ির দিকে। আর এক মুহূর্ত এখানে নয়। এ ঘটনার কিছুদিন পর জমিদারবাড়ির গোমস্তার সাথে দেখা হল তাঁর। অনুসন্ধান চালিয়ে তিনি জানলেন, সেদিন রাতে যার সঙ্গে মোলাকাত হয়েছিল সে ঠিক মানুষ নয়। বছর তিনেক আগে স্নান করতে গিয়ে পুকুরে ডুবে তার মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু ইহলোকের মায়া তারপরেও ত্যাগ করতে পারেনি সে। কেই বা পারে? 'যে জীবন ফড়িংয়ের, দোয়েলের, মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা' তার প্রতিই তো সন্নাটার বুক ফেঁড়ে একক কোলাহলে বলে বৃদ্ধ মেহের আলী বলে, 'তফাৎ যাও, সব ঝুট হ্যায়'।  বঙ্কিমের এই বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়ত অজানাই থাকত, যদি  সুকুমার সেন এবং শুভদ্রকুমার সেন 'উপছায়া' গ্রন্থে তাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত না নিতেন।

১৮১২ সালে প্রকাশ পাচ্ছে উইলিয়াম কেরীর 'ইতিহাসমালা'। ওই একই বছর জার্মানিতে প্রকাশিত হচ্ছে গ্রিমভাইদের উপকথা সংকলন। সুকুমার সেন তাঁর সাহিত্যের ইতিহাসে দেখাচ্ছেন, কী ভাবে কেরীর বইখানা ঐতিহাসিক ভাবে গ্রিম ভাইদের থেকে হয়ে উঠছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ । একই প্রবণতা দেখা যাবে 'উপছায়া'তেও । এ বই যেন ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনাকাল থেকে আরম্ভ করে বাঙালির পাঠ্য যাবতীয় ভৌতিক গল্পের এক জলজ্যান্ত দলিল। অশরীরীদের নিয়ে রচিত বাঙালির গল্পকথার আয়োজন বড় অল্প নয়।  বিভূতিভূষণ থেকে জাফর ইকবাল, নানান সাহিত্যিকের কলমে সে ধারা পরিপুষ্ট হয়েছে। বাংলা সাহিত্য  'থাকা থেকে না থাকা'র জগতের প্রতি উজাড় করে দিয়েছে বিশেষ সম্ভ্রম। কিন্তু বঙ্কিম? কে বলতে পারে, বাংলার প্রথম সার্থক নভেলিস্ট যদি পুরোদমে ভূতের গল্প লিখতেন তাহলে তাঁর প্রতিভার অন্য এক দিক পাঠক নতুন করে আবিষ্কার করার সুযোগ পেত?

More Articles