সেলাম ডাক্তারবাবু! অ্যাম্বুলেন্স চালক, স্বাস্থ্যকর্মী আপনারা না থাকলে...

সমাজমাধ্যমে ২৫ শে ডিসেম্বরের রাতে পার্ক স্ট্রিটের ছবি দেখে শিউরে উঠছে অনেকেই। যতদূর চোখ যায় ততদূর শুধু মানুষের মাথা, রাস্তায় তিলধারণের জায়গা নেই। কথায় আছে, নিজের ভালো পাগলেও বোঝে, তা হলে কী হল কলকাত্তাইয়া বাঙালির! স্বজন হারানোর আর্তনাদ, হাসপাতালে বেড ও অক্সিজেনের অভাব, শ্মশানের অগণিত জ্বলন্ত চিতা-- এসব কি  সহজে  ভুলে গেলেন আমাদের সহনাগরিকরা? তাঁরা ভুলতেই পারেন, কিন্তু  স্বাস্থ্যকর্মীদের মনে দ্বিতীয় ঢেউয়ের স্মৃতি আজও টাটকা।  দিনের পর দিন নাওয়া,খাওয়া ভুলে হাসপাতালে পড়েছিলেন চিকিৎসক ও নার্সেরা। ডিউটি আওয়ার্সের তোয়াক্কা না করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেটেছেন অ্যাম্বুলেন্স চালক থেকে প্যারামেডিক্যাল স্টাফেরা। বাড়িতে বয়স্ক বাবা-মা, সন্তান বা পরিবার পরিজনদের মধ্যে এই মারণ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে, এই ভয়ে  চিকিৎসক- নার্সদের একাংশ থেকে গিয়েছেন হাসপাতালেরই কোনও ঘরে। অসহ্য গরমে সারাদিন গায়ে পিপিই কিট, মুখে মাস্ক পরে লড়াই করে গিয়েছেন। করোনা প্রাণ কেড়েছে বহু  স্বাস্থ্যকর্মীর কিন্তু সহকর্মীদের হারিয়েও ময়দান ছেড়ে যাননি কেউ। তাই বছরটা যখন শেষ হতে চলল, একটা হেরে যাওয়া যুদ্ধ জিতিয়ে দেওয়ার জন্য তাদের কুর্ণিশ না জানালেই নয়।        

ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (আইএমএ) রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে এবছর ৭৯৮ জন চিকিৎসক কোভিডে মারা গেছেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চিকিৎসক মৃত্যুতে বিহার প্রথম (১১৫)। বাংলায় মোট ৬২ জন চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে। দ্য হিন্দুর রিপোর্ট বলছে, এর মধ্যে প্রথম ছমাসেই ৪৩ জন মারা গিয়েছেন। করোনার দ্বিতীয় আবহে রাজ্যে চিকিৎসকদের মৃত্যু গোটা দেশের নিরিখে ১০ শতাংশেরও বেশি। প্রাক্তন আইএমএ  প্রেসিডেন্ট ও চিকিৎসক কে কে আগারওয়াল কোভিড পজিটিভ অবস্থায় ভিডিও বার্তায় বলেছিলেন,'দ্য শো মাস্ট গো অন'।

মনে পড়ে সমাজ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া প্রেগন্যান্ট মহিলা চিকিৎসকের সেই ভিডিও। পেটের সন্তানকে পৃথিবীর আলোও দেখাতে পারেননি।হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও শেষবারের মত কাঁদতে কাঁদতে অনুরোধ করেছেন,  “দয়া করে বাইরে বেরোলে মাস্ক ব্যবহার করুন। করোনাকে হালকা ভাবে নেবেন না। ভেবেছিলাম মহামারীর শেষপর্যন্ত রোগী দেখব কিন্তু…”।  কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক ৬৪ বছরের যাদব চ্যাটার্জি-সহ কলকাতার বহু চিকিৎসকের প্রাণ কেড়েছে করোনা। কলকাতার পাশাপাশি বহু জেলার চিকিৎসকও মারা গিয়েছেন করোনায়। বাঁকুড়া জেলার সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজের প্যাথোলজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক দেবীপ্রসাদ দাশগুপ্ত (৫৯), আর এক চিকিৎসক অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায় সহ সিউড়ি সদর হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অতনু শঙ্কর দাসের মৃত্যু হয়েছে করোনা আক্রান্ত হয়ে। এদের সকলেরই ভ্যাকসিনের দু'টি ডোজ নেওয়া ছিল। মৃত চিকিৎসকদের অনেকেরই একাধিক কো-মরবিডিটি থাকা সত্ত্বেও রোগীদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি।

এমনকী সদ্য ডাক্তারি পাশ করা তরতাজা কত প্রাণও শেষ হয়েছে গেছে কোভিডে। এমনই এক চিকিৎসক দিল্লির ২৬ বছরের আনাস মুজাহিদ। ২০২১ এর জানুয়ারি মাসে সদ্য পড়াশোনা শেষ করে কাজে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু মে মাসেই সব শেষ। ট্রেইন্ড নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যও বলছে,দেশের যে সমস্ত রাজ্যে নার্সেরা বেশি মাত্রায় করোনা আক্রান্ত হয়েছেন তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ অন্যতম। আশাকর্মী, অ্যাম্বুলেন্স চালক এঁদের মৃত্যুর সংখ্যার হিসেব পাওয়া যায় না। দিল্লির হাসপাতালে কর্মরত নার্স ভিভেকি কাপুর বিবিসিকে বলেছেন, ‘আমি দিল্লির একটি বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ বিভাগে কর্মরত। অতিমারী শুরু হওয়ার পর থেকেই বহু নার্স কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হতেই হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা আগের তুলনায় প্রায় পাঁচ গুনণবেড়ে গেছে।কোনও ছুটি ছাড়াই অতিরিক্ত সময় কাজ করে যাচ্ছি। দিনশেষে এতই ক্লান্ত হয়ে পড়ি. যে কোনও জায়গায়ই ঘুমিয়ে পড়ি। রোগীদের মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা করি কিন্তু একেকটা মৃত্যু দেখে নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। আশা করি এই ভাইরাসকে একদিন আমরা হারিয়ে দেব’।    

আরও পড়ুন-করোনামুক্তির স্বপ্ন থেকে মঙ্গলজয়ের হাতছানি- একুশে মৃত্যুর মিছিলের মধ্যেও জ্বলেছিল যে অনির্বাণ আলো

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে যে হারে প্রতিদিন সংক্রমণ বেড়েছে তাতে সরকারি , বেসরকারি বহু হাসপাতালের একাধিক বিভাগ বন্ধও করে দিতে হয়েছে। আবার কখনও দেখা গেছে, রোগীদের মনোবল বাড়াতে গানের তালে নেচে উঠেছেন তরুণ চিকিৎসক বা নার্সেরা। বুঝিয়ে দিয়েছেন, দিল্লি এখনও বহুদূর, এতো তাড়াতাড়ি হেরে গেলে চলবে না। আবার অগণিত শবদেহ অসহায় করে তুলেছে চিকিৎসকদেরও। সারারাত এক করতে পারেন নি চোখের পাতা। তাই ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোতে হয়েছে সে সব ভুলতে। মাসের পর মাস কাটিয়েছেন বাড়ির বাইরে, পরিবারের মানুষদের থেকে দূরে। তবে এসবের পরেও বহু জায়গায় স্বাস্থ্যকর্মীদের কপালে জুটেছে কটূক্তি, বিদ্রুপ আবার কোথাও রোগীর পরিজনদের মারধর ।

স্বাস্থ্যকর্মীদের এই যুদ্ধকে একদিন ফুল ছড়িয়ে কি সত্যি সম্মান জানানো সম্ভব? তার থেকে বরং বিরত থাকা যায় না কি বর্ষশেষের আনন্দ থেকে? পরিবার পরিজনদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে, মাস্ক পড়েই নাহয় স্বাগত জানানো যাক ২০২২ কে।  হারিয়ে দেওয়া যাক ওমিক্রনের চোখরাঙানিকে । এতেই  মনে হয় প্রকৃত সম্মান পাবে তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম।

More Articles