'সিলসিলা' থেকে 'ডর', তাঁর সংগীতের মূর্চ্ছনায় বারবার মজেছে দেশবাসী

এই রেশ, সংগীতের এই অনাবিল মূর্চ্ছনা যে কোনও বাস্তবের সীমানা অনায়াসে পেরিয়ে যায়। তাঁর সৃষ্ট এই অগণিত ঢেউয়ের মধ্যেই পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা থেকে যাবেন চিরকাল। মানুষের মনের গহিনে।

চলে গেলেন বিখ্যাত সন্তুরবাদক এবং সংগীতজ্ঞ পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা। মারা যাওয়ার সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। সংস্কৃতির জগতে একের পর এক ইন্দ্রপতনের সাক্ষী এই বছর। খবরে শোকগ্রস্ত সমস্ত ভারত। ভারতের সংস্কৃতিপ্রেমীদের মনে আরেকবার প্রিয় শিল্পী হারানোর শোকচ্ছায়া নামল। এই ঘটনায় শোকপ্রকাশ করে ট্যুইট করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। লিখেছেন, “পণ্ডিত শিবকুমার শর্মাকে হারানো ভারতের সাংস্কৃতিক জগতের অপূরণীয় ক্ষতি।” তাঁর সঙ্গে শিবকুমারের বিভিন্ন সাক্ষাৎ স্মরণ করেছেন মোদি। শোকপ্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। “আন্তর্জাতিক মানের ভারতীয় সঙ্গীত শিল্পী, প্রকৃষ্ট সন্তুর বাদক পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার প্রয়াণ খুবই দুঃখজনক।" পারিবারিক সূত্রে খবর কিডনির অসুখে ভুগছিলেন শিবকুমার। গত ছ'মাসের লড়াই এবার ফুরোল। ডায়ালিসিস চলছিল শেষের দিকে। ১০ মে সকালেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর।

 


শিবকুমারের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৩ জানুয়ারি উত্তর ভারতের জম্মুতে। জন্মসূত্রেই এক সাংগীতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা শিবকুমারের। বাবা ছিলেন বেনারস ঘরানার বিখ্যাত সংগীতশিল্পী উমা দত্ত শর্মা। শিবকুমারের মাতৃভাষা দোগরি। শৈশব থেকেই বাবা শিবকুমারকে সংগীতে পারদর্শী করে তুলতে চেয়েছিলেন। মাত্র বছরপাঁচেক বয়স থেকেই তিনি শিবকুমারকে তবলা ও শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম দিতে শুরু করেন। ১৩ বছর বয়সে প্রথম শুরু হয় সন্তুর শেখা। ওই বছরই (১৯৫৫) মুম্বইয়ের মঞ্চে একটি অনুষ্ঠানে সন্তুর বাজান শিবকুমার। কাশ্মীরের বাদ্যযন্ত্র এই সন্তুর। ভারতে এর তেমন প্রচলন ছিল না। জনপ্রিয়তাও ছিল না। উমা শর্মা এই যন্ত্রের ব্যবহার পুত্রের মাধ্যমে গোটা উপমহাদেশে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। বলা যায়, সে বিষয়ে অত্যন্ত সফলই হয়েছেন শিবকুমার। সন্তুরের জনপ্রিয়তা সৃষ্টিতে তাঁর অবদান হয়ে উঠেছে চিরস্মরণীয়। সেতার বা সরোদের পাশাপাশি সন্তুরের প্রতিও আকর্ষণ বেড়েছে মানুষের।

 

 

শিবকুমারের পরিবার বলতে স্ত্রী মনোরমা ও দুই সন্তান-সন্ততি। ছেলে রাহুলও বাবার কাছ থেকেই সন্তুরের প্রতি তীব্র আবেগ পেয়েছে। বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই তেরো বছর বয়স থেকেই সন্তুর শিখতে শুরু করেছিল রাহুল। ১৯৯৬ নাগাদ পিতা-পুত্র একই সঙ্গে বাজালেন মঞ্চে। সে এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। ১৯৯৯ সালে একটি সাক্ষাৎকারে এ-বিষয়ে শিবকুমার জানান, রাহুলকে নিজের শিষ্য করার অন্যতম কারণ, ও ভগবানের আশীর্বাদ পেয়েছে।

 

আরও পড়ুন: ‘আপনারা আর আমাকে গাইতে বলবেন না’, ধরা গলায় বলেছিলেন মান্না দে

 

শিবকুমার সন্তুরের জনপ্রিয়তা তৈরির অন্যতম কান্ডারী। শান্তারামের ছবি ‘ঝনক ঝনক পায়েল বাজে’-র একটি বিশেষ দৃশ্যের আবহসংগীত সন্তুরে রচনা করেন শিবকুমার। এরপরে ১৯৬০-এ প্রথম নিজস্ব অ্যালবাম। ১৯৬৭ নাগাদ বংশীবাদক হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া ও গিটারবাদক বৃজভূষণ কাবরার সঙ্গে ‘কল অফ দ্য ভ্যালি' নামে একটি কনসেপ্ট অ্যালবাম করেন। এই অ্যালবামটিকে ভারতীয় ধ্রুপদ সংগীতের ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় অ্যালবামগুলোর একটি হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। হরিপ্রসাদের সঙ্গে এই তাঁর জুটি শুরু। ১৯৮০ সালে ‘সিলসিলা’ থেকে শুরু করে বহু জনপ্রিয় ছবির জন্য সংগীত রচনা করেছেন দু'জনে। এঁদেরকে লোকে সেসময় ‘হরিহর’ (শিভ-হরি) যুগল বলেই চিনত। একে একে 'ফাসলে' (১৯৮৫), 'চাঁদনি' (১৯৮৯), 'লমহে' (১৯৯১) এবং 'ডর' (১৯৯৩)-এর মতো অসাধারণ সব জনপ্রিয় ছবির জনপ্রিয় গান তৈরি করেছেন দু'জনে। ১৯৮২ সালে জাকির হুসেনের সঙ্গে মঞ্চে অনুষ্ঠান করেছেন তিনি। শুধু ভারতে নয়, বিশ্বের দরবারে সন্তুরকে জনপ্রিয় করে তোলেন শিবকুমার। দেশে-বিদেশে নানা পুরস্কার, নানা সম্মানে ভূষিত হয়েছেন বারবার। ১৯৮৫ সালে আমেরিকা বাল্টিমোরের শহরে তাঁকে আনুষ্ঠানিক নাগরিকত্বে পুরস্কৃত করে। ১৯৮৬ সালে পেয়েছেন সঙ্গীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার। ১৯৯১ সালে তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। ২০০১ সালে, ঠিক তার এক দশক পরে পেয়েছিলেন পদ্মবিভূষণ খেতাব। এছাড়া তাঁর ‘কল অব দ্য ভ্যালি’, ‘চাঁদনি’ এবং ‘সিলসিলা’-র সংগীতের জন্য পেয়েছিলেন প্ল‍্যাটিনাম ডিস্ক। ‘ফাওলে’ তাঁকে এনে দিয়েছিল গোল্ড ডিস্ক। পেয়েছেন পণ্ডিত চতুরলাল এক্সেলেন্স অ্যাওয়ার্ডও।

 

 

কয়েক প্রজন্মকে অন্য ধরনের সংগীতের স্বাদ দেওয়া মানুষটি আজ চলে গেলেন। সন্তুর এত মিষ্টি একটি বাদ্যযন্ত্র, যে ধ্রুপদ সংগীতের সম্যক জ্ঞান না থাকা মানুষও একে উপভোগ করতে পারেন যথেষ্ট। তাই শুধু ধ্রুপদ নয়, এর বাণিজ্যিক ব্যবহারও সম্ভব। এই দুইয়ের মেলবন্ধনেই যন্ত্রটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন পণ্ডিত শিবকুমার। তাঁর যাবতীয় উত্তরাধিকার নিয়ে যেমন রাহুল রইলেন, পরবর্তী প্রজন্মকে সন্তুরের স্বাদ দেওয়ার জন্য, আবার নতুন অজস্র সন্তুরবাদক তৈরি করে গেলেন শিবকুমার। যাঁরা কাশ্মীরের এই ঐতিহ্য নিজেদের রক্তে বহন করবে পণ্ডিতের সঙ্গে কোনও রক্তের সম্পর্ক ছাড়াই। তাঁর ভূপালির রেশ এখনও বেজে বেজে চলেছে কোনও এক সিল্যুয়েট নারীর পায়েলে। এই রেশ, সংগীতের এই অনাবিল মূর্চ্ছনা যে কোনও বাস্তবের সীমানা অনায়াসে পেরিয়ে যায়। তাঁর সৃষ্ট এই অগণিত ঢেউয়ের মধ্যেই পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা থেকে যাবেন চিরকাল। মানুষের মনের গহিনে।

More Articles