'আপনারা আর আমাকে গাইতে বলবেন না', ধরা গলায় বলেছিলেন মান্না দে

মহাজাতি সদনের দ্বিপ্রাহরিক অনুষ্ঠান প্রায় শেষের মুখে। মান্না দে-র ৮৮তম জন্মদিন উপলক্ষে সেবার ১ মে বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল কলকাতার বেশ কিছু সংস্থা। প্রায় সারা দুপুরই বাংলা আর হিন্দি ছায়াছবির বিভিন্ন জনপ্রিয় গান গেয়ে শ্রোতাদের মাতিয়ে রেখেছিলেন মান্না দে। কতদিন পর তাঁর কণ্ঠে শোনা গিয়েছিল ‘তু প্যার কা সাগর হ্যায়’ বা ‘আজ আবার সেই পথে দেখা হয়ে গেল’-র মতো গান। অনুষ্ঠানের শেষ লগ্নে এসে মান্না দে ঘোষণা করলেন, "এবার আমি আপনাদের আমার কাকার একটা গান শোনাব।" এই বলে তিনি ধরলেন, ‘ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায় আমি বসে আছি।’ ‘ডাক হরকরা’ ছবির গান। গাইতে গাইতে তাঁর গলা বুজে এল। গানের পর খানিক নিস্তব্ধতা। তারপর ফের নানা গানের অনুরোধ আসতে লাগল শ্রোতাদের তরফ থেকে। মান্না দে ধরা গলায় জানালেন, "আপনারা আর আমায় গাইতে বলবেন না। এই গানের পর আমি আর কিছু গাইতে পারব না।"

১৯৪২ সালে কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে-র সঙ্গে প্রথম বম্বে আসেন মান্না দে। কৃষ্ণচন্দ্রর তখন বেশ নামডাক। সংগীতজগতের বহু মানুষ তাঁকে চেনেন ‘কানাকেষ্ট’ নামে। নিজের ভাইপোকে বড় ভালবাসেন তিনি। সযত্নে তালিম দিয়ে তাঁকে তৈরি করেছেন। কিন্তু মনে মনে উপলব্ধিও করেন যে আরও তালিম তাঁর দরকার। শিষ্য নিদেনপক্ষে তিন-চারজন গুরুর দ্বারস্থ হবেন, নানা গুণীজনের কাছ থেকে খেয়াল বা ধ্রুপদের বিভিন্ন অঙ্গ শিখে নেবেন, এমনটাই তো শাস্ত্রীয় সংগীতের দস্তুর। শুধু তাঁর একার তালিমে কি আর তা সম্ভব? এমতাবস্থায়, তাঁর পরামর্শে মান্না দে উস্তাদ আমন আলি খাঁ এবং উস্তাদ আব্দুল রহমান খাঁ-র কাছে তালিম নিতে লাগলেন। গানকে কতরকমের অঙ্গ দিয়ে সাজিয়ে মনোমুগ্ধকর করে তোলা যায়, তার পাঠ নিলেন যত্নে।

১৯৪৩ সালে প্রথম সিনেমায় গাইলেন মান্না দে। ছবির নাম ‘তমান্না’, সুরকার কৃষ্ণচন্দ্র দে। তারপর ১৯৫০ সালে শচীন দেব বর্মনের সুরে ‘মশাল’ ছবিতে ‘উপর গগন বিশাল’ নামে একটা গান গেয়ে মান্না দে জনপ্রিয়তা লাভ করলেন। সেসময় হিন্দি ছবির জগৎ শাসন করতেন বাঙালিরা। লোকের মুখে মুখে ফিরত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শচীন দেব বর্মন বা বিমল রায়ের মতো কলাকুশলীদের নাম। এই বলিউড থেকেই মান্না দে-র জয়যাত্রা শুরু।

আরও পড়ুন: ‘বাংলা নববর্ষে হিন্দি গান গাইব না’, বলেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

পরপর কয়েকটা হিন্দি ছবিতে গান গেয়ে মান্না দে তখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। এমতাবস্থায় ১৯৫৬ সালে শঙ্কর জয়কিষেণ জানালেন, ‘বসন্ত বাহার’ নামে এক ছবিতে তাঁকে ভীমসেন যোশির সঙ্গে ডুয়েট গাইতে হবে। গানের দৃশ্যটাও তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হল। এক সভাগায়ক রাজার সামনে বসন্ত-বাহার রাগে গান ধরবেন। বিশ্বজোড়া তাঁর খ্যাতি। প্রায় কেউই তাঁর প্রতিদ্বন্দিতা করার সাহস দেখান না। এই নিয়ে তাঁর বেজায় অহংকার। এমন সময় অভিনেতা ভরত ভূষণ এক সাধারণ নাগরিকের বেশে রাজসভায় প্রবেশ করবেন এবং নিজের অসাধারণ গায়কির জোরে সভাগায়ককে পরাস্ত করবেন। দৃশ্য মোটামুটি এটুকুই। শঙ্কর জয়কিষেণ মান্না দে-কে জানালেন, ভরত ভূষণের কণ্ঠে গাইতে হবে তাঁকে আর সভাগায়কের গলায় গাইবেন স্বয়ং ভীমসেন যোশি। ভীমসেনজির নাম শুনে মান্না দে সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন, তিনি বললেন, "অসম্ভব, যোশিজিকে আমি গান গেয়ে পরাজিত করতে পারব না।" শঙ্কর জয়কিষেণ তো পড়লেন বেজায় বিপদে। মান্না দে-কেই তাঁরা ওই বিশেষ গানটার জন্য ভেবে রেখেছিলেন, তা তিনিই যদি শেষমেশ বেঁকে বসেন, তাহলে তো মুশকিল। তাঁরা শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে ভীমসেনজিকে গোটা পরিস্থিতি বুঝিয়ে বললেন। ভীমসেনজি জানালেন, "দাঁড়ান, আমি দেখছি কী করা যায়।" এবার তিনি নিজেই মান্না দে-র সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে প্রশ্ন করলেন, "আপনি আমার সঙ্গে গাইতে চাইছেন না কেন?" মান্না দে সলজ্জভাবে তাঁকে জানালেন, ‘পণ্ডিতজি, আপনার সামনে আমি কী গাইব বলুন তো? এরা তো আবার বলছে শুধু গাইলে হবে না। আপনাকে আমায় গান গেয়ে হারাতেও হবে। তা কি আমি পারি?" মান্না দে-র কথা শুনে ভীমসেনজি হেসে উঠলেন। তাঁকে আশ্বাস দিয়ে তিনি বললেন, "আরে আপনি চিন্তা করছেন কেন? আমি তো রেডিওতে আপনার গান শুনেছি, বেশ ভালো লাগে আমার। চলুন কয়েকটা দিন একসঙ্গে রেওয়াজ করি, গান ঠিক তৈরি হয়ে যাবে।" তারপর রেকর্ডিংয়ের আগে বেশ কিছুদিন দু'জনে রেওয়াজ করেছিলেন একসঙ্গে। রেকর্ডিংয়ের পর আপামর সংগীতপ্রেমী শুনেছিলেন দ্রুত একতালের সেই অসামান্য বন্দিশ, ‘কেতকি, গুলাব, জুহি, চম্পক বন ফুলে।’

সারা জীবন বৈভবে কাটলেও ভারতের এই সুর-সম্রাটের শেষ বয়স কেটেছিল একাকিত্বে। মুম্বই ছাড়ার পর বেঙ্গালুরুতে ছোট মেয়ে সুমিতার বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলেন তিনি। সেখানেই শুরু হয় তাঁর একাকিত্বের জীবন। সূত্র মারফৎ জানা যায়, তাঁর ছোট মেয়ে এবং জামাই কারও সঙ্গে দেখা করতে দিতেন না তাঁকে। প্রখ্যাত গায়িকা আরতি মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, তিনি দিনের পর দিন তাঁকে ফোন করে গেছেন, অথচ কেউ তা তোলেনি। এমনকী, কবিতা কৃষ্ণমূর্তিও নাকি জন্মদিনে মান্না দে-র বাড়িতে গিয়ে দেখা করতে পারেননি তাঁর সঙ্গে। শুধুমাত্র বাইরে থেকে শুভেচ্ছা জানিয়েই তাঁকে ফিরে আসতে হয়। মৃত্যুর আগে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মেয়ে-জামাইয়ের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন, "ওরা আমায় সারাদিন বাড়িতে বন্ধ করে না রেখে তো কোনও পার্কে বসিয়ে রাখতে পারে, তাহলে অন্তত চোখের সামনে কিছু মানুষ দেখতে পাব। মানুষ না দেখলে বাঁচব কেমন করে?"

যাঁর সুর যুগ যুগ ধরে শ্রোতার মন জয় করে নিয়েছে, তাঁর কি শেষ জীবনে এই অবহেলাই প্রাপ্য ছিল?

 

তথ্য ঋণ: ভীমসেন যোশির সাক্ষাৎকার 

More Articles