তেলের সাহায্যে শিল্প, গুজরাতের একটিমাত্র গ্রামেই বেঁচে আছে চারশো বছরের এই ঐতিহ্য

করোনা অতিমারী, ভূজের ভূমিকম্প রোগান শিল্পীদের কাছে এক অন্ধকার সময়। এই শিল্প মোটামুটি দু'টি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে– তাপমাত্রা এবং আবহাওয়া। বৃষ্টির দিনে রং শুকোতে সময় নেয়, যার ফলে তা কাপড়ে স্থানান্তরিত করা মুশকিল হয়ে পড়ে।

ভারত বিভিন্ন শিল্পের দেশ, যা তার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে প্রতিফলিত করে। আর প্রতিটি শিল্পের একটি নিজস্ব গল্প এবং স্বকীয়তা আছে, যা বিগত যুগ, তাদের পূর্বপুরুষ এবং তাদের জীবিকার গল্প আমাদের সামনে তুলে ধরে। বৈচিত্র্যময় এই দেশের কতটুকুই বা আমরা চিনি আর জানি। বিশাল এই দেশে এমন অনেক শিল্প আছে, যা আজও আমাদের কাছে অজানা, অধরা। এই শিল্পের মধ্যেই এমন একটি বিলুপ্তপ্রায় শিল্প হল রোগান শিল্প। যা গুজরাতের কচ্ছ এলাকায় পাওয়া যায়। যা বিশ্বের আর কোনও জায়গায় না দেখা যায়, না পাওয়া যায়।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তেল এক অপরিহার্য বস্তু। পকোড়া বানানোর জন্য তেল, গাড়ির ইঞ্জিনকে শান্ত রাখতে তেল, নিজের স্ট্রেস থেকে মুক্তি পেতে হট ম্যাসাজ অয়েল, বা ভগবানের কাছে নিজের প্রার্থনা জানানোর জন্য তার সামনে তেলের প্রদীপ জ্বালানো- সব কাজেই তেল লাগবেই। নিত্য কাজ ছাড়াও শিল্পের কাজেও যে তেল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তার অন্যতম দৃষ্টান্ত এই রোগান শিল্প। রোগান শিল্পের অন্যতম বিশেষত্ব হলো এই শিল্পকলা তৈরিই হয় তেল এবং অন্যান্য ভেষজ রঙের সমন্বয়ে।

রোগান শিল্পের ইতিহাস
রোগান শিল্পটি ৪০০ বছর আগে আফ্রিদিদের হাত ধরে ভারতে আসে, যাদের আসল বাসস্থান ছিল সিরিয়ায়। আফ্রিদিরা আফগানিস্তান, পাকিস্তান, পারস্য এবং মধ্য এশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ভ্রমণ করতেন। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়েও এইসব অঞ্চলে অনেক কারুশিল্প কেন্দ্রীভূত হতে দেখা গেছে। রোগান শিল্পটি মূলত আফ্রিদিদের মুসলিম বংশধরদের দ্বারা অনুশীলন করা হয়েছিল। ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে না আসা পর্যন্ত শিল্পটি খুব বেশি পরিচিতি পায়নি।

আরও পড়ুন: হিন্দুরাই ভাঙতে চেয়েছিল, সাহসী যৌনতার চিহ্ন হয়ে আজও দাঁড়িয়ে খাজুরাহো

‘রোগান’ কথাটি মূলত এসেছে পারস্য থেকে। এর অর্থ হলো তেল। ক্যাস্টর অয়েল বা রেড়ির তেলের সঙ্গে পাথরের গুঁড়ো বা বিভিন্ন গাছের পাতা বা ফুলের নির্যাস মিশিয়ে প্রথমে গরম, পরে ঠান্ডা করে একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয় রোগান।

রোগান একটি প্রাচীন টেক্সটাইল শিল্প, যা ৪০০ বছর আগে গুজরাতের কচ্ছের নিরোনা গ্রামে এসে পৌঁছেছিল। প্রাথমিকভাবে এই শিল্প নিরোনা গ্রামের পশুপালক পরিবার এবং কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে টিকিয়ে রাখা হয়েছিল। প্রধানত তাদের বিয়ের পোশাকে এই শিল্প সজ্জিত হত। কিন্তু মেশিনে তৈরি কাপড়জামা আসার সঙ্গে সঙ্গে এই শিল্পের চাহিদা হ্রাস পেতে থাকে। আজ এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে নিরোনা গ্রামে মাত্র একটি পরিবার এই জটিল এবং সূক্ষ্ম শিল্প নিয়ে কাজ করে। তাঁর নাম আব্দুল গফুর খাত্রি। খাত্রিদের পরিবারের সকলেই রোগান শিল্পী। তাঁদের পরিবারই রোগান শিল্পকলার শেষ পরিবার।

রোগান শিল্পে খাত্রি পরিবারের অবদান
১৯৮০ সালে আব্দুল গফুর খাত্রি নিরোনা গ্রাম ছেড়ে আমেদাবাদ এবং মুম্বই পাড়ি দেন কাজের আশায়, কিন্তু কোথাও কোনও মনমতো কাজ না পেয়ে ২ বছর বাদে আবার নিজের গ্রামে ফিরে আসেন। ১৯৮২ সালে তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে এই রোগান শিল্প শেখেন। একটি পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, গফুর খাত্রি তাঁর বাবাকে বলেছিলেন, আজ যে শিল্প শুধু খাত্রি পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, সেখান থেকে এই শিল্পকে তিনি বিশ্ববাজারে নিয়ে যাবেন। গফুর খাত্রি তাঁর বাবাকে দেওয়া কথা রেখেছেন। আজ এই রোগান শিল্প খাত্রি পরিবারের হাত ধরে আমেরিকা, জাপান, ডেনমার্কেও পাড়ি দিয়েছে। রোগান শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে শুধু গফুর খাত্রি নন, তাঁর পরিবারের নয় প্রজন্মকে ধন্যবাদ দেওয়া জরুরি। তাঁদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আজও এই শিল্প বেঁচে আছে।

রোগান শিল্প তৈরির প্রক্রিয়া
আব্দুল গফুরের ভাই হামিদ খাত্রির কথায়, ক্যাস্টর বা রেড়ির তেল থেকে ভিত্তি প্রস্তুত করা খুব শ্রমসাধ্য ও জটিল কাজ। এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে মোট দু'দিন লেগে যায়। তেলটি একটি বিশেষ পাত্রে প্রথমে গরম এবং তারপর ঠান্ডা করা হয়। তেলটি পাত্রে বসানোর পর তা ক্রমাগত নাড়তে হয়, যাতে এটি পুড়ে না যায়। দু'-দিন পর, অবশিষ্ট তেলটিতে ঠান্ডা জল ঢেলে দেওয়া হয়। এটি রোগান নামক একটি আঠালো ঘন পেস্টে পরিণত হয়। প্রাকৃতিক রং তারপর তেলের মধ্যে যোগ করা হয়। রংগুলি ক্যাস্টর অয়েল বেসে যোগ করার পর মাটির পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়। এই রোগান পেস্ট সাধারণত জঙ্গলের মধ্যে তৈরি করা হয়।

এরপর তাতে কলম বা ধাতব কাঠি চুবিয়ে পোশাক এবং অন্যান্য সামগ্রীর ওপর ফুটিয়ে তোলা হয় অত্যন্ত সূক্ষ এই চিত্রকর্ম। যা দেখতে হয় দারুণ সুন্দর ও আকর্ষণীয়। কলম বা লোহার রড, উভয় প্রান্তে সমতল। হাতের মধ্যে রঙের পেস্ট নিয়ে তাকে ভালোভাবে রগড়াতে হয় এবং যখন ওই পেস্ট হাতের চাপে গরম হয়ে যায়, তখন ওই কলম দিয়ে টানলে ওই পেস্ট থেকে তারের মতো সরু সুতো তৈরি হয়, যা কাপড়ে ফেলা হয়। যখন এই শিল্প কলমের সাহায্যে কাপড়ে আঁকা হয়, তখন সবসময় বাঁহাতের একটি আঙুল কাপড়ের নিচে থাকে, যাতে ডিজাইন এবং হাতের আঙুল এক লয়ে চলে। দুইয়ের মিল ঠিকভাবে না হলে কাপড়ের ডিজাইন ভালোভাবে ফুটে ওঠে না। এই শিল্পের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল এক্ষেত্রে আগে থেকে কোনওরকম ব্লু প্রিন্ট বা কাপড়ে আঁকা কিছু থাকে না। শিল্পীরা নিজের মনের মতো শিল্প কাপড়ের ওপর তুলে ধরে। রোগান পেন্টিং তৈরির প্রক্রিয়া খুবই শ্রমসাধ্য এবং দক্ষতার প্রয়োজন।

রোগান শিল্প যে কাপড়ে আঁকা হয়, তা সাধারণত গাঢ় রঙের হয় যাতে তার মধ্যে অন্যান্য রংগুলি সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। হলুদ, সাদা, লাল, নীল, এবং সবুজ সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত রং। বেশিরভাগ সময় একটি কাপড়ের অর্ধেক অংশে শিল্পকলা তৈরি করা হয় এবং তারপর সেই অর্ধেক অংশটি বাকি অর্ধেক অংশের ওপর ফেলে দেওয়া হয়, যার ফলে একটি মিরর ইমেজ তৈরি হয়ে যায়।

রোগান শিল্পের ভবিষ্যৎ
আগে গুজরাতের নিরোনা গ্রামের অনেক পরিবারই এই শিল্পকলা নিয়ে চর্চা করত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত এই শিল্প আজ এই গ্রামের একটিমাত্র পরিবারেই সীমাবদ্ধ। প্রাচীনকালে এই শিল্প শুধু বাড়ির পুরুষদের শেখানো হতো। এই নিয়ে গফুর খাত্রি বললেন, আগে বাড়ির মেয়েরা এই শিল্প শেখা থেকে বঞ্চিত হতো, কারণ তারা বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে তারা সেখানে তার স্বামী, ছেলেকে শেখাবে। তাই নারীরা এই শিল্পকলা থেকে অনেক দূরে থাকত। কিন্তু বর্তমান সময়ে যেখানে এই শিল্প আজ বিরল, সেখানে দাঁড়িয়ে আব্দুল গফুর খাত্রি এবং তাঁর পরিবার গ্রামের ২০০ জন মেয়েকে এই শিল্পের শিক্ষা দিচ্ছেন বিনামূল্যে।

রোগান আর্ট সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য পরিবারের সকলে বিভিন্ন সম্মেলন, প্রদর্শনীতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। রোগানে ব্যবহৃত মোটিফ এবং নিদর্শনগুলি ঐতিহ্যগত এবং সমসাময়িক দু'টি ধারাকেই প্রদর্শন করে। ‘দ্য ট্রি অফ লাইফ’ ​​রোগান শিল্পকলার সবচেয়ে বিখ্যাত প্যাটার্ন। ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিউ ইয়র্ক সফরকালে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে ‘দ্য ট্রি অফ লাইফ’ ​​রোগান শিল্পকলা উপহারস্বরূপ দিয়েছিলেন। এরপর থেকেই বিভিন্ন পর্যটকরা গুজরাতের নিরোনা গ্রামে আসতে থাকেন তাঁদের শিল্পকলা দেখার জন্য। শুধুমাত্র আব্দুল গফুর খাত্রি নয়, তাঁর ছোট ভাইও একজন প্রশংসনীয় রোগান শিল্পী। নয় প্রজন্মের এই শিল্পীদের ঝোলায় আছে পদ্মশ্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার। ৪টি জাতীয় পুরস্কার, ৩টি জাতীয় মেধা সার্টিফিকেট, এবং ৭টি রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। যদিও রোগান শিল্পের পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়াগুলি আজ অন্যরা জানলেও, এমন অনেক বিদ্যা আছে, যা কেবলমাত্র গফুর খাত্রির পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাইরের লোকের কাছে তা অজানা।

গফুর খাত্রির কথায়, এই শিল্পের বৈশিষ্ট্য হলো কোনও শিল্পকর্মকে অনুকরণ করে এটা তৈরি করা হয় না। শিল্পীর নিজস্ব ভাবনায় তৈরি হয় এই শিল্প। এক সময় কচ্ছের মুসলিম পরিবারে বিয়ের অনুষ্ঠানে চাদর, টেবিল ক্লথে এই শিল্পের ব্যবহার হতো। এখন ওয়াল হ্যাঙ্গিং, স্টোলে এই শিল্পের ব্যবহার বাড়ছে। মেয়েদের বিভিন্ন পোশাকেও এই শিল্পের ছোঁয়া লেগেছে। কিন্তু অন্য শিল্পের মতো এই শিল্পে প্রতিযোগিতা না থাকলেও বাজারে জায়গা পেতে অনেক অসুবিধের সম্মুখীন হতে হয়। গফুর খাত্রির কথায়, ‘এমন নয় যে আমরা এই শিল্প বাজারে আনতে চাইছি না, কিন্তু আমাদের কাছে যথেষ্ট পুঁজি না থাকায় আমাদের অনেকসময় পিছিয়ে আসতে হয়।' বছরে খাত্রি পরিবার ৩-৪টি এগজিবিশনে অংশ নেয় আর বাকি সময়টা তারা তাদের কাজ নিয়ে থাকে।

করোনা অতিমারী, ভূজের ভূমিকম্প রোগান শিল্পীদের কাছে এক অন্ধকার সময়। এই শিল্প মোটামুটি দু'টি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে– তাপমাত্রা এবং আবহাওয়া। বৃষ্টির দিনে রং শুকোতে সময় নেয়, যার ফলে তা কাপড়ে স্থানান্তরিত করা মুশকিল হয়ে পড়ে। আবার গরম এবং শীতকালে রং কাপড়ে দেওয়ার আগেই শুকিয়ে যায়। আবার অন্যদিকে শিল্পীদের পেস্টের ঘনত্বের ওপরেও নজর দিতে হয়, কারণ তাঁরা মনে করেন, এই পেস্টই পুরো ফেব্রিকের নকশাকে প্রভাবিত করে। এইসব চ্যালেঞ্জকে প্রতিনিয়ত সামনে রেখে এগিয়ে চলছে এই রোগান শিল্প। গফুর খাত্রি আর তাঁর পরিবারের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আজ অনেক মানুষ এই শিল্পের দিকে ঝুঁকেছে, সচেতন হয়েছে। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে এই শিল্প আরও অনেক বড় হবে। গফুর খাত্রির কথায়, ১৯৮৫-র পর থেকে এই শিল্পের কদর ছিল। এখন নতুন প্রজন্মকে এই শিল্প শিখতে হবে, না হলে ৪০০ বছরের পুরনো এই শিল্প একদিন দেশ থেকে হারিয়ে যাবে।

 

 

 

 

More Articles