হিন্দুরাই ভাঙতে চেয়েছিল, সাহসী যৌনতার চিহ্ন হয়ে আজও দাঁড়িয়ে খাজুরাহো

এটা জানলে সবচেয়ে অবাক হবেন যে, মন্দিরের এসব নগ্ন মূর্তি কিন্তু শিল্পীদের কল্পনা ছিল না। সঙ্গমরত যুগলমূর্তিরা সবাই ছিলেন রক্তমাংসের মানুষ। শিল্পীরা জীবন্ত মডেল সামনে রেখেই নির্মাণ করতেন মূর্তি।

ভারতে ‘সেক্স’ কথাটি শুনলেই মানুষ কানে হাত দেয়, এই শব্দ শোনাও যে পাপ! প্রেম থেকে আকর্ষণ, আর আকর্ষণ থেকেই যে ‘সেক্স’ হয়, এ অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু ভারতের মতো দেশে প্রেম নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা হলেও ‘সেক্স’ যেন নীতিবিরুদ্ধ বিষয়, একটি অচ্ছুৎ রোগ। রহস্যের শেষ নেই প্রাচীন ভারতের যৌনতা নিয়ে। বলা যায়, ভারতে যৌনতা নিয়ে আর যাই হোক, শুধু খোলাখুলি আলোচনাটা হয় না। সামাজিক পর্যায়ে কেবল স্বামী স্ত্রীর ‘সেক্স’-ই বৈধ ভারতে, তা সে জোর করে হোক বা দু'জনের অনুমতিতেই হোক। বিবাহ যে ‘পবিত্র বন্ধন’। আর বিয়ের আগে কোনও মেয়ে ‘সেক্স’ করলে সে ‘খারাপ মেয়ে’। বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক, সমকামিতা এগুলি তো ঘৃণ্য বিষয়। ধর্মগ্রন্থ আর পুরাণের উদ্ধৃতি দিয়ে রোধ করা হয় যৌনতার গলা।

সালটা ১৯৯১। কন্ডোমের একটি বিজ্ঞাপন নিয়ে ভারতজুড়ে শুরু হয়েছিল হুলুস্থুল কাণ্ড। অভিনেত্রী ও মডেল পূজা বেদি ও মার্ক রবিনসনকে নিয়ে তৈরি বিজ্ঞাপনটি দেখে সমালোচনার ঝড় তুলেছিল ভারতবাসীর একাংশ। সেই প্রথম কোনও বিজ্ঞাপনে উন্মুক্ত পোশাক, বিদেশি পুরুষ মডেলের সঙ্গে ভারতীয় অভিনেত্রীর ঘনিষ্ঠ দৃশ্য। দেখে চক্ষু চড়কগাছ ভারতবাসীর! ভারতে যেখানে দু'-জন ভালবাসার মানুষ পরস্পরকে প্রকাশ্যে চুমু খেলে, বা হাত ধরাধরি করে দাঁড়ালে জনগণের মার খেতে হয়, যেখানে যৌনতা বিষয়ক দৃশ্য দেখানোর জন্য A তকমা পেতে হয়, সেই ভারতেই সাহস ও বিদ্রোহের মশাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহো মন্দির। তাকে এক অর্থে ‘রেবেল’-ই বলতে হয়।

মধ্যপ্রদেশের ঐতিহ্য হল খাজুরাহো। তবে এই গ্রামে অবস্থিত ২২টি প্রাচীন মন্দিরকে দেখলে মনেই হবে না, প্রাচীনকালে এই দেশে যৌনতা নিয়ে কোনও গোপনীয়তা ছিল। মধ্যপ্রদেশের ছত্তরপুর জেলার খাজুরাহো শহরের কাছে প্রাচীন হিন্দু ও জৈন মন্দিরের এই মিলিত স্থানে লুকিয়ে ভারতের ইতিহাস। ১৯৮২ সালের ১৫ অক্টোবর মন্দিরটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা দেয় ইউনেসকো।

আরও পড়ুন: নদীর গর্ভে পাঁচশো বছরেরও পুরনো মন্দির, যেভাবে আবিষ্কার হয়েছিল এই প্রাচীন স্থাপত্য

খাজুরাহো অবশ্য নামেই ‘মন্দির’, আদতে খাজুরাহো বললেই সকলের মনে যা ভেসে ওঠে, সেটা আর যাইই হোক, কোনও ভক্তি গদগদ মন্দির নয়। খাজুরাহো মানেই একটা কৌতূহল, রহস্য, ঠোঁটচাপা মুচকি হাসি, বাঁকা চোখে তাকানো। একজন ঐতিহাসিক যে দৃষ্টিতে খাজুরাহোকে, তার অপূর্ব সুন্দর ভাস্কর্যগুলো দেখবে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের কাছে খাজুরাহো মানেই ‘অশ্লীলতা’ ছাড়া আর কিছুই নয়!

Khajuraho

ইতিহাস
সংস্কৃত শব্দ ‘খর্জুরবাহো’ থেকেই এই নামের জন্ম। ‘খর্জুর’ হল খেজুর, ‘বাহো’ শব্দের অর্থ বহনকারী। আবার অনেক ইতিহাসবিদের মতে, ‘খর্জুর’ এখানে বৃশ্চিক এবং ‘খর্জুরবাহো’ হলেন স্বয়ং মহাদেব। হিন্দু ধর্মর পাশাপাশি একই প্রাঙ্গণে আছে জৈন মন্দিরও। ‘নাগারা’ ঘরানায় তৈরি খাজুরাহো মন্দিরগুলির বৈশিষ্ট্য হল এর গঠনশৈলি। প্রতিটা মন্দিরের অন্যতম অংশ ‘অর্ধমণ্ডপ’, ‘মণ্ডপ’, ‘মহামণ্ডপ’, ‘অন্তরাল’, ‘গর্ভগৃহ’, এবং ‘প্রদক্ষিণ’।

আজ যে মন্দিরগুলি আমরা খাজুরাহোতে দেখতে পাই, তা প্রধানত চান্দেল রাজাদের রাজত্বকালে বানানো হয়েছিল, ৯৫০-১০৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। দ্বাদশ শতকে ২০ বর্গকিমি এলাকা জুড়ে ছিল ৮৫টি মন্দির। এখন তার মধ্যে ২৫টি মন্দিরের অস্তিত্ব লক্ষণীয়। এই বাকি ২৫টি মন্দিরের মধ্যে বিখ্যাত মন্দিরগুলি হল ‘কাণ্ডারিয়া মহাদেব মন্দির’, যা তৈরি হয়েছিল চান্দেল রাজা বিদ্যাধরের সময়, এরপর ‘লক্ষণ মন্দির’ ও ‘বিশ্বনাথ মন্দির’। এই মন্দির দশম খ্রিস্টাব্দে রাজা যশোবর্মণের শাসনকালে তৈরি হয়।

Khajuraho

অনেকগুলি মন্দিরজুড়ে তৈরি হয়েছে এই ঐতিহাসিক স্থান। যার মধ্যভাগে রয়েছে কেন্দ্রীয় মহাদেব টেম্পল। সেই বেদিতে অধিষ্ঠিত দেবাদিদেব মহাদেব। আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অবয়ব বা প্রতিকৃতির মাধ্যমে পুরুষ ও নারীর পবিত্র সঙ্গমের বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে প্রেম ও কামনার দেবতা কামদেবের প্রতিকৃতি। তাঁকে ঘিরে তৈরি করা পুরুষ ও নারীদের মূর্তি, মানুষের সুপ্ত যৌন রিপুগুলির বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। কামদেবের পাশাপাশি খাজুরাহোর মন্দিরে ধর্ম (দায়িত্ব), অর্থ ও মোক্ষের (স্বাধীনতা) লক্ষ্য পাহাড় কেটে নানা প্রতিকৃতির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বহিরাংশ বেলেপাথরে তৈরি, প্রতিটি মন্দিরের গর্ভগৃহ তৈরি হয়েছে গ্র্যানাইটে। আদিরসের বাইরেও বহু কিছু উপজীব্য হয়েছে এই মন্দিরের ভাস্কর্যের।

চান্দেল রাজাদের রাজত্বকালে রাজশিল্পীদের উদ্যোগে মন্দিরগাত্রজুড়ে কঠিন পাথরের গায়ে ফুটে উঠেছিল অদ্ভুত সব কারুকাজ— যার মধ্যে বেশিরভাগটাই দেবদেবীদের মিলন-মুহূর্তের ছবি। নগ্ন শরীর, আর যৌনতা। অর্থাৎ, প্রাচীনকালে ভারতীয় সংস্কৃতিতে মিলনের বর্ণনাকে অশ্লীল বলে চিহ্নিত করা হয়নি। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, আজ কেন খাজুরাহোকে দেখতে এত লুকোচুরি? কেন খাজুরাহোর ছবি দেখলে আমরা মুখ ফিরিয়ে নিই। মন্দিরগাত্রে মিলনের ভাস্কর্য খোদাই করাকেও তখন ধরা হতো আনন্দ, প্রাচুর্য ও প্রকৃষ্টতার চিহ্ন হিসেবেই। যা এখন আমাদের কাছে ‘নোংরা’। ভেবে দেখলেই বোঝা যায়, প্রায় হাজার বছর আগেও মানুষ ভাবনা-চিন্তার দিক দিয়ে কেমন এগিয়ে ছিল! যৌনতা তাদের কাছে ছিল নিতান্তই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।

Khajuraho

মিথ
খাজুরাহোর ইতিহাস এমন হলে তাকে ঘিরে রহস্য কেমন হবে ভাবুন। বলা হয়ে থাকে, বারাণসীর এক ব্রাহ্মণের এক অনিন্দ্যসুন্দর কন্যা ছিল। তাঁর নাম হেম্বতী। কিন্তু ব্রাহ্মণের এই কন্যা খুব অল্প বয়সেই বিধবা হন। জ্যোৎস্নাশোভিত গ্রীষ্মের রাতে এই বিধবা কন্যা পদ্মপুকুরে স্নান করতে গেলে চন্দ্রদেব তার সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে পড়েন। পরে চন্দ্রদেব মানুষের রূপ নিয়ে পৃথিবীতে আসেন, এবং তাঁরা দু'জনে একে অন্যের সঙ্গে মিলিত হন। যখন তাঁদের মোহ কাটে, তখন চন্দ্রদেব নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং নিজে নিজেকে অভিশাপ দিতে থাকেন একজন বিধবার সঙ্গে এই ধরনের অনৈতিক কাজের জন্য। সেই সঙ্গে চন্দ্রদেবতা হেম্বতীকে আশীর্বাদ করেন যে, তাঁর গর্ভে যে সন্তানের জন্ম হবে, সেই সন্তান হবে সিংহ-পুরুষ এবং বিশাল ক্ষমতার অধিকারী। এই ঘটনার পর হেম্বতী নিজ গৃহ ত্যাগ করে খাজুরপুরে (খাজুরাহো) আসেন এবং এখানে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। এই পুত্রসন্তানের নাম রাখেন চন্দ্রবর্মন। পরবর্তীতে তিনি চন্দ্রদেবতার আর্শীবাদের কারণে এই অঞ্চলের রাজা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি তাঁর মায়ের ইচ্ছায় এই অঞ্চলে ৮৫টি মন্দির নির্মাণ করেন। তিনি খাজুরাহোতে একটি যজ্ঞ-অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন, যাতে তাঁর মায়ের পাপমোচন হয়।

কিন্তু এই মন্দিরের ইতিহাসের আড়ালে রয়েছে অন্য এক রহস্যপূর্ণ কাহিনি। যে মন্দির কিনা নির্মাণ হয়েছিল কারও পাপমোচনের জন্য, সেই ফের অভিশপ্ত হয়! এমনই এক লোককথা শোনা যায় এই অঞ্চলের মানুষের মুখে। গ্রামের এক বাসিন্দার কথায়, খাজুরাহো গ্রামে নাকি কোনও এক সময় এসেছিলেন এক সাধু। সাধু সেখানেই তাঁর শিষ্যদের রেখে যাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন শিষ্যরা। কিন্তু অসুস্থ শিষ্যদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেননি গ্রামের কেউই। একটু জলও তাদের কেউ এগিয়ে দিতে আসেনি। এই অবস্থা দেখে সেই সাধু ফিরে এসে নাকি গ্রামের মানুষদের অভিশাপ দেন। পাষাণ-হৃদয়ের অধিকারী গ্রামবাসীরা, তাই তারা চিরতরে পাষাণ হয়ে যাক, এমন অভিশাপ দেওয়ার পরেই নাকি এইসব মানুষেরা পাথর হয়ে যায়, এবং এই মন্দিরের গায়ে যৌনক্রীড়ারত মূর্তিগুলি নাকি তাদেরই।

মধ্যপ্রদেশের আন-বান-শান এই খাজুরাহো। এক পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভারত স্বাধীন হওয়ার পর এক রাজনৈতিক নেতা এই মন্দির ধ্বংস করার জন্য দাবি তোলেন। যিনি দাবি তুলেছিলেন, তিনি নিজেও ছিলেন একজন হিন্দু এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তবে ‘দেশের স্বাধীনতা’ এবং ‘শিল্পের স্বাধীনতা’ প্রসঙ্গে তাঁর ভাবনা ভিন্ন ছিল। তাঁর কথায়, এই মন্দিরের গায়ের এইসব ‘ইরোটিক’ স্কাল্পচার নাকি প্রকাশ্য যৌনতার বিজ্ঞাপন, যা সমাজকে ক্ষতির দিকে নিয়ে যাবে। প্রায় একই সময়ে এইরকমই দাবি তোলে কিছু মানুষ, তাদের দাবি ছিল, মন্দির ভাঙতে হবে না, কিন্তু মন্দিরগাত্রের ভাস্কর্যগুলি সিমেন্ট দিয়ে, নিদেনপক্ষে কাপড় দিয়ে যাতে ঢেকে দেওয়া হয়, যাতে মন্দিরে আগত দর্শনার্থীদের সামনে ওইসব যৌন দৃশ্য উন্মুক্ত না থাকে। বলাই বাহুল্য, এইসব মানুষদের যুক্তি ছিল একই– ‘যৌনতা হল অশ্লীলতা’।

আরেকটা মজার ব্যাপার হলো, এখানকার লোকেদের বিশ্বাস, প্রাচীন কালে শিল্পকারদের মন্দির নির্মাণের সময় বহির্জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন রাখা হতো, এবং নারীসঙ্গ থেকে বঞ্চিত রাখা হতো, কিন্তু শিল্প রচনার ক্ষেত্রে তাঁদের ন্যূনতম স্বাধীনতা ছিল না। তাঁরা যা রচনা করতেন, তা করতে হতো রাজা, বাস্তুকার, বা দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান পুরোহিতের নির্দেশমতো। তাঁদের নির্দেশ-ভিন্ন সামান্য ফুলপাতার অলংকরণ রচনা করার ক্ষমতাও ভাস্করদের ছিল না।

আর এটা জানলে সবচেয়ে অবাক হবেন যে, মন্দিরের এসব নগ্ন মূর্তি কিন্তু শিল্পীদের কল্পনা ছিল না। সঙ্গমরত যুগলমূর্তিরা সবাই ছিলেন রক্তমাংসের মানুষ। শিল্পীরা জীবন্ত মডেল সামনে রেখেই নির্মাণ করতেন মূর্তি। গবেষকদের বক্তব্য, মিথুন ভাস্কর্য রচনার করার জন্য কাশ্মীর, উৎকল, ত্রিগর্ভ, চালুক্য, গন্ধর্ব রাজ্যের বিভিন্ন হাট থেকে নারীদের সংগ্রহ করে আনা হতো। তারপর তাঁদের দেখে শিল্প রচনা করতেন ভাস্কররা। তারপর মডেল হিসেবে শুরু হত তাদের দুর্বিষহ জীবন। মিথুনমূর্তি অথবা নগ্নিকামূর্তি গড়ে তোলার জন্য তাদের নগ্ন হতে বাধ্য করা হতো, অচেনা পুরুষের সঙ্গে সঙ্গমরত অবস্থায় থাকতে হতো, এমনকী, মিলিত হতে হতো পশুর সঙ্গেও। খাজুরাহোর শ্রেষ্ঠ নিদর্শন আজ পর্যটকদের মনে বিস্ময় সৃষ্টি করে। বিস্ময়ে পর্যটকরাও বাহবা দেন চান্দেলরাজ বিদ্যাধরকে। কিন্তু এসবের মাঝে চাপা পড়ে যায় অসহায় উলঙ্গ নারীদের লজ্জা-কান্না আর ভাস্করদের কঠোর পরিশ্রম। রাতদিন এক করে যারা তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন এসব মূর্তি, তাঁরাই আজ অজ্ঞাত, অপরিচিত।

 

More Articles