কাকে বলে 'ভীমরতি', রতিক্রিয়ার সঙ্গে কী সম্পর্ক? আসল তথ্য চমকে দেবে

Bengali Vocabulary: বার্ধক্যে কাশীধামে গমন করার রীতিকেই একসময় 'বুড়ো বয়সে ভীমরথী' তথা বুড়ো বয়সে ভীমরতি বলা হত?

এবারের শব্দ ভীমরতি। বুড়ো বয়সে ভীমরতি তো আকছারই হয়। ভীমরতির সঙ্গে 'বুড়ো বয়স' বা বার্ধক্য যেন জড়িয়ে-জাপটিয়ে আছে। কোথা থেকে এল এই 'ভীমরতি' শব্দটি?

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ' ঘাঁটলে যা ব্যুৎপত্তি পাওয়া যায়, তা হল, ভীমরথী স্ত্রী [ভীমরাত্রী > প্রা* ভীমরত্তী > বা ভীমরতী > ভীমরথী]। যে সংস্কৃত শ্লোক উদ্ধৃত করা হয়েছে, তা হলো, 'সপ্তসপ্ততিতমে বর্ষে সপ্তমে মাসি সপ্তমী। রাত্রিভীমরথীনাম নরাণাংদুরতিক্রমা। (এই রাত্রি ভীষণ, কারণ, ইহা দুরতিক্রম্য, অর্থাৎ সাধারণে এরূপ দীর্ঘজীবী হয় না।)। মানবজীবনের ৭৭ বছর ৭ মাস ৭ রাত কাটলে ভীমরতি দশা আসে। এই বয়স পার হওয়া মানে পুণ্যবান হওয়া। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস বিরচিত 'বাঙ্গালা ভাষার অভিধান' জানাচ্ছে, [সং = ভীমরথ + ঈ(স্ত্রীং)। গ্রা ° ভিমরতী]। তিনি লিখেছেন, "হিন্দুর বিশ্বাসমতে এই দশার পর মানব জীবিত থাকিলে প্রতিদিন তাহার পক্ষে শত সুবর্ণ দক্ষিণাপদ যজ্ঞের তুল্য হয়। সে ইচ্ছামত গমন করিলে বিষ্ণুকে প্রদক্ষিণ করার ফল হয়, কথা বলিলে মন্ত্র জপ করা হয়, নিদ্রা তার ধ্যান এবং অন্ন তার পক্ষে সুধাতুল্য বিবেচিত হয়।]

তাই যদি হয়, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস ভীমরতি-র দ্বিতীয় অর্থ কেন দিলেন, 'অতিশয় বার্দ্ধক্যবশতঃ বুদ্ধিভ্রংশতা'? তাহলে কি দু'টি সমোচ্চারিত শব্দ আমাদের অভিধানপ্রণেতাদের ধাঁধাঁয় ফেলেছে? সুবলচন্দ্র মিত্রর 'সরল বাঙ্গালা অভিধান' কিন্তু ভীমরতি ও ভীমরথী শব্দদু'টির আলাদা এন্ট্রি রেখেছেন। "ভীমরতি– পদে পদে ভ্রম, বার্ধক্যজনিত বুদ্ধিভ্রংশ. dotage. বাংপ্র। বি। ভীমরথী– অতিপ্রাচীন অবস্থা বিঃ, ৭৭ বৎসর ৭ মাস বয়সের সপ্তমী রাত্রি। ভীমরথ + ষ্ণ ইদমর্থে বা ভুল্যার্থে + ঈপ্। বহু। বি ; স্ত্রী।" অর্থাৎ সুবলচন্দ্র মিত্র নিশ্চিত ছিলেন যে, ভীমরথী থেকে ভীমরতি আসেনি, এটি সম্পূর্ণ আলাদা শব্দ, বাংলা প্রচলিত শব্দ। কিন্তু ভীমরতির কোনও ব্যুৎপত্তি তিনি দিতে পারেননি। তবে ভীমরতি ধরলে 'পদে পদে যে ভ্রম হয়', সে বিষয়ে তাঁর মনে কোনও সন্দেহ নেই।

আরও পড়ুন: পুলিশ কেন ‘আব্বুলিশ’? অভিধানে নেই, কোথা থেকে এল লুকোচুরি খেলার এই চেনা শব্দ

সংসদ বাংলা অভিধান আবার মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছে। ভীমরতি-র অর্থ এখানে, ১. বার্ধক্যজনিত ঈষৎ বুদ্ধিভ্রংশ বা খ্যাপামি; ২.(মূল অর্থ) ৭৭ বছর ৭ মাস বয়সের সপ্তম রাত্রি (বর্তমানে এই অর্থ অপ্রচলিত)। [সং. ভীমরথী? < ভ্রমার্তি?]। সংসদ অভিধান কি প্রচলিত সংস্কৃত ভীমরথী-র আগের রূপ 'ভ্রমার্তি' ভেবেছেন? তিরচিহ্নের অভিমুখ তো সেটাই নির্দেশ করছে! নগেন্দ্রনাথ বসুর 'বিশ্বকোষ' ভীমরথী তথা ভীমরতির নানাবিধ অর্থ দিয়েছে।

১. ৭৭ বৎসরের সপ্তম মাসের সপ্তমীরাত্রির নাম ভীমরতি, এই দিন মনুষ্যদিগের দুরতিক্রমণীয়। যে সকল ব্যক্তি এই বয়স অতিক্রম করিয়া জীবিত থাকে, তাহারা অতিশয় পুণ্যাত্মা।

২. একটি নদীর নাম। এই নদী সহ্য পর্বত হইতে নির্গত হইয়াছে। এই নদীতে স্নানাদি করিলে সকল পাতক বিদূরিত হয়।

৩. রোমক-সিদ্ধান্তবর্ণিত দেশভেদ।

বামন শিবরাম আপ্তের 'The Practical Sanskrit-English Dictionary'-তে ভীমরথী-র সাতাত্তর বছর সাত মাস সাত রাত্রি-র প্রচলিত অর্থকেই মান্যতা দেওয়া হয়েছে। জামিল চৌধুরী সংকলিত বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে ভীমরতিকে সংস্কৃত ভীমরথী থেকে আগত বলা হয়েছে।অভ্র বসুর 'বাংলা স্ল্যাং, সমীক্ষা ও অভিধান' বইয়ে ভীমরতির অর্থ দেওয়া হয়েছে মতিভ্রম, বার্ধক্যজনিত মতিভ্রম। তবে ব্যুৎপত্তি দেওয়া হয়নি।

মতিভ্রম শব্দটিকে ঘুরিয়ে ভ্রমমতিও বলা যায়। পূর্বপদের পরনিপাতন বলে ব্যাকরণে একটি ব্যাপার আছে। মতি শব্দটির অনেক অর্থ। যথা, জ্ঞান, বুদ্ধি, স্মরণশক্তি, অনুরক্তি, ইচ্ছা, মন, চিত্ত। মতিভ্রম– ব্যাসবাক্য হল 'মতির ভ্রম', ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস। ভ্রমমতি–ব্যাসবাক্য হল 'ভ্রম প্রবণ মতি', মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস। বার্ধক্যে যেমন মতিভ্রম হয়, তেমনি ভ্রমমতিও হয়। এই ভ্রমমতি থেকে প্রাকৃত, অপভ্রংশের পথ বেয়ে ভীমরতি শব্দটি আসতে পারে। অ্যালজাইমার্স ডিজিজের প্রধান উপসর্গই তো ভ্রমমতি। ভ্রমমতি> ভেরোমমতি> ভেরোম্মতি> ভেরমতি> ভেমরতি (বর্ণবিপর্যয়)> ভীমরতি- এই পথেই হয়তো এসেছিল তদ্ভব শব্দ ভীমরতি। জানি না, ভাষাতাত্ত্বিক বা ধ্বনিতাত্ত্বিকরা কী বলবেন, তবে এটি একটি সম্ভাব্য সমাধান হতেই পারে।

পৌরাণিক কোনও ব্যাখ্যা আছে কি না, ভাবতে ভাবতে একটি মিসিং লিঙ্ক খুঁজে পেলাম। সেটিও অগ্রাহ্য করা যায় না। বানপ্রস্থে যাওয়ার চল ছিল আগে। এখন আর নেই। তবে বৃদ্ধাশ্রমগুলিই হয়তো আজকালকার বানপ্রস্থনিবাস! তা, এই বানপ্রস্থের প্রকৃত অর্থ কী? অর্থ হল, তৃতীয়াশ্রমী দ্বিজাতি। অভিধানে পাই, "গৃহস্থ পক্বকেশ শিথিলচর্ম হইলে ও পৌত্রের মুখাবলোকন করিলে, স্ত্রীকে লইয়া বা পুত্রহস্তে স্ত্রীকে সমর্পণ করিয়া বানপ্রস্থ্য হইবেন এবং বন্য ফলমূলাদি ভক্ষণ করিয়া ঈশ্বরাধনা করিবেন।"

বানপ্রস্থে যাওয়া গৃহস্থরা অনেকেই বাণারসী যেত, সেখানকার তপোবনে দিনাতিপাত করার জন্যে। বৈদিক গবেষণায় জানা গেছে এটা। সুশ্রুতের প্রথম অধ্যায়ে বর্ণিত আছে– "অমরশ্রেষ্ঠ ধন্বন্তরি যখন কাশীর অধিপতি দিবোদাসরূপে অবতীর্ণ হইয়া বাণপ্রস্থাশ্রমে মহর্ষিগণ কর্তৃক বেষ্টিত আছেন, তখন সুশ্রুত আয়ুর্ব্বেদ জিজ্ঞাসায় উপনীত হইলেন।"

বায়ুপুরাণে জানা যায় কাশীরাজ ধন্বন্তরির পুত্র কেতুমান, কেতুমানের পুত্র ভীমরথ ও ভীমরথের পুত্র দিবোদাস। মতান্তরে ভীমরথই দিবোদাস। ভীমরথের রাজত্বকালে দেবাদিদেব শিবের অনুচর নিকুম্ভ কাশী তথা বারাণসীতে পূজিত হত। নিকুম্ভের বরে কাশীবাসীরা প্রভূত সম্পদের মালিক হত। ভীমরথের মহিষী সুযশা পুত্রের আকাঙ্ক্ষায় নিকুম্ভের ব্রত করেন, কিন্তু তিনি বিফলমনোরথ হন। সেইজন্য ক্রোধে অন্ধ হয়ে ভীমরথ নিকুম্ভের মন্দির ধ্বংস করেন। তখন নিকুম্ভ শাপ দেন, অদূরভবিষ্যতেই বারাণসীধাম ধ্বংস হবে। এই সময়ে ক্ষেমক নামক শিবভক্ত রাক্ষস কাশীনগরী ধ্বংস করে। বারবার কাশী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ভীমরথের দুষ্কর্মের কারণে। একসময় ভীমরথ ও বারাণসী সমার্থক ছিল। বারাণসীর নামই হয়ে গেল ভীমরথী। রোমকসিদ্ধান্ত বর্ণিত দেশ বা প্রদেশ ছিল ভীমরথী, যা আজকের কাশী বা বারাণসী।

বারাণসীর মাহাত্ম্য বুঝতে হলে আমাদের স্বামী বিবেকানন্দর বাণী পড়তে হবে। স্বদেশমন্ত্র অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন,

বল মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই; তুমিও কটিমাত্র-বস্ত্রাবৃত হইয়া, সদর্পে ডাকিয়া বল— ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী;...।

তাহলে কি বার্ধক্যে কাশীধামে গমন করার রীতিকেই একসময় 'বুড়ো বয়সে ভীমরথী' তথা বুড়ো বয়সে ভীমরতি বলা হত? হলেও হতে পারে! কিছুই অসম্ভব নয়।

বস্তুত ভ্রমমতি শব্দটি থেকে ভীমরতি আসার সম্ভাবনা যথেষ্ট। তবে বার্ধক্যের বারাণসীর সঙ্গে কাশীরাজ ভীমরথ ও তার কীর্তিকলাপের ক্ষীণ যোগসূত্র থাকতেই পারে। ভাবা প্র্যাকটিস তো করতেই হবে।

More Articles