পুলিশ কেন 'আব্বুলিশ'? অভিধানে নেই, কোথা থেকে এল লুকোচুরি খেলার এই চেনা শব্দ
Bengali Vocabulary: আব্বুলিশ শব্দটি এল কোথা থেকে? বাংলা ভাষার কোনও প্রামাণ্য অভিধানে শব্দটি নেই।
এবারের শব্দ 'আব্বুলিশ'। আব্বুলিশ শব্দটি শুনলেই বাঙালি মধ্যবয়স্কর মনে ছেলেবেলার এক ঝলক টাটকা বাতাস বয়ে আসে। লুকোচুরি খেলায় এই বিশেষ শব্দটি উচ্চারণ করেনি এমন লোক পাওয়া শক্ত। ছেলেবেলায় স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে 'আব্বুলিশ' বলেছে, কিছুটা বিরতি নেওয়ার সময়।
তা, এই আব্বুলিশ শব্দটি এল কোথা থেকে? বাংলাভাষার কোনও প্রামাণ্য অভিধানে শব্দটি নেই। এমনকী, অভ্র বসুর 'বাংলা স্ল্যাং, সমীক্ষা ও অভিধান' বইটিতেও নেই শব্দটি। তাই শব্দটিকে ছেলেবেলার আবোলতাবোল শব্দ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন অনেক ভাষাবিদ। তবে শব্দটিকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ব্যুৎপত্তি অধরা।
ধ্বনিসামঞ্জস্যের জন্য ইংরেজি শব্দ Abolish-এর কথা ভেবেছেন কেউ কেউ। কিন্তু ধ্বনিগত মিল থাকলেও অর্থে মিল নেই। এখানে কোনও প্রথার বিলোপ করা হয়নি, কাউকে চিরতরে ধ্বংস করা হয়নি। শুধু ক্ষণিকের বিরতি নেওয়া হচ্ছে, চুপ করে যাওয়া হচ্ছে, খেলা চালিয়ে যেতে সাময়িক অপারগতার কথা বলা হচ্ছে। তাই মূলশব্দ হিসেবে ইংরেজি Abolish-এর দাবি নস্যাৎ করা যায়।
আরও পড়ুন: ভাশুরের সামনে ঘোমটা টানাই নিয়ম! ‘ভাদ্দরবউ’ শব্দে কি লুকিয়ে অন্য কোনও অর্থ
তৎসম কোনও শব্দের সঙ্গেও ধ্বনিসাম্য নেই 'আব্বুলিশ' শব্দটির। 'অভিলাষ' শব্দটি কাছাকাছি উচ্চারণের, কিন্তু অভিলাষ কোন দুঃখে 'আব্বুলিশ' হতে যাবে, সেটাই বোঝা যায় না। অভিবিলাস শব্দটির আভিধানিক স্বীকৃতি নেই, কিন্তু অর্থহীন নয়। তবে এর সঙ্গেও 'আব্বুলিশ' খাপ খাচ্ছে না। যে অর্থে আব্বুলিশ-এর ব্যবহার, তার সঙ্গে অভিবিলাস-এর মিল নেই, এখানে বিলাস নয়, বিরতি অর্থটিই প্রাধান্য পাচ্ছে। হিন্দিতে 'আব বোল ইস' বলে কোনও বাক্যের ব্যবহার ছেলেবেলার খেলায় হতে পারে, এটাও মনে হয় না।
ইউরোপীয় অন্য কোনও ভাষা থেকে শব্দটি এসেছে কি না, সেটাও দেখতে হয়। কিন্তু সেখানেও আব্বুলিশ-এর দেখা নেই। এমনকী, যে পর্তুগিজ শব্দ বাংলা ভাষায় গিজগিজ করছে, তার তালিকাতেও এই শব্দটি নেই। অথচ বাংলায় কত শব্দই তো এসেছে পর্তুগিজ থেকে। আলমারি, আলপিন, বালতি, সাবান, তোয়ালে, বোতাম, সায়া, কামিজ- কত কী!
হাতের কাছে আছে ড. সত্যনারায়ণ দাশ বিরচিত বাংলায় দ্রাবিড় শব্দ (ব্যুৎপত্তিকোষ) বইটি। এখানেও নেই দেখছি আব্বুলিশ বা কাছাকাছি উচ্চারণের কোনও শব্দ। তাই দক্ষিণ ভারতীয় ভাষাগুলি থেকেও আসেনি আব্বুলিশ। সাঁওতালি বা মুণ্ডারি শব্দভান্ডার থেকেও আসেনি।অধ্যাপক ক্ষুদিরাম দাস বিরচিত সাঁওতালি বাংলা সমশব্দ অভিধানে নেই 'আব্বুলিশ'।
তাহলে আব্বুলিশ এল কোথা থেকে?
এখান থেকেই আমার শব্দাভিযান শুরু। আগেরগুলো যদি বেস ক্যাম্প, ক্যাম্প ওয়ান, ক্যাম্প টু ইত্যাদি হয়, ক্যাম্প ফোর থেকে শব্দশৃঙ্গের দিকে এগোনো শুরু করলাম। আরবি-ফারসি থেকে কি আসতে পারে আব্বুলিশ?
প্রথমেই মোহাম্মদ হারুন রশিদ সংকলিত ও সম্পাদিত 'বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবি ফারসি উর্দু শব্দের অভিধান' দেখতে শুরু করি। বলাবাহুল্য আ-দিয়ে শুরু শব্দের মধ্যে আব্বুলিশ নেই। ই-দিয়ে শুরু শব্দগুলির মধ্যে পেলাম কাছাকাছি উচ্চারণের শব্দ 'ইবলিশ'। মানে শয়তান। এসেছে আরবি শব্দ 'ইবলিস' থেকে। এর সঙ্গে আব্বুলিশ-এর কিঞ্চিৎ ধ্বনিসাযুজ্য আছে। কিন্তু অর্থের মিল নেই। অতএব ও-পথে গিয়ে লাভ নেই।
এবার শুরু করলাম ড.মুহাম্মদ ফজলুর রহমানের 'আধুনিক আরবী-বাংলা অভিধান' দেখা। রিয়াদ প্রকাশনীর বই। কে জানে, মিললেও মিলতে পারে অমূল্যরতন।
বছরদশেক আগে এই অভিধানটি কিনেছিলাম কলুটোলা স্ট্রিটের (সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের পূর্ব দিকের অংশে) একটি পুস্তকবিপণি থেকে। কলেজ স্ট্রিটের কোনও দোকানই আরবি থেকে বাংলা কোনও অভিধানের হদিশ দিতে পারেনি। কফি হাউজের উল্টোদিকের ফুটপাথের এক দোকানদার কলুটোলার দোকানটির ঠিকানা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, 'ওসব বই কলেজ স্ট্রিটে নয়, কলুটোলায় পাবেন।' মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র হওয়ার সুবাদে জায়গাটা আমার চেনা।
তা, এই অভিধানটির সংকলক আরবি হরফের পাশে বাংলা লিপিতেও উচ্চারণ দিয়ে দেওয়ায় খোঁজাখুঁজিতে প্রভূত সুবিধে হয়েছে আমার, আরবি না জেনেও।অসম্ভব ধৈর্য না ধরলে এখান থেকে বাংলায় ব্যবহৃত শব্দ বার করা মুশকিল। কয়েক দিনের পরিশ্রমে (ডাক্তারি পেশা বাঁচিয়ে) দু'টি শব্দ আবিষ্কার করলাম। এই শব্দদু'টির সঙ্গে আব্বুলিশ শব্দটির মূল ভাবটির সাদৃশ্য আছে। একটি শব্দ হল 'আবিয়া'। মানে বিরতি দেওয়া। আর একটি শব্দ 'আবলাসা'। মানে, নীরব হওয়া, নিশ্চুপ হওয়া, লজ্জিত হওয়া। তবে পূর্ণ ধ্বনিসাদৃশ্য না থাকায় 'আবিয়া' থেকে আব্বুলিশ আসার সম্ভাবনা কম।
অতএব 'আবলাসা' শব্দটিকেই একটু 'কাল্টিভেট' করতে হবে।
বেশ মনে আছে, ছেলেবেলায় আব্বুলিশ কথাটি বলার সময় মুখে হাত চেপে বলতে হতো। চুপ করে যাওয়া বা কাউকে চুপ করানোর প্রিমিটিভ রীতিই তো মুখে হাত দিয়ে বলা। তাই 'আবলাসা' থেকেই বাংলায় 'আব্বুলিশ' হয়েছে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। চুপ করা, নিশ্চুপ হওয়া, নীরব হওয়ার ব্যাপারটিই তো আবলাসা'-র অন্তর্নিহিত অর্থ। আরবি থেকে কয়েক হাজার শব্দ বাংলায় এসেছে। অনেকগুলি অভিধানে স্বীকৃতি পেলেও, বেশ কিছু সম্ভাব্য শব্দ এখনও অভিধানভুক্ত হয়নি। 'আব্বুলিশ' দ্বিতীয় গোত্রের।
তা না হয় হলো, বাংলা কথ্যভাষায়, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে, আব্বুলিশ শব্দটির দেখা পাওয়া যায় কি? তা তো যায়ই। তবে মানে বুঝে লেখা না, না বুঝে লেখা, সেটাই বোঝা যায় না। এক লেখকের গল্পে আব্বুলিশ শব্দটির ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছে, তাঁর কাছে শব্দটির অর্থ একটি মন্ত্র বা রেটরিক, যথা, 'পুনর্মূষিকোভব'! অর্থাৎ আগের রূপে ফিরে যাওয়া। পূর্বাশ্রমের রূপে ফেরার এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল।
'আচাভুয়া' শব্দটির অর্থ না বুঝেই যেমন এর ব্যবহার করেন অনেকে, তেমনভাবে আব্বুলিশের ব্যবহার করেন ধ্বনিবৈচিত্র্য আনতে। শিলাজিতের একটি গানের অ্যালবামের নাম 'আব্বুলিশ'। গান শুনে বোঝার উপায় নেই, কেন তিনি অ্যালবামের নাম 'আব্বুলিশ' রেখেছেন! আসলে এও সেই শব্দের ফাঁদ। লোককে বিজাতীয় চটকদার শব্দের টানে গানের ঘূর্ণিপাকে জড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা!
'আব্বুলিশ' নামে একট শর্ট ফিল্মও দেখলাম আন্তর্জালে। স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে কলেজে পা দেওয়ার সন্ধিক্ষণের দিনগুলির কথা সুন্দরভাবে ধরা হয়েছে সিনেমাটিতে। একদল বন্ধু কীভাবে ঠিক করছে তাদের কেরিয়ারের অভিমুখ, তারই চলচ্চিত্রায়ন। এখানে আব্বুলিশ শব্দটির কিঞ্চিৎ তাৎপর্য থাকলেও থাকতে পারে। ছেলেবেলার লুকোচুরি খেলার দিনগুলিই যেন তারা ফেলে যাচ্ছে পেছনে। তাই আব্বুলিশ বলে তারা কৈশোেরের খেলা থামাচ্ছে।
একনজরে দেখলে আব্বুলিশ শব্দটি খেলা থেকে উঠে এসে সমাজজীবনেও আঁচড় কেটেছে। সাংবাদিকরাও তাঁদের প্রতিবেদনে 'আব্বুলিশ' শব্দটির ব্যবহার করেছেন। এক অগ্রগণ্য বাংলা সংবাপত্রের দু'বছর আগেকার একটি সংবাদের শিরোনাম দেখলাম, 'রাজধানী যখন জ্বলছে, পুলিশ তখন আব্বুলিশ!' নিচে একটি ছবি দেওয়া হয়েছে দিল্লির রাজপথের। তাতে যুধুধান দুই পক্ষের ছবি। ছবির ক্যাপশন, 'লাঠি-পাথর হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিক্ষোভকারীরা, পাশেই নীরব দর্শক পুলিশ'। শিরোনাম এবং ছবির ক্যাপশন দেখলে বোঝা যায় 'আব্বুলিশ' এখানে নীরব-অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। নীরব ও নিশ্চুপ একই অর্থ বহন করে। তাই খেলার আব্বুলিশ ও সংবাদ-প্রতিবেদনের আব্বুলিশ-এর যে একই মানে, সে-বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
আব্বুলিশ শব্দটি যে আরবি থেকে এসেছে, এটা মেনে নিতে কারও দ্বিধা থাকার কথা নয়। প্রায় দুশো বছরের ইংরেজ শাসনের আগে সাড়ে পাঁচশো বছরের (১২০৪-১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ) ইসলামি শাসনের প্রভাব বাংলা ভাষার মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে গেছে। হাজার হাজার আরবি-ফারসি শব্দ ঢুকে পড়েছে বাংলা ভাষায়। অভিধানের বাইরেও বহু আরবি-ফারসি শব্দ বাংলায় আমরা বলে থাকি, সেগুলির উৎস না জেনেই। 'আব্বুলিশ' যে আরবি 'আবলাসা' থেকে এসেছে, এটিও নিশ্চয় একদিন অভিধানে স্বীকৃতি পাবে।