মুড়িঘন্ট থেকে মাটন বিরিয়ানি! পুজোর এলাহি মেনু, 'অপরাধী'-রাও বাদ পড়েনি উৎসবের আনন্দে

Durgapuja 2022: প্রতিনিয়ত জেলেই আনন্দে মেতে উঠেছেন আবাসিকরা। মা দুর্গার আরাধনায় খামতি নেই ওঁদেরও।

বন্দি আমায় বন্দি কর, উৎসব-রোধে রোজ,
তবুও আমি হাঁটছি দেখ, খাচ্ছি পুজোর ভোজ!

বন্দি করলেই কি আর বন্ধ করা যায়! আটকে দিলেই কি আর আটক করা যায়! পুজো আর বন্দির ডায়েরিতে এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে কয়েক দিন আগে থেকেই। প্রত্যেক মুহূর্তে মুক্ত মানুষ না বন্দি মানুষ, কার আনন্দে চমক বেশি, এই আলোচনায় তীব্র হচ্ছে জনমানসে। কারণ, দিকে দিকে পুজো অর্থাৎ বাঙালির-বাংলার শ্রেষ্ঠ উৎসব এলেও পরিবর্তিত হয়েছে কুঠুরির সার্বিক পরিবেশ। ভালো কথায় সংশোধনাগারেও লেগেছে পুজোর পরশ। যদিও এই আমেজ, এই আনন্দ জেলে আজ বর্ষিত হচ্ছে না। এর রয়েছে পুরনো রেওয়াজও। অর্থাৎ, দশকের পর দশক ধরে পুজো হয়ে আসছে রাজ্যের একাধিক জেলে। প্রতিনিয়ত জেলেই আনন্দে মেতে উঠেছেন আবাসিকরা। কেউ দাগী অপরাধী, কেউ মুক্তসমাজের কাছে হয়তো খুনি। কিন্তু মা দুর্গার আরাধনায় খামতি নেই ওঁদেরও। যদিও রাজ্যের সব জেলা, সব জেলেই যে দুর্গা পূজা হয় এমন নয়! তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকে বিশেষ ভোজ এবং কোথাও কোথাও পুজোর ব্যবস্থা।

এই বিষয়ে কী বলছেন রাজ্যের কারামন্ত্রী অখিল গিরি? ইন্সক্রিপ্ট-কে মন্ত্রী জানান, "এবারই নতুন নয় রাজ্যের প্রায় সংশোধনাগারে দুর্গা পূজার রেওয়াজ রয়েছে। সমস্ত জায়গায় আবাসিকদের জন্য এই ব্যবস্থা করে রাজ্য সরকার।"

প্রসঙ্গত, এই পুজো-আবহ এবং আনন্দ উদযাপনের ভুরিভোজের ক্ষেত্র এবার একটু বেশিই চর্চিত। জেলের আবাসিকদের খাবার নিয়ে আলোচনা বেড়েছে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং তৃণমূল নেতা অনুব্রত মন্ডলের জেলযাপনে।

আরও পড়ুন: ঋতুমতী কন্যারা ব্রাত্য, কীভাবে নির্বাচন করা হয় কুমারী পুজোর বালিকাদের?

বিশেষ মেনু। বিশেষ খাবারের সংবাদে যোগ হয়েছে আলোচনা আর বিতর্কও। কিন্তু ঠিক কতটা সত্য এই প্রকাশিত খবর, খতিয়ে দেখছি আমরা। সত্যিই কি খবরে প্রকাশিত পুজোর মেনুর ব্যবস্থা রয়েছে? কী বলছেন রাজ্যের কারামন্ত্রী?

জানা গিয়েছে, প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আগমন ঘটার পর মেনুতে বদল হয়েছে সার্বিকভাবে। অর্থাৎ শুধুমাত্র নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত প্রাক্তন এই মন্ত্রীর জন্য আলাদা খাবারের ব্যবস্থা, ব্যাপারটা সেই ভাবনা থেকে করা হয়েছে, এমন মানছেন না ওই সংশোধনাগারের আধিকারিকদের একাংশ। তাঁরা কেউ কেউ বলছেন, বরাবর নানা শারীরিক সমস্যায় রয়েছেন তৃণমূল নেতা পার্থ। ঠিক সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে অন্যান্য আবাসিকদের জন্য বরাদ্দ খাবারের সঙ্গে পার্থর খাদ্যাভাস মেনে চেষ্টা করা হয় তাঁকে খাবার দেওয়ার। খেয়াল রাখা হয়, তাঁর ওজনজনিত সমস্যার দিকেও। ঠিক এই অবস্থাতেই পুজোর মেনুতে এসেছে বিশেষত্ব। জেল সূত্রে খবর, সেটা শুধুমাত্র পার্থ চট্টোপাধ্যায় নন, প্রেসিডেন্সি জেলের অন্যান্য আবাসিকের জন্যেও। আবার রাজ্যের একাধিক জেলের হাজার হাজার আবাসিক, শুধুমাত্র কলকাতার সংশোধনাগারের প্রায় ২৫০০ বন্দির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য এই ভোজের মেনু।

আসলে কী কী ব্যবস্থা ছিল বা থাকছে প্রেসিডেন্সি জেলে? কারা মন্ত্রী অখিল গিরি জানালেন বিস্তারিত। মন্ত্রী বললেন, "প্রেসিডেন্সি জেল শুধু নয় রাজ্যের সব জেলেই বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা থাকছে। সপ্তমীর দিনও ছিল বিশেষ ব্যবস্থা। প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে কী কী ব্যবস্থা থাকছে তাঁর নির্দিষ্ট তালিকা অন্য সব জায়গার মতোই আছে। যেমন আজই অর্থাৎ অষ্টমীর সকালে লুচি, তরকারি, মিষ্টি ছিল। দুপুরে খিচুড়ি, পাঁচমেশালি তরকারি। নবমীর দিন সকালে লুচি, তরকারি, দুপুরে ভাত, ডাল, ডিম। রাতে মাটন বিরিয়ানি, মাটন কষা। দশমীতে সকালে লুচি, তরকারি, দুপুরে ভাত, মাছ, ডাল। রাতে ফ্রায়েড রাইস, চিকেন, মিষ্টি।''

অর্থাৎ, পার্থ চট্টোপাধ্যায় আছেন বলে বেশি বেশি ব্যবস্থা নয়? মন্ত্রী অখিল গিরি খোলসা করলেন ইন্সক্রিপ্ট-কে। তিনি জানান, "নাহ্! এরকম কোনও বিষয় নেই। প্রতি বছর একইভাবে আয়োজন করা হয় বিশেষ খাবারের। সবার জন্যই সমান ব্যবস্থা। শুধুমাত্র অঞ্চল ভেদে, সংশোধনাগার কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে কী কী হবে।''

যদিও এর আগেই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এলাহি ভোজের কথা। ভোজের মেনুতে খুব একটা হেরফের না না হলেও পার্থ আছেন বলেই এই আয়োজন বলা হয় এমনও। কিন্তু মন্ত্রী অখিল বললেন অন্য কথায়।

কী বলা হয়েছিল পার্থর জেলের মেনু নিয়ে। ষষ্ঠীর দিন যেমন তেমন কেটে গেলেও সপ্তমীতে ছিল; ভাত, মুড়িঘন্ট, ভাজা, কাতলা মাছ, ডিম তড়কা, পায়েস।

অষ্টমী-মেনুতে থাকার কথা; লুচি, কাবলিছোলা। আর দুপুরে খিচুড়ি, নবরত্ন, পনির, মিষ্টি।

নবমী। সেদিন ছিল মহাভোজের আয়োজন। সকালে চিড়ের পোলাও, ডিমের তরকারি। তারপরেই থাকছে মাটন বিরিয়ানি, খাসির মাংস, মিষ্টি।

দশমীর পাতে পড়বে, ফ্রায়েড রাইস, রুই মাছের একটি পদ, ডাল, আলুর দম। সঙ্গে চাটনি পাঁপড়।

অনেকের দাবি, এই মহাভোজে নাকি প্রভাব রয়েছে পার্থর। যিনি জেলে বসেই ১০ মিনিট ঢাক বাজিয়েছেন বলেই খবর। ষষ্ঠীর দিন জেলেই অন্য মেজাজে দেখা গিয়েছে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে।

এদিকে ষষ্ঠীতে নর্মাল-ভোজ হলেও সপ্তমী পড়তেই বিরাট আয়োজন নাকি আসানসোল জেলেও। কারণ, সেখানে রয়েছেন অনুব্রত মণ্ডল। বীরভূমের বেতাজ বাদশার জন্য সপ্তমীতে ছিল, ভাত, মুগের ডাল, পুকুরের কাতলা, মিষ্টি।

অষ্টমীতে খিচুড়ি, পাঁচ মেশালি তরকারি, মিষ্টির পদ।

নবমী পড়তেই ফ্রায়েড রাইস বা পোলাও সঙ্গে দেশি মুরগির মাংস, মিষ্টি, দই রাখা হতে পারে কেষ্টর মেনুতে। খাসির মাংস বন্ধ তাঁর খাওয়া। পায়ুদ্বারে ফিশ্চুলার সমস্যায় ইতিমধ্যেই চিকিৎসা চলছে বীরভূমের তৃণমূল সভাপতির। যদিও আসানসোল জেলে নাকি পুকুরের কাতলা রান্নার চল এসেছে অনুব্রতর আবদারের পর। একদা 'তিন কিলো পাঁঠার মাংস' খেতে পারা মমতার কেষ্ট নাকি একদম পছন্দ করেন না বাসি কাতলা! তাঁর আবদারের জন্যই নাকি পুকুর থেকে কাতলা আসে জেলেও!

অর্থাৎ পুজো এলেই সেই উপলক্ষ্যে ভালো খাবারের এই রীতি পালন করা হয়, আবাসিকদের ভালো রাখতে। কেন? মনোবিদেরা বলছেন, যাঁরা প্রত্যেক মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে রয়েছেন। প্রিয়জন ছাড়া রয়েছেন। দিনের পর দিন একাকি। চেষ্টা করেও অপরাধের কারণে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এসব কারণ তো রয়েছেই। তার সঙ্গেই রয়েছে, সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্যতা নষ্টের কারণ। যা সামগ্রিকভাবে মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত করছে তাঁদের। ঠিক এই প্রেক্ষাপটে একটু ভালো রাখার তাগিদে আবাসিকদের জন্য পুজো বা সেই অনুষ্ঠানে ভালো খাবারের বন্দোবস্ত করা প্রয়োজনীয়। সঙ্গে সারা বছর মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়াও দরকার।

আর এই পরিস্থিতিতেই জেল সূত্রের দাবি, একটা রোজকার কাজের মধ্যেই উৎসবে বিশেষ ভোজের আয়োজন।

এক সর্বভারতীয় ইংরেজি সংবাদমাধ্যমে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় কলকাতার এক জেল আধিকারিক জানান, "এবার কোনও বিশেষ ব্যবস্থা নয়, প্রাক্তন মন্ত্রী এখানে বিশেষ কিছু নন, আমরা সমস্ত বড় উৎসবে এই বিশেষ খাওয়ার ব্যবস্থা করি। এবার প্রায় ২৫০০ আবাসিকের জন্য বিরিয়ানি, পনির, রসগোল্লা-সহ নানান ভোজ থাকছে।''

এদিকে থেমে নেই আলিপুর মহিলা সংশোধনাগারও। যেখানে রয়েছেন পার্থর বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। পুজো হচ্ছে সেখানেও। ছোট্ট গ্রামের আদলে যেন এক টুকরো বসতির মাঝে বাস করছেন দুর্গা। সেখানে খাবারের আয়োজনে রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। সপ্তমীতে মাছ। অষ্টমীর দিন লুচি, খিচুড়ি। নবমীতে বিরিয়ানি, মাংস। দশমীতে মাছ মিষ্টি অ্যান্ড মোর... কী নেই সেখানেও।

এদিকে পিছিয়ে নেই দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারও। সেখানকার আবাসিকদের জন্য পুজোর পাশাপাশি রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ছোট করে অনুষ্ঠান আর এলাহি ভোজের আয়োজন। সপ্তমী ছাড়িয়ে অষ্টমীতে সেই খিচুড়ি, পাঁচমেশালি তরকারি। নবমীতে মাংস, দশমীতে মাছ, মিষ্টি। জেলার জেলও নেই পিছিয়ে। সব ক্ষেত্রে পুজো না হলেও খাওয়ার ক্ষেত্রে কার্পণ্য রাখেননি জেল কর্তৃপক্ষ।

উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট সংশোধনাগারে রয়েছে ভুরিভোজের বিশেষ ব্যবস্থা। আবাসিকদের জন্য নবমীতে বিরিয়ানি অথবা মাংসের ব্যবস্থা সেখানেও। একই জেলার বারাসতের কিশলয় হোম। জেল বা সংশোধনাগার না হলেও এই হোমে বাস অপ্রাপ্তবয়স্কদের। সেই আবাসিকদের জন্য পুজো থেকে শুরু করে ভুরিভোজের বিশেষ ব্যবস্থা। বাদ যাচ্ছে না কিছুই। পুজোর ক'দিন বেশ অন্য ভাবেই কাটাচ্ছে ওঁরা। এমনকি আশপাশের পুজোয় তাঁদের নিয়েও যেতে পারেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।

আসলে পুজো আর উৎসবের অমলিন আবহে খুব একটা খারাপ বন্দোবস্ত নেই তথাকথিত বন্দিদের পাঠশালায়। সেখানে কোথাও কোথাও শাসনের সঙ্গেই চলছে পুজো। আর পুজোর সঙ্গেই একটু ভালো খাওয়ার ব্যবস্থাও। ঢাক বাজানো থেকে পুজোর যাবতীয় কাজ, সবেতেই মুখ্য ভূমিকা সেই আবাসিকদের। যাঁরা সামাজিকভাবে ভিন্ন, খানিকটা বিচ্ছিন্ন। খানিকটা আলাদাই বটে!

"আমরা অনেকের চোখেই হয়তো অপরাধী, আমাদের সম্মান নেই, আমরা ভিন গ্রহের। একবার অপরাধ করেছি বলে আবার করব। ভালো মানুষ নই। এমন সকলে ভাবলেও পুজোয় আবার অপরাধ কী! মা তো সবার তাই না?" বলছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রেসিডেন্সি জেলে প্রায় ৭ বছর কাটিয়ে আসা এক প্রাক্তন আবাসিক।

আর এই আর্তনাদই যেন বলে দেয়, অপরাধীর পুজো হয়, আনন্দের অধিকার আছে ওঁরও। অপরাধীকেও বাঁচতে দিন, ওঁকে ভালো হওয়ার একটি সুযোগ দিন! পুজোয় আবার মাততে দিন। ভুরি ভোজেই থাকতে দিন। অপরাধীকে বেঁচে থাকতে দিন, আমরা নই যেন বলে যায় মুক্তধারার সেই নাইজেল, অলকানন্দারা।

More Articles