ঋতুমতী কন্যারা ব্রাত্য, কীভাবে নির্বাচন করা হয় কুমারী পুজোর বালিকাদের?
Mahashtami Kumari Puja: যে সংস্কৃতিতে হাজার বছর ধরে একটি মেয়ের সম্মান নির্ধারণ করা হয় ‘কুমারীত্ব’ আর ‘পুত্রসন্তান উৎপাদনের’ মাধ্যমে, সে সংস্কৃতি নিয়ে প্রশ্ন থাকেই।
দুর্গাপুজোর অষ্টমী তিথিতে কুমারী পুজোর চল বহুদিনের। বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দের হাত ধরে কুমারী পুজো শুরু হওয়ারও অনেক আগে থেকে অখণ্ড বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কুমারী পুজোর প্রচলন ছিল। প্রধানত দুর্গাপুজোর সময়েই কুমারী পুজোর চল থাকলেও অন্যান্য মাতৃ আরাধনা যেমন কালীপুজো বা জগদ্ধাত্রী পুজোতেও কুমারী পুজোর চল ছিল। শাস্ত্র ও পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে কোলাসুর দমনের মধ্যে দিয়েই কুমারী পুজোর প্রচলন হয়। পুরাণ মতে, কোলাসুর স্বর্গ, মর্ত্য অধিকার করায় দেব দেবীরা খুবই বিচলিত হয়ে মহাকালীর শরণাপন্ন হন। দেবকুলের এহেন বিপদ দেখে দেবী পুনর্জন্ম গ্রহণ করেন এবং মর্ত্যে গিয়ে কোলাসুরকে বধ করেন। তারপর থেকেই কুমারী পুজো শুরু হয়।
কুমারী পুজো মূলত তান্ত্রিক সাধনার ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। প্রবীণ শাস্ত্রবিদদের মতে, দেবী দুর্গা স্বয়ং সম্পূর্ণা। বৃহদ্ধর্ম পুরাণ মতে, "কন্যা রূপেন দেবানামগ্রত দর্শনং দদৌ"- এর অর্থ হল দেবী চণ্ডী কুমারী রূপেই দেবতাকুলের সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন। দেবী ভগবতে কুমারী পুজো সম্পর্কে বলা হয়েছে, এক বছরের কন্যা কুমারী পুজোর যোগ্য নয়। তারপরে দুই থেকে দশ বছর পর্যন্ত বালিকাদের কুমারী রূপে পুজো করা যাবে। কুমারী যদি পুজোয় সন্তুষ্ট হন তাহলে সাধকদের ইচ্ছে পূরণ করেন। বয়স অনুযায়ী কুমারীদের নামকরণও আলাদা হয়। দুই বছরের কুমারীর নাম হয় কুমারিকা, তিন বছরের কুমারীর নাম হয় ত্রিমূর্তি, চার বছরে কুমারী মেয়ের নাম হয় কল্যাণী, পাঁচ বছরের কুমারী মেয়ের নাম হয় রোহিণী, ছয় বছরের কুমারী মেয়ের নাম হয় কালিকা, সাত বছরের মেয়ের নাম হয় চণ্ডিকা, আট বছরের কুমারী মেয়ের ক্ষেত্রে নাম হয় সুভদ্রা। আলাদা আলাদা বয়সের কুমারীদের পুজো করলে শাস্ত্র অনুযায়ী ফলও পৃথক হয়।
আরও পড়ুন- মুসলিম কন্যাকে কুমারী রূপে পুজো করেছিলেন বিবেকানন্দ, কীভাবে বাংলায় শুরু হল কুমারী পুজো
দু’বছরের কুমারীর পুজো করলে দুঃখ কষ্ট ও শত্রুনাশ এবং আয়ু বৃদ্ধি পায়। ধনসম্পদ, ধানের ফলন, ও বংশবৃদ্ধি হয়। কল্যাণীর পুজো বিদ্বান, সুখী এবং বিজয়ী করে। রোহিণীর পুজোয় ধনেশ্বর্য লাভ হয় সাধকের। অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য সুভদ্রার পূজা করতে বলা হয়। আবার অন্য একটি সূত্র বলছে, তন্ত্র শাস্ত্র মতে কুমারী পুজোর ক্ষেত্রে কন্যার বয়স এক থেকে ষোলোর মধ্যে হতে পারে। কিন্তু সনাতন শাস্ত্র অনুযায়ী দশ বছরের কন্যাই কুমারী হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে যোগ্য দাবিদার। তবে কুমারীর মধ্যে থাকতে হবে বিশেষ কয়েকটি গুণ। কুমারীকে হতে হবে সুন্দর, সুলক্ষণ ও শোভন।
আবার যামলতন্ত্র অনুযায়ী, এক বছরের কুমারী কন্যার নাম হবে সন্ধ্যা, দুই বছরের কুমারীর নাম হবে সরস্বতী, তিন বছরের কন্যার নাম হবে ত্রিধামূর্তি, চার বছরের কুমারী কন্যার নাম হবে কালিকা, পাঁচ বছরের সুভাগা, ছয় বছরের ক্ষেত্রে উমা, সাত বছরের ক্ষেত্রে কুজিকা, নয় বছরের কন্যার ক্ষেত্রে কালসঙ্কটা এবং দশ বছরের ক্ষেত্রে কুমারী মেয়ের নামকরণ হবে অপরাজিতা। এগারো বছরের ক্ষেত্রে কন্যার নাম হবে রুদ্রাণী, বারো বছরের ক্ষেত্রে ভৈরবী এবং ত্রয়োদশ বছরের ক্ষেত্রে কন্যার নাম হবে মহালক্ষ্মী। তবে শাস্ত্রে এও বলা রয়েছে, এদের সকলের মধ্যে উমা, মালিনী ও কূজিকার পুজো করলেই ভালো ফল লাভ করা সম্ভব।
আরও পড়ুন- মুম্বইয়ের রঙ কোম্পানি বদলে দিল বাংলার দুর্গাপুজো! কীভাবে শুরু হল থিমের পুজো?
তন্ত্রে বা শাস্ত্রে যে কোনও বর্ণ ও জাতির কুমারীকে দেবী জ্ঞানে পুজোর কথা বলা হলেও বাস্তবে চিত্রটা অন্য রকম। যে সব স্থানে কুমারী পুজো হয় তার প্রায় সর্বত্রই ব্রাক্ষণ কন্যাকে কুমারী হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। এখানেই কাজ করে আমাদের সমাজের ভিতরে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা ব্রাহ্মণ্যবাদ। আমরা আসলেই যে অবচেতনে বর্ণাশ্রমের ঘা মাথায় বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি এই বিশেষ অনুষ্ঠান এলেই তা আরও অনেক বেশি প্রকট হয়ে পড়ে।
যে সংস্কৃতিতে হাজার বছর ধরে একটি মেয়ের সম্মান নির্ধারণ করা হয় ‘কুমারীত্ব’ আর ‘পুত্রসন্তান উৎপাদনের’ মাধ্যমে, সে সংস্কৃতি নিয়ে প্রশ্ন থাকেই। কুমারী পুজোর ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হল 'অ-রজঃস্বলা কন্যা'। পিরিয়ড হয়ে গেলে বা কন্যা ঋতুমতী হলে সে পুজো পাবে না। পিরিয়ড হওয়ার সঙ্গে কুমারীত্বকে সমান্তরালে রাখার যে ভয়াবহ প্রবণতা তা সামাজিক অসচেতনতাকেই বাড়িয়ে তোলে। পিরিয়ড হয়ে গেলেই কুমারীর পুজো বন্ধ, কারণ পুজো পবিত্র বিষয় আর ঋতুস্রাব হয়ে গেলেই মেয়ের শুচিতা নষ্ট— এই ধারণার উপরই দাঁড়িয়ে আছে সম্পূর্ণ বিষয়টি। খুব সহজেই অনুমেয় যে, একটি প্রথা যখন বহুকাল ধরে চলতে থাকে,তার ওপর প্রশ্ন তুলতে মানুষ ভুলেই যায়।
"কত শতবর্ষ ধরে যে প্রাচীন প্রথা দেবতা চরণতলে বৃদ্ধ হয়ে এল সে কি পাপ হতে পারে?"— এই প্রশ্নই বারংবার যুক্তির পথ রোধ করে দাঁড়ায় আবার ধীরে ধীরে সেই বাধা পেরিয়েই যুক্তির জয়গাথা রচিত হয়।