হিংসাই শেষ কথা নয়! স্বাধীনতার ইতিহাসকে অন্য চোখে দেখাবে 'দিল্লি চলো'

Theatre Review: 'নাট‍্য আনন'-এর 'দিল্লি চলো' প্রসঙ্গে কী বলছেন অভিনেতা ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়?

'শ্রীমদ্ভগবদগীতা'-য় কৃষ্ণর প্রবচন ছিল, “অহিংসা পরম ধর্ম, ধর্মহিংসা তদৈব চ”। ভারত কিছু বছর আগে পর্যন্ত শ্লোকের প্রথম অংশের ওপর বেশি গুরুত্ব দিলেও সাম্প্রতিক অতীতে ভারতের রাজনীতি ও সমাজনীতি শ্লোকের দ্বিতীয় অংশকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়।

কিন্তু ধর্মহিংসা বা হিংসার ধর্ম, এই বিতর্কিত বিষয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই ভাবতে ক্ষেত্রে ‘ধর্ম' টা কিন্তু খুব গোলমেলে। ধর্ম মানেই তা সরাসরি ধর্মীয় বা 'Religious' না-ও হতে পারে। মানুষের নিজের কাজও ধর্ম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যদি তার সঙ্গে হিংসা জড়িয়ে থাকে, তবে উক্ত শ্লোকের কোন অংশটি বেছে নিতে হবে? হিংসা আর অহিংসার এই ভেদরেখাটা কি অনন্তকাল ধরে খুবই সূক্ষ্ম ও আবছা একটি পর্দার আড়ালে রয়েছে?

খুব প্রকটভাবে না হলেও, প্রচ্ছন্নভাবে উৎপল দত্তর ‘দিল্লি চলো’ নাটকের বিভিন্ন পরতে পরতে মিশে আছে এই প্রশ্নগুলিই। সম্প্রতি 'অশোকনগর নাট্য আনন' চন্দন সেনের নির্দেশনায় এই নাটকের সফল মঞ্চায়ন ঘটিয়েছে। নাটকটি দেখার পর তার মূল বক্তব্যর ও প্রোপাগান্ডার জায়গাটি তো বটেই, তার সঙ্গে বারবার ভাবাতে পারে এই প্রচ্ছন্ন প্রশ্নগুলিও।

আরও পড়ুন: অতিমারীর পরেও প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ! বাংলা থিয়েটারে ‘স্টার’ নয়, ‘কনটেন্ট’-ই আসল রাজা

সাম্প্রতিক বাংলা থিয়েটারের মঞ্চে বারবার প্রাসঙ্গিকতার সঙ্গে ফিরে এসেছেন উৎপল দত্ত। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ‘তিতুমীর’, ‘ব্যারিকেড’ ও আরও বিভিন্ন নাটক ক্রমাগত মঞ্চস্থ হওয়া। তবে ‘দিল্লি চলো’ সেই বৃত্তের মধ্যে থেকেও স্বতন্ত্রভাবে কিছুটা ভিন্ন। ভিন্ন এর নির্মাণে, ভিন্ন এর বিষয় উপস্থাপনায়, ভিন্ন এর আখ্যানে।

Utpal Dutta

উৎপল দত্ত

'নাট্য আনন'-এর এই প্রযোজনার বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। যার মধ্যে অবশ্যই থাকবে আর্থার বেনানের চরিত্রে চন্দন সেনের মঞ্চে বাঘের মতো বিচরণ ও প্রদ্যুৎ মজুমদারের চরিত্রে শাক্য রায়ের শিকারীর মতো ক্ষিপ্রতা। তবে এই নাটকের দু'টি চরিত্র ও নাটকে তাঁদের অভিঘাত নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন বলে মনে হয়। একটি চরিত্র স্বামী সর্বানন্দ (পঞ্চানন বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়) ও দ্বিতীয়টি আজিজুল হক (ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়)।

জব্বর প্যাটেলের ‘ইন্ডিয়ান থিয়েটার’ তথ‍্যচিত্রে এবং নিজের কথায় ও লেখায় উৎপল দত্ত বারবার উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, তিনি একজন প্রোপাগান্ডিস। সেই প্রোপাগান্ডা ‘দিল্লি চলো’-তেও সমানভাবে আছে, বরং বেশি করেই আছে। কারণ এটি সাধারণ মঞ্চনাটক হিসেবে তিনি রচনা করেননি, রচনা করেছিলেন যাত্রা হিসেবে। সেখানে বক্তব‍্য কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই ‘আন্ডারলাইন’ করা, বেশ কিছুটা প্রকট। নাটকের ঘটনাপ্রবাহ নিজস্ব গতিতেই চলে। উল্লেখ্য যা, শেষ দৃশ্যে একটা স্লোগানধর্মী বক্তব্য পাওয়া যায়, যার সার হলো, ‘সশস্ত্র গেরিলা আন্দোলন ছাড়া মুক্তি নেই’। উৎপল দত্ত বারবার জোর দিয়েছেন 'লার্জার দ‍্যান লাইফ'-এর ধারণায়। তার সঙ্গেই মিশেছে তাঁর রাজনৈতিক চেতনা। কিন্তু শুধুই তা নয়, এই নাটকের একটি অংশে আছে স্ববিরোধ, একটা যৌক্তিক ফাঁক, যে ফাঁক বা স্ববিরোধ সম্পাদক ও নির্দেশক চন্দন সেন সচেতনভাবে রেখে দিয়েছেন প্রযোজনাতেও।

নাটকে আজাদ হিন্দ ফৌজের কিছু গেরিলা এক বিশেষ কাজে এসে স্বামী সর্বানন্দর দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। স্বামী সর্বানন্দ একসময় সশস্ত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তিনি এক সময় বুঝতে পারেন হিংসা দিয়ে কিছুই লাভ করা যায় না। স্বামীজি বলেন, হিংসায় হিংসার জন্ম দেয়, যে একদিন তলোয়ার ধরে, একদিন সেই তলোয়ারই তাকে আঘাত দেয়। এই বাধা পেয়ে বৃহত্তর প্রেক্ষিতে সফল হওয়ার জন্য গেরিলারা স্বামীজিকে হত্যা করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই ঘটনা দেখে গেরিলা আজিজুল হক প্রচণ্ড আঘাত পায় ও ব্রেন ফিভারে আক্রান্ত হয়। সে জনসমক্ষে, এমনকী, ইংরেজ সেনানায়কের সামনেও স্বামী সর্বানন্দর খুন ও হিংসার দ্বারা হিংসার জন্ম হওয়ার কথা বলতে থাকে। একসময় তার কীর্তিতে নাজেহাল তার সঙ্গী গেরিলাদের হাতেই আজিজুলের মৃত্যু হয়। এখন প্রশ্ন, নাটকের মূল সুর যদি সশস্ত্র গেরিলার মাধ্যমে মুক্তির কথাই হয়, তাহলে আজিজুল চরিত্রটির তাৎপর্য বা প্রয়োজনীয়তা কোথায় এই নাটকে?

এই বিষয় নিয়ে নাটকের আজিজুল, অভিনেতা ঋতব্রত মুখোপাধ্যায় কী বলছেন?

ঋতব্রতর বক্তব্য, "প্রথমত এইরকম মানসিক দুর্বলতা যার, তাকে এইরকম একটা প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ গেরিলা অপারেশনে কেন পাঠানো হলো, সে সম্পর্কে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। এবার যদি ধরেও নিই আজিজুল কোনও এক বিশেষ কাজে (ডিনামাইট সেট করা) অত্যন্ত দক্ষ, তাই তাকে নেওয়া হয়েছে, তাহলেও প্রশ্ন থাকে যে, যুদ্ধের যাত্রাপথে সে কি কোনও মৃত্যু দেখেনি? অবশ্যই দেখেছে। তাহলে স্বামী সর্বানন্দর মৃত্যুতে আজিজুলের এরকম প্রতিক্রিয়া কেন? এইখানেই উৎপল দত্ত theatrical license ব্যবহার করেছিলেন। নাটকটির কাহিনিসূত্র মোহাম্মদ জামান কিয়ানির (যে চরিত্রটি নাটকেও আছে) একটি বই থেকে নেওয়া হলেও নাটকটির আখ্যান সম্পূর্ণরূপে উৎপল দত্তর মস্তিস্কপ্রসূত। এইটা ধরে নেওয়া যায়, নাটকের এই স্ববিরোধের মধ্য দিয়ে এবং এই দু'টি চরিত্রের মধ্যে দিয়ে উৎপলবাবু বোঝাতে চেয়েছিলেন, সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতা এলেও কোনও একটি বিন্দুতে গিয়ে হিংসা থামাতে হয়। এই অবস্থানটিই নাটকের এই অংশে চিহ্নিত করেছিলেন উৎপলবাবু।"

গত কিছু মাস ধরে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি নিয়ে যে উগ্র ‘মহোৎসব’ চলছে, সেই প্রবাহে গা না ভাসিয়ে 'নাট্য আনন' দেশকে যে প্রণাম জানাল এই নাটকের মাধ্যমে, তা যেমন যথাযথ, তেমনই অর্থবহও। যে নাটকের প্রেক্ষাপট স্বাধীনতা-পূর্ব ভারত, রচনাকাল আনুমানিক সাতের দশক, সেই নাটক আজও কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক- তা প্রতি মুহূর্তে বোঝায় ‘দিল্লি চলো’ নাট্য প্রযোজনা।

আজ 'অ্যাকাডেমি'-তে সন্ধে সাড়ে ৬টায় রয়েছে এই প্রযোজনা

More Articles