অতিমারীর পরেও প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ! বাংলা থিয়েটারে 'স্টার' নয়, 'কনটেন্ট'-ই আসল রাজা
ঋদ্ধি সেন বলছেন, "প্রথমত, মানুষ বাংলা থিয়েটার দেখে না, এই কথাটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। অতিমারীর পরবর্তীকালে অন্যান্য শিল্পমাধ্যম (মূলত সিনেমা) একটা সংকটের মুখোমুখি, মানুষ হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে চাইছে না, বা দ্বিধা করছে।"
বাংলা থিয়েটার অনেকটা ঈশ্বরগুপ্তর কবিতার মতো, বা নতুন প্রকাশ পাওয়া লিটল ম্যাগাজিনের মতো, বা মোবাইলের ব্লু-টুথ ডিভাইসের মতো, বা কফিহাউজের ‘নো স্মোকিং’ বোর্ডটার মতো। আছে, সবাই জানে, কিন্তু কেউ পাত্তা দেয় না, কেউ দেখতে যায় না।
বাংলা থিয়েটার সম্পর্কে মানুষের সাধারণ ধারণাটা অনেকটা এইরকমই। পেশাদারি থিয়েটার অবলুপ্তির পর বাংলায় যে চর্চা গত সাড়ে তিন দশক ধরে হয়ে চলেছে ('বহুরূপী' থেকে ধরলে সাত দশক), তাকে কোনও এক বিশেষ (ও অজ্ঞাত) কারণে 'গ্ৰুপ থিয়েটার' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গ্রুপ থিয়েটারের মূল পরিপোষক সরকারি গ্রান্ট আর এতে থিয়েটারের থেকেও প্রধান কাজ ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান' করে তার ছবি তোলা। এই বিশেষ প্রকার শিল্পমাধ্যমের শিল্পগত মানের অবনমনের কারণেই দর্শকদের মধ্যে এইরকম বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে।
অভিনয় ভালো হোক বা না হোক, নির্মাণশৈলীতে অভিনবত্ব থাকুক বা না থাকুক, দর্শক দেখুক বা না দেখুক, ঠিক সময় ডকুমেন্টেশন করে দিল্লিতে পাঠিয়ে স্যালারি গ্র্যান্টের টাকাটা বের করা এই থিয়েটারের প্রধান লক্ষ্য। তারপর কাঁধে ঝোলাব্যাগ ঝুলিয়ে ‘সমাজের জন্য থিয়েটার, বোধের জন্য থিয়েটার’ ইত্যাদি বুলি আওড়ানোই নাট্যজীবিদের প্রধানতম কাজ।
আরও পড়ুন: ‘হ্যামলেট’-এর মতোই আমরা প্রত্যেকে চাইছি প্রতিশোধ: কৌশিক সেন
কিছুদিনের আগে জয়রাজ ভট্টাচার্য একটি সেমিনারে প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, থিয়েটার সরকারি অনুদানে পুষ্ট, যে থিয়েটারকে প্রায় সরকার কিনে রেখে দিয়েছে বলা যায়, সেই থিয়েটার কী করে সরকারের নীতির বিরোধিতা করবে বা anti establishment-এর কথা বলবে বলে মনে করা যায়? সত্যিই মনে করা যায় না। তাই গুণগত চর্চা আর নৈতিকতা, দু'টি দিক থেকেই ক্ষয়ে যেতে যেতে বাংলা থিয়েটারের আজ এইরকম অবস্থা বলে আপাতভাবে মনে করা যায়। এরপরেও যখন কোনও বিদগ্ধ প্রবীণ অভিনেতা আক্ষেপ করে বলেন - "নতুন জেনারেশন এখন কেবল মাল্টিপ্লেক্সে যায়, থিয়েটার আর কেউ দেখে না", তখন তার দায় কেবলমাত্র দর্শকদের হয় না, নির্মাতাদেরও হয়, এটা মনে রাখা দরকার।
তবে এখানে একটা 'কিন্তু' থেকে যায়, এতক্ষণ যে আলোচনা হলো, তা একটি দিকের। অন্যদিকের চিত্রটি কিন্তু অনেকটাই আলাদা।
দর্শক বা মূলত নতুন প্রজন্ম থিয়েটার দেখে না, এই ধারণা সম্পূর্ণ সত্যি নয়। কোভিড-উত্তরকালে, ২০২২ সালের কলকাতায় দাঁড়িয়ে তো নয়ই। ২০২২-এর সবথেকে সত্যি কথাটি হলো, 'Content isn't king, it's the kingdom', আর থিয়েটারের ক্ষেত্রে যদি তার সঙ্গে নির্মাণ আর অভিনয়ের শ্রেষ্ঠত্ব যুক্ত হয়, তাহলে তা অপ্রতিরোধ্য হতে বাধ্য।
গত মে মাসে প্রথম মঞ্চস্থ হয় 'স্বপ্নসন্ধানী'-র নতুন নাটক ‘হ্যামলেট’। বিগত বেশ কিছু বছরে বাংলায় কোনও নাটক এতটা সাড়া ফেলেছে বলে মনে হয় না। আপাতভাবে চেনা কনটেন্টকে নতুন মাত্রায় উপস্থাপনা, চমকপ্রদ ফর্ম (গিমিকপূর্ণ নয় কিন্তু), অনন্য অভিনয়রীতি যে একটা নাটককে কোন মাত্রায় নিয়ে যেতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ‘হ্যামলেট’। সত্যি বলতে, এই নাটক মূলত বাংলা ভাষায় হলেও এটি একটি আন্তর্জাতিক মানের থিয়েটারের দাবিদার। বাংলা থিয়েটারের এই তথাকথিত আকালের দিনে যে নাটক নতুন করে অক্সিজেনের সঞ্চার করছে, তার এই ব্যাপক সাফল্যের খতিয়ান জানতে যোগাযোগ করা হয় নাটকের যুবরাজ 'হ্যামলেট'-এর অভিনেতা ঋদ্ধি সেনের সঙ্গে (যাঁর অভিনয়ও এই নাটকে সন্দেহাতীতভাবে প্রশংসিত)।
আরও পড়ুন: আর কতদিন সরকারের তৈরি করা ভেলকি আর ভয়ের ফাঁদে পা দেব আমরা: ঋদ্ধি সেন
ঋদ্ধি এই প্রসঙ্গকে দু'টি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পর্যালোচনা করেন। ঋদ্ধি বলছেন, "প্রথমত, মানুষ বাংলা থিয়েটার দেখে না, এই কথাটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। অতিমারীর পরবর্তীকালে অন্যান্য শিল্পমাধ্যম (মূলত সিনেমা) একটা সংকটের মুখোমুখি, মানুষ হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে চাইছে না, বা দ্বিধা করছে। তারা ভাবছে, কিছুদিনের মধ্যে বাড়িতে অনলাইনে দেখতে পাওয়া যাবে, এই 'অনলাইন' মাধ্যমটার সঙ্গে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই অনলাইনের জঙ্গলের মধ্যে থিয়েটার মানুষকে একটা রিফ্রেশিং জায়গা দিয়েছে, কারণ থিয়েটারের তো লাইভ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। থিয়েটার দেখতে গেলে হলে এসে দেখতে হবে, এটা থিয়েটারের একটা বড় জোরের জায়গা, অন্য কোনওভাবে থিয়েটার দেখা সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন বাড়িতে বন্দি থাকার পর, প্রাক-কোভিডকালে মানুষ যেমন ছ’টা-সাড়ে ছ’টার সময় থিয়েটার দেখতে আসত, সেই অভ্যেসটায় ফিরে যেতে চাইছে। তার রেজাল্ট যে এতটা হবে সত্যি ভাবা যায়নি। 'স্বপ্নসন্ধানী' মাঝে অনেকদিন জ্ঞান মঞ্চে অভিনয় করত, আবার বহুদিন পর সরকারি মঞ্চে ফিরেছে 'স্বপ্নসন্ধানী', গিরিশ-মধুসূদন-অ্যাকাডেমি মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত ৬টি শো হয়েছে, (যার মধ্যে দু'টি আমন্ত্রিত), যে ছ-টি’ই হাউজফুল শো। মধুসূদন মঞ্চে উইক ডে, বৃহস্পতিবার শো করার পরেও প্রায় ১১০০ ক্যাপাসিটির অডিটোরিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ ছিল, অ্যাকাডেমিতে মর্নিং শো-তেও হাউজ ফুল ছিল। হ্যামলেটের হাত ধরে একটি নতুন জিনিস ঘটেছে, নতুন জেনারেশন, যারা থিয়েটার দেখে না বলে একটা অপবাদ ছিল, তারাও প্রচুর পরিমানে হ্যামলেট দেখতে এসেছে। এমনও অনেকে এসেছে, যারা জীবনে প্রথমবার থিয়েটার দেখছে, এবং সেটা ‘হ্যামলেট’।"
সঙ্গে ঋদ্ধি দ্বিতীয় একটি আঙ্গিক জুড়ছেন, "একটা তর্ক আছে যে, স্বপ্নসন্ধানী একটি নামী দল, অভিনেতাদের বা পরিচালকদের থিয়েটারের বাইরেও একটা পরিচয় আছে, তাই কি বেশি দর্শক দেখতে আসছে? বা অভিনেতারা সিনেমা ও থিয়েটার একসঙ্গে করে বলে কি দর্শক বেশি হয়? এর উত্তর- না! 'স্বপ্নসন্ধানী'-র বয়স যখন ২৭, বা ২৫, বা ২০ বছর, (এখন 'স্বপ্নসন্ধানী' ৩০ পূর্ণ করেছে) তখন দিনের পর দিন এমন দেখা গেছে যে, হল একদম ফাঁকা গেছে। ‘অশ্বত্থামা’ নাটকে দেখা গেছে যে, সামনে ২৫ জন দর্শক বসে আছে। বা একসময় যখন ‘সুজাতা সদন’-এ অভিনয় হচ্ছে নিয়মিত, তখন সামনে ১৫ জন বা ২২ জন বসে আছে। থিয়েটারে তথাকথিত 'স্টার তত্ত্ব’ থাকার পরেও এই দিন দেখা গেছে। সুতরাং, অভিনেতারা সিনেমাতেও অভিনয় করে বলে বা একটি নাট্য দল অনেকদিন অভিনয় করছে বলেই যে শো হাউজফুল হবে, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। নাটক মঞ্চসফল হওয়ার নেপথ্যে মূলত কাজ করে নাটকটির গুণ, সেটি কতটা যথাযথভাবে উপস্থাপিত করা যাচ্ছে ও তা দর্শকদের মনে কতটা গভীরে দাগ কাটছে, সেই ব্যাপারগুলো। 'হ্যামলেট' নাটকটা এতটা হনেস্টি-র সঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে, যা মানুষের মনে গভীর রেখাপাত করেছে, এই কারণেই এত কম সময়ে 'হ্যামলেট' এতটা সাফল্য পেয়েছে।"
সম্পূর্ণ আলোচনা থেকে এই চিত্র পরিষ্কার, থিয়েটারের দর্শককে অসচেতন ভাবার কোনও কারণ নেই। তাঁরা এখনও কনটেন্টের ওপর জোর দিয়েই নাটক দেখতে যাওয়া বা না-যাওয়া নির্ধারণ করেন। কনটেন্ট ভালো হলে দর্শক হলমুখী হতে বাধ্য।