আজও বাঙালির 'গুরু', উত্তমকুমার বেঁচে রইলেন মধ্যবিত্ত আবেগে

উত্তমকুমার তাঁর মস্ত শরীরটাকে সঙ্গে নিয়ে মনের ভেতর হাজার হাজার প্রাণকে লালন করতে করতে বেড়ে উঠেছেন, বুড়ো হয়েছেন। তাঁর জয় আসলে আমাদের জয়, তাঁর হার আসলে আমাদের হার আর তাঁর মৃত্যু আসলে সময়ের মৃত্যু।

 

সদ্য চলে গেল ২৪ জুলাই। এই দিনটা যে উত্তমকুমারের মৃত‍্যুদিন, তা এককথায় বলে দিতে পারে বাঙালি। কেন উত্তমকুমারের মৃত্যুদিনটা বেশি জনপ্রিয় জন্মদিনের চেয়ে? যত সংখ্যক মানুষ উত্তমকুমারের মৃত্যুদিনটাকে মনে রাখেন, শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তাঁকে, তাঁর কাজকে স্মরণ করেন, তার কত সংখ্যকই বা তাঁর জন্মদিনে তাঁকে একইভাবে মনে রাখেন? পৃথিবীতে কয়েকজনই আছেন যাঁরা তাঁদের মৃত্যু দিয়ে মনে গেঁথে গেছেন মানুষের। এঁদের মধ্যে যে দু'জন মানুষ আমবাঙালির সংসারজীবনে ঢুকে পড়েছিলেন ভীষণ ভাবে, তাঁরা উত্তমকুমার এবং ঋতুপর্ণ ঘোষ।

বিভিন্ন মানুষ, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন পরিসরে উত্তমকুমারকে নিয়ে অসামান্য কিছু আলোচনা করে গেছেন, গবেষণা করে গেছেন এবং এখনও করছেন। কিন্তু তাও তাকে নিয়ে আসলে কিছুই বলার নেই। কারণ, কেউ যখন আত্মীয়-স্বজনের মতো চৌকাঠ পেরিয়ে, সদর ঘর টপকে, শোবার ঘরের খাটের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে বসে বলেন, "এই মাথা ধরেছে ওষুধ দে, আর আজ রাতে একটু মুড়িঘন্ট বানাবি, রুটি দিয়ে খাবো", তখন তাঁকে নিয়ে আলাদা করে আর কিছুই বলার থাকে না। কারণ তিনি তখন আমাদের মননে, চেতনায় আর আত্মায় বড় প্রাত্যহিক হয়ে যান। তাঁকে আপন বলে জড়িয়ে ধরতে গেলে আর কোনও অতিরঞ্জিত বাতুলতার প্রয়োজন হয় না আমাদের।

উত্তম সেরকমই একজন মানুষ, যাকে পাড়ার লাল্টুদা থেকে শ্যামলীপিসিমা সবাই চেনে এক ডাকে। তাই কোনও এক বৃষ্টিমুখর শ্রাবণের সকালে তাঁর চলে যাওয়ার খবর পেলে, আমাদের বাড়িতে হাঁড়ি চাপে না। পাড়াপড়শি স্তব্ধ হয়ে যায় কয়েকদিনের জন্য। চূড়ান্ত হুল্লোড়বাজ সত্যদাও পাড়ার চায়ের দোকানে এসে শুধু সিগারেট আর চা খেয়ে বাড়ি চলে যায়, কোনও কথা বলতে পারে না। সকালবেলা টিউশনি করিয়ে ফিরে সেই যে সুজাতা ঘরে ঢুকে দোরে খিল দিয়েছিল, তারপর থেকে টানা একটা গোটা দিন তাকে আর ডেকে ডেকে সাড়া পাওয়া যায় না। তারপর থেকে ক'দিন বিকেলবেলা পাড়ার মোড়ের আড্ডা বন্ধ হয়ে যায়। চোখের জল মুছতে মুছতে রাঙাপিসির তরকারি পুড়ে যায়, হঠাৎ হঠাৎ ভুবনকাকা একটা ফাঁকা দেওয়ালের সামনে গিয়ে চিৎকার করে আর ঘুঁষি মারে।

আরও পড়ুন: বুকে ব্যথা নিয়েও শট দিয়েছিলেন, ফিরে দেখা মহানায়কের শেষ দিন

এসবের মধ্যেই দেখা যায়, লাখ লাখ মানুষ কাদামাখা পথ ধরে হাঁটছেন মৃত্যুমিছিলের সঙ্গে সঙ্গে। কারও জামা ছিঁড়ে যায়, কারও পা হড়কে যায়, কারও মাথা ফেটে রক্ত ভেসে যায় সাদা রজনীগন্ধার পুষ্পরথের ওপর। এসবের মাঝেই কালো কালো মাথাগুলো শ্রাবণের কালো মেঘ-ছোঁয়া বিশাল আকাশটাকে সাক্ষী রেখে এগিয়ে নিয়ে চলেন একটা শবদেহ, সেই মানুষটার, যাকে তাঁরা ভালবেসে 'গুরু' বলে ডাকেন। গুরুকে মাথায় নিয়ে অনন্ত যাত্রাপথের দিকে এগিয়ে যাওয়াই যে শিষ্যদের কাজ! তাই সে পথ যতই কন্টকময় হোক, ফের উঠে দাঁড়িয়ে শিরদাঁড়া শক্ত করে এগিয়ে যেতে হয়। যাতে ৪১ বছর পরেও মানুষ তাঁকে 'গুরু' বলে প্রণাম করতে পারেন, নতজানু হতে পারেন তাঁর কাঙাল করা ভালবাসার কাছে।

একটা কথা মাঝে-মধ্যেই মনে হয়, অরুনকুমার একা উত্তমকুমার হয়ে ওঠেননি। তাঁকে আদর, ভালবাসা, আঘাত, শিক্ষা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ, সাহচর্য আর আশীর্বাদ দিয়ে গড়ে তুলেছেন এই বাংলার প্রতিটি সংবেদনশীল মানুষ। উত্তমকুমার তাঁর মস্ত শরীরটাকে সঙ্গে নিয়ে মনের ভেতর হাজার হাজার প্রাণকে লালন করতে করতে বেড়ে উঠেছেন, বুড়ো হয়েছেন। তাঁর জয় আসলে আমাদের জয়, তাঁর হার আসলে আমাদের হার আর তাঁর মৃত্যু আসলে সময়ের মৃত্যু।

মানুষের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকেন যিনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম, তাঁকেই বুঝি আমরণ ভালবাসা যায়। প্রতিবার নতুন করে অসম্ভবের প্রেমে পড়ার মতো করে, নিজের কপালকে দোষ দিয়ে বলা যায়, "ও মুখপুড়ি, তোর আবার মরণ হলো?" তাই কোনও প্রত্যাশা ছাড়াই সেই দিনটা এক স্বঘোষিত 'অমরত্ব যাপন' দিবস। যে দিনে প্রতিবার নতুন করে একটা মৃত্যুদিনকে জন্ম দিই আমরা।

 

More Articles