বিজ্ঞাপনের আকাল, কী অবস্থায় রয়েছে চিৎপুরের যাত্রাপাড়া?

এই শহরে বাগবাজারের মাঠ, দমদম, বারাসত বা সল্টলেকেও বছরের পর বছর জমেছে যাত্রাপালা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের আমলে যাত্রার জন্য নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। হঠাৎ আসা করোনা কাবু করেছে যাত্রাশিল্পীদের।

সবে মাসির বাড়ি গেল জগন্নাথের রথ, কিন্তু এই বছরও খবরের কাগজে দেখা মিলল না পুরনো চেনা ছবির। সে এক দিন ছিল, তখন রথের তারিখে খবরের কাগজ হয়ে উঠত ঢাউস। মূল কাগজ যদি ১৬ পাতার, সঙ্গে ক্রোড়পত্র নিয়ে ২৪ পাতার কাগজ। ঢাউস ঢাউস ফুল পেজ অ্যাড। সেসব ছবি জুড়ে নায়ক-নায়িকাদের পমেটমমাখা মুখ, কাজলটানা চোখ। শুরু হতো যাত্রার মহরত। এবার অবশ্যই করোনার দমক কাটিয়ে লড়াইটা ঘুরে দাঁড়ানোর। কীভাবে?

রথযাত্রার সঙ্গে যাত্রাশিল্পের নাড়ির টান। রথের দিন খবরের কাগজ পাতা জুড়ে থাকত বিভিন্ন অপেরার বড় বড় বিজ্ঞাপন। একাধিক সংবাদপত্র যাত্রা নিয়ে আলাদা সাপ্লিমেন্ট প্রকাশ করত। এখন সেসব অতীত। এবার রথেও দেখা মিলল না যাত্রার ঢাউস ঢাউস বিজ্ঞাপন।

যাত্রার এদিন
করোনার দাপটে এই শিল্প একেবারে থমকে দাঁড়িয়েছিল। আবার নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে চিৎপুর। গত দু’বছর করোনার কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যাত্রাপাড়া। সেই অবস্থা কাটিয়ে ভালো বাজার পাওয়ার আশায় চিৎপুরে শুরু তোড়জোড়। যাত্রা অপেরাগুলোর বক্তব্য, নয়া মরশুমের প্রথম থেকে তারা সবরকমের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। আগামী মরশুমে ভালো বাজার পাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। গত ২ বছর করোনার জন্য রাজ্য যাত্রা একাডেমির অনেক অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে। যাত্রা উৎসবও পরিপূর্ণভাবে করা হয়নি। এবার পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক। ফলে একাডেমি একগুচ্ছ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নিয়েছে। রথের দিন থেকে বাগবাজার যাত্রামঞ্চে ১৫ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ শিবির শুরু হয়েছে। প্রতিটি জেলা থেকে প্রশিক্ষণে অংশ নিতে আসছেন শিল্পীরা। রথের দিন বাগবাজার ফণীভূষণ বিদ্যাবিনোদ মঞ্চ প্রাঙ্গণে বিভিন্ন স্টল থেকে শুরু হলো যাত্রাপালার বুকিং।

আরও পড়ুন: কোথায় হারিয়ে গেল উত্তর কলকাতার বিখ্যাত সিনেমা হলগুলো?

রথের দিনটি যাত্রাশিল্পীদের কাছে দুর্গাপুজোর সমান। ওইদিন থেকে শুরু হয় নতুন বছরের যাত্রার মহরত। যাত্রার জন্য দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। গত দু’বছর দুঃসময় গেছে, যাত্রার কলাকুশলীদের বক্তব্য, করোনার কারণে থমকে ছিল যাত্রা শিল্প, মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা চলছে।

যাত্রা শিল্পের অন্তর্জলি যাত্রার বড় কারণ করোনা, কিন্তু একমাত্র কারণ নয়, কারণ ঘরে ঘরে টিভি সিরিয়ালের দাপট, হাতে হাতে স্মার্ট ফোন- কিছুটা হলেও বদলে দিয়েছে সংস্কৃতির ধারা। তাই মূলত গ্রামীণ এই শিল্পে এসেছে কিছুটা ভাটার টান।

ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চলছে। তবে চিৎপুরে আর আগের উৎসবের মেজাজ চোখে পড়েছে না। কেন? যাত্রাশিল্পে ১৯৭০-৮০-র এই পরিবেশের কোনও তুলনাই হয় না। এই মন্দার কারণ কি শয়ে শয়ে সিরিয়াল, রিয়েলিটি শো? আসলে বোকাবাক্সর পর্দার চ্যালেঞ্জ কীভাবে সামলানো যায়, চিৎপুর এর উত্তর খুঁজে পেল না। এটাই এই শিল্পের সংকটের প্রধান কারণ।

যাত্রার সেদিন
আটের দশকের শুরুতে গ্রামবাংলার সামাজিক জীবনে প্রভাব ফেলেছিল 'মরমী বধূ’ নামের এক যাত্রাপালা। জসিমউদ্দিনের `সোজন বাদিয়ার ঘাট’–কেও নাট্যরূপ দেওয়া হয়েছিল। নট ও নাট্যকার নির্মলকুমার, মীনাকুমারীরা তখন গ্রামের পর গ্রামে রাত জেগে অভিনয় করেছেন। 'মরমী বধূ' পালা দেখতে ১০-১৫ কিলোমিটার ভ্যান রিকশা ভাড়া করে যেতেন বাড়ির মেয়েরা। আত্মীয়র বাড়ি থেকেও যাত্রাপালা দেখতেন সেকালের মানুষ।

নিখাদ প্রেমের পালা 'দেবদাস'। প্যান্ডেল থেকে চোখ মুছতে মুছতে বের হতেন না, এমন নারী-পুরুষের সংখ্যা মেলা ছিল ভার।

এর আগে অবশ্য 'বিবি আনন্দময়ী', 'নটী বিনোদিনী', 'গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম', 'মা মাটি মানুষ'- বাংলা দাপিয়ে বেড়াত। তখন জনপ্রিয়তা বিচার হতো টিকিট বিক্রির নিরিখে। হাটে-বাজারে, মাঠে-ঘাটে বিভিন্ন যাত্রাপালা নিয়ে আলোচনা হতো বিস্তর।

'গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম', 'মীরার বধুঁয়া' ছিল পৌরাণিক পালা। হিন্দু, এমনকী মুসলমানরাও এই দুই যাত্রাপালা দেখতে ছুটতেন। এর একটা বড় কারণ, বীণা দাশগুপ্ত আর বেলা মুখোপাধ্যায়ের অভিনয়। তবে এই দুই নায়িকাকে ছাপিয়ে মীনাকুমারী হয়ে উঠেছিলেন গ্রামবাংলার পার্বতী বা লায়লা-মজনুর লায়লী।

আটের দশকে নামকরা পালা দেখতে মানুষ ছুটতেন প্যান্ডেলে। গ্রামে হতো 'মনসার ভাসান', 'বনবিবি চম্পা', বেহুলা-লখিন্দর, লায়লা-মজনুর মতো জনপ্রিয় যাত্রাপালা। গ্রামে খেটে খাওয়া মানুষ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সন্ধের পর একসঙ্গে বসতেন রিহার্সালে। এক এক দল দু'-তিনটে করে পালা নামাত। সেরা অভিনেতা-অভিনেত্রীকে বহু মানুষ খুশি হয়ে পুরস্কার দিতেন। তাঁদের নাম ঘোষণা করা হতো মাইকে। গ্রামের মানুষ মনে করতেন, এতে শিল্পীদের সম্মান বাড়ে।

যাত্রা কি এখন শুধু গ্রামে?
না, এই শহরে বাগবাজারের মাঠ, দমদম, বারাসত বা সল্টলেকেও বছরের পর বছর জমেছে যাত্রাপালা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের আমলে যাত্রার জন্য নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। হঠাৎ আসা করোনা কাবু করেছে যাত্রাশিল্পীদের। তাঁরা এখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। ইদানীং, প্রথম সারির যাত্রা দলের শো-পিছু বুকিং হতো ৭৫ থেকে ৮০ হাজারে। দ্বিতীয় সারির দল পায় ৫৫ থেকে ৬০ হাজার। বাকিরা ৪০ হাজার করে শো। ৮০ হাজার টাকার ৭০টি শো বাতিল মানে একটি দলের ক্ষতি ৫০ লাখের ওপর। বুকিং ক্যানসেল মানে এই শিল্পকে গঙ্গাপ্রাপ্তির দিকে ঠেলে দেওয়া।

সেসব দিন আর নেই, এর কারণ কী? এখন মানুষের সময় কম। সবাই ছুটছেন বিকল্প আয়ের জন্য। সন্ধেবেলাতেও ফুরসত কম। কিছুটা ধর্মীয় কারণও কাজ করেছে। শহরতলি ছাপিয়ে এই প্রবণতা গ্রামেও। আগে দেখা যেত বেহুলা সাজছেন মুসলমান মেয়ে, হিন্দুর ছেলে সাজছেন লখিন্দর। সেসব দিন আর নেই। ধর্মের বেড়াজাল আটকে দিয়েছে অনেক কিছুই। তবে একটা কথা পরিষ্কার, যে শিল্পের ঐতিহ্য এত সম্ভ্রান্ত, এবারও রথের দিনে তার ঘুরে দাঁড়ানোর উত্তর খুঁজল চিৎপুর। উত্তর মিলল কি না, সময়ই বলবে।

 

More Articles