কোথায় হারিয়ে গেল উত্তর কলকাতার বিখ্যাত সিনেমা হলগুলো?
মিত্রা ভাঙা হচ্ছে শপিং মলের জন্য। তালা পড়ে গেছে দর্পণায়। রাধা, উত্তরা, শ্রী ইতিহাস।
ছুটির দিনে বাড়িতে সবাই মিলে গল্প করছিলাম। এই সময় বড় পিসি জিজ্ঞেস করল, "হাতিবাগানে আর একটাও বড় সিনেমা হল নেই। তাই না?"
সত্যি! ছোট থেকে দেখা মিত্রা, রাধা, উত্তরা, শ্রী, দর্পণা- আজ সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সাকুল্যে বেঁচে রয়েছে স্টার এবং মিনার। যদিও স্টার থিয়েটার সরকারি অধিগ্রহণের কারণেই টিকে, এবং বেশিরভাগ সময় সিনেমা দেখানো হলেও স্টার কিন্তু মূলত থিয়েটার প্রেক্ষাগৃহ। কলকাতায় এখন বহু মাল্টিপ্লেক্স আছে ঠিকই, কিন্তু সিনেমা হল বলতে মধ্যবিত্ত আজীবন বুঝেছে সিঙ্গল স্ক্রিন।
পাঁচ-ছয়ের দশকে সাবেক কলকাতার সিনেমা হল-সংস্কৃতি এক অন্য চেহারা পায়। নুন শো, ম্যাটিনি শো, ইভনিং শো, নাইট শো- এই লব্জগুলো জনজীবনের অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল তখন। পাশ্চাত্যের 'ম্যাটিনি আইডল'-এর ধারণা তখন বাঙালি জীবনে জেঁকে বসেছিল কিন্তু মূলত ম্যাটিনি শো-র সূত্র ধরেই। ঠিক দুপুর আর বিকেলের সন্ধিক্ষণের শো ছিল ম্যাটিনি শো। আবার 'নাইট শো' দেখারও চল ছিল রীতিমতো। মনে করে দেখুন, 'দেয়া নেয়া' ছবিতে উত্তমকুমার, তরুণকুমার ও লিলি চক্রবর্তী অভিনীত তিনটি চরিত্র নাইট শো দেখতে যাচ্ছে। সারাদিনের অফিসের পরেও ক্লান্ত না হয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়ার এই যাপন তো আদতে এক সংস্কৃতির অঙ্গ। 'গল্প হলেও সত্যি'-তে বাড়ির মেয়েদের সম্মিলিতভাবে সিনেমা দেখতে যাওয়ার সময় কিন্তু আবার ম্যাটিনি শো। বাড়ির বেশিরভাগ পুরুষ সেসময় কর্মসূত্রে বাইরে। আবার ইভনিং শো-তে প্রেমিক যুগলের গোপন পদচারণাও নানা সাহিত্যে, সিনেমায় বারবার উঠে এসেছে। আর স্কুল পালিয়ে, অফিস কেটে সিনেমা দেখার জীবনটা তো এই কয়েক দশক আগে পর্যন্তও ছিল।
আরও পড়ুন: আমেরিকার বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় এই নিরামিষ ভারতীয় আইসক্রিম
এই সামগ্রিক সিনেমা হল সংস্কৃতির মধ্যে উত্তর কলকাতার সিনেমা হলগুলো আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে। মিত্রা আর দর্পণা ছিল হাতিবাগানের মোড়ের আগে, ঠিক পাশাপাশি দুটো হল। উল্টোপারে রয়েছে মিনার। বছর কুড়ি আগে মূলধারার বাংলা ছবির পোস্টারে লেখা থাকত, 'মিনার, বিজলী, ছবিঘর'। এর মধ্যে বিজলী দক্ষিণে, মধ্য কলকাতায় ছবিঘর, আর উত্তরে মিনার। মিনার এখনও আছে, তবে খুবই সঙ্গিন অবস্থায়, ব্লু রে সিনেমা স্ক্রিনের বিজ্ঞাপন দিয়ে মাল্টিপ্লেক্সের কায়দাতেই লোক টানতে হচ্ছে তাদের। মিত্রা ভাঙা হচ্ছে শপিং মলের জন্য। তালা পড়ে গেছে দর্পণায়। রাধা, উত্তরা, শ্রী ইতিহাস। একসময় শিয়ালদার 'প্রাচী'-তে কেবল বাংলা সিনেমা দেখানো হয়, এই অহং বজায় ছিল। সেই 'প্রাচী'-তে এখন হিন্দি, দক্ষিণী, সব ধরনের ছবি চলে। তাতেও দর্শক টানতে বেশ বেগ পেতে হয় এই হলগুলোকে। কেবল পুজোর সময় বা এই ধরনের পার্বণে ভিড়ের প্রাবল্যে হয়তো কিঞ্চিৎ লক্ষ্মীলাভ হয় এই হলগুলোর।
সিনেমার টিকিট কাটার জন্য দীর্ঘ সময়ের লাইন থেকে ঘরে বসে ওয়েবসাইট মারফৎ টিকিট কেটে মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখতে যাওয়ার পথ পার করে এসে এখন ঘরে বসেই বিভিন্ন অ্যাপে সিনেমা দেখি আমরা। সিনেমা হলের বাইরের প্রায় লজঝরে কোল্যাপসিবল গেট টপকে মাল্টিপ্লেক্সের মেটাল ডিটেকটরের আওয়াজ পেরিয়ে আজ মোবাইলের লক স্ক্রিন সিনেমার দরজা খোলে। ছোটবেলায় সিনেমা দেখতে যাওয়ার জন্যে বাড়িতে সবাইকে একসঙ্গে প্রস্তুতি নিতে হতো, তার মধ্যে ছিল এক ধরনের কৌম সংস্কৃতি। ব্যক্তিগতভাবে মনে পড়ে, বাবা ছুটির দিন সকালে বাজার করে বাড়ি এসেই সিনেমার টিকিট কাটতে যেত, কারণ সারাদিনে শুধু তিনটে শো চলত এবং তার মধ্যে নাইট শো আগেই বাদ পড়ত, কারণ মাকে বাড়ি ফিরে রান্না করতে হবে। বাবার থেকে শুনেছি যে, তাড়াতাড়ি না গেলে টিকিট শেষ হয়ে যাবে। তখন হয় পরের ছুটির দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে নাহলে বেশি টাকা দিয়ে ব্ল্যাকারদের থেকে টিকিট কাটতে হবে। সেই টিকিট ব্ল্যাকের সংস্কৃতিও উধাও হলো সিঙ্গল স্ক্রিন উঠে যাওয়ার দৌলতে। আমি ছোটবেলায় একবারই নাইট শো-তে বাবা, মায়ের সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। তার জন্যে মা সন্ধে নাগাদ তাড়াতাড়ি করে রুটি, আলুর দম বানিয়ে রেখেছিল, যাতে বাড়ি ফিরে রান্না না করতে হয়। মাল্টিপ্লেক্সের যুগে সেইসব চিন্তা চলে গেল। কারণ একটা শো না দেখতে পেলেও তার আধঘণ্টার মধ্যেই আরেকটা শো থাকত। এখন তো সেই চিন্তাও নেই। ছুটির দিনে ঘণ্টা দুই-তিন হাতে থাকলেই সিনেমা দেখা যায়। সেই কারণেই হয়তো সবাইকে আর একসঙ্গে প্রস্তুতি নিতে হয় না সিনেমা দেখার জন্য। নিজের ইচ্ছে এবং সময়মতো সবাই আলাদা ঘরে বসে নিজের নিজের মোবাইলে পছন্দমতো সিনেমা দেখি।
বেশি সময়ের সিনেমাকে ছোট ছোট ভাগে দেখি আমরা এখন। সিরিজের আতিশয্যে সিনেমা দেখার মনটাও পাল্টেছে আমাদের। মিত্রা সিনেমা হলের নায়কের ছবিতে মালা আর হলের ভেতরে নায়কের বলা ডায়লগে সিটি দেওয়া থেকে অ্যাপে সিনেমা দেখে ফেসবুকে নায়কের অভিনয় নিয়ে পোস্ট দেওয়া অবধি অনেকটা পথ আমরা পেরিয়ে এসেছি। সিনেমা হলে বিরতিতে খাওয়া চিপস, প্যাটিসের জায়গা কিছু দিনের জন্যে মাল্টিপ্লেক্সের দামি পপকর্ন নিলেও তারাও বেশি দিন নিজেদের জায়গা রাখতে পারল না। এখন বিভিন্ন অ্যাপে নানারকম খাবার অর্ডার দিয়ে সেই খাবার পাশে নিয়ে বাড়িতে বসে সিনেমা দেখা আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে, আর সেই অভ্যেস বিজ্ঞাপিত হয় কখনও খাবার ডেলিভারির অ্যাপে, কখনও বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের অ্যাপে।
এর পরে কী আসতে চলেছে? এর পরে কি সিনেমা দেখতে দেখতে নিজের ইচ্ছেমতো গল্প পরিবর্তন করতে পারব? ইচ্ছে হলে নায়কের প্লেট থেকে খাবার তুলে নিয়ে খেতে পারব? সেই দিন হয়তো দূরে নেই, এই ভার্চুয়াল রিয়েলিটির যুগে। সিনেমা হল তো হারিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার সঙ্গে যুক্ত লোকগুলোর কী হবে? সেই লোকগুলো কি ওই সিনেমা হলের জায়গায় তৈরি হওয়া শপিং মল অথবা রেস্টুরেন্টে চাকরি পেয়েছে? আমরা সিনেমা হলের জগৎ শেষ হয়ে যাওয়া নিয়ে সিনেমা দেখি, কিন্তু তা দেখতেও সিনেমা হলে যাই না।