দেব দীপাবলিতে লোকারণ্য বারাণসী! গঙ্গায় প্রদীপ ভাসানোর নেপথ্যে রয়েছে যে কাহিনি

Varanasi Dev Deepawali: চারদিনের গঙ্গামহোৎসবে নদীঘাটের সাজানো মঞ্চে বসে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, ভজন, শাস্ত্রীয় নৃত্য, লোকসঙ্গীতের আসর। সন্ধে থেকে রাত পর্যন্ত চলে সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

গঙ্গাতীরের বারাণসী। হাজার বছরের পুরনো এই জনপদ ভারতীয় ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির আধারভূমি। বারাণসীর গঙ্গা ছোঁয়া শতাধিক ঘাটে, পুরনো মহল্লায়, আলোছায়া মাখা গলিপথে আজও ইতিহাসের ছোঁয়া মেলে। প্রতিবছর কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই পৌরাণিক জনপদ মেতে ওঠে এক আলোকময় উৎসবে। সে উৎসব ‘দেব দীপাবলি’ নামে পরিচিত। দেব দীপাবলি অর্থাৎ দেবতাদের দীপাবলি। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে সাধারণত হিন্দুরা পালন করে থাকেন দীপাবলি উৎসব যাকে বাঙালিরা চেনে কালীপুজো নামে। দীপাবলি মানেই দীপের উৎসব অর্থাৎ আলোর উৎসব। হাজার হাজার প্রদীপের আলোয় ভরে ওঠে চতুর্পাশ। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে দীপাবলিতে বহু ধরনের আতসবাজি পোড়ানো হয়। আর ঠিক এর পনেরো দিন পরেই কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে বিশেষত বারাণসীতে পালন করা হয় ‘দেব দীপাবলি’। দীপাবলি আর এই দেব দীপাবলির পালনের প্রকৃতি কিছুটা এক হলেও এর পটভূমি একেবারেই ভিন্ন। লোকবিশ্বাস, দীপাবলির পনেরো দিন পরে স্বর্গের দেবতারা এই বিচিত্র উৎসবে শামিল হন। আরও নানা গল্পকথা রয়েছে উৎসবকে ঘিরে।

ইংরেজি ক্যালেন্ডারের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে দেব দীপাবলি পালন করা হয়। বারাণসীর গঙ্গার ঘাটগুলি আলোয় সেজে ওঠে এই দিনে। দীপাবলির ঠিক পনেরো দিন পরে বারাণসীর একেবারে দক্ষিণ দিকের রবিদাস ঘাট থেকে শুরু করে রাজঘাট পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে, সহস্র প্রদীপের আলোয়, পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণে এক মায়াময় পরিবেশ রচিত হয়। এই দিনে মাটির জ্বলন্ত প্রদীপ গঙ্গায় ভাসিয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানায় ভক্তরা। লোকবিশ্বাস, এই দিনই নাকি স্বৰ্গলোক থেকে দেবতারা নেমে আসেন মর্ত্যে গঙ্গায় পুণ্যস্নান করবেন বলে। এই দেব দীপাবলি ‘ত্রিপুর পূর্ণিমা স্নান’ নামেও পরিচিত। ১৯৮৫ সালে বারাণসীর পঞ্চগঙ্গা ঘাটেই প্রথম দেব দীপাবলি উপলক্ষ্যে প্রদীপ জ্বালানো হয়। এই দিনে সমস্ত বাড়িতেও প্রদীপ দিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়, বাড়ির সদর দরজায় রঙিন আলপনা দেওয়া হয়। রাত্রে পোড়ানো হয় বিভিন্ন রকমের আতসবাজি। তাছাড়া বারাণসীর অলিতে গলিতে দেবতাদের মূর্তি হাতে নিয়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রাও বেরোয় অনেকসময়।

আরও পড়ুন- ঘিঞ্জি দিঘা, ভিড় দার্জিলিং নয়, এই রাজবাড়িগুলিই এখন শীতের সেরা ডেস্টিনেশন!

কার্তিক পূর্ণিমার গঙ্গাস্নানের গুরুত্ব

কার্তিক মাসের গুরুত্ব সম্পর্কে বিষ্ণু ব্রহ্মাকে, ব্রহ্মা নারদ মুনিকে আর নারদ মুনি মহারাজ পৃথুকে অবগত করিয়েছিলেন। স্কন্দ পুরাণ অনুযায়ী, এই মাসের এই তিন তিথিতে যদি সূর্যোদয়ের পূর্বে উঠে স্নান করা যায়, তা হলে পুরো মাসের স্নানের ফল ভোগ করা যেতে পারে। কথিত আছে, আধ্যাত্মিক এবং শারীরিক শক্তি সঞ্চয়ের জন্য সর্বশেষ মাস হল কার্তিক মাস। এই মাসের পূর্ণিমায় মহাদেব অর্ধনারীশ্বর রূপে বধ করেছিলেন ত্রিপুরাসুরকে। এই ঘটনার পর থেকেই শিবকে ‘ত্রিপুরারী’ বলে ভূষিত করেছিলেন বিষ্ণু।

দেব দীপাবলি নিয়ে গল্পগাথা

নানা মুনির নানা মত এই দীপাবলি উৎসবকে কেন্দ্র করে। মনে করা হয়, এই দিনে শিব ত্রিপুরাসুরকে হত্যা করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে পৌরাণিক কাহিনিগুলি থেকে জানা যায়, যখন কার্তিকেয় তারকাসুরকে বধ করেন, তখন তাঁর তিন পুত্র দেবতাদের প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। তারকাসুরের তিন পুত্র কঠোর তপস্যা করে ব্রহ্মার কাছে বর চেয়েছিলেন। তিন পুত্রের নাকি আর্জি ছিল, “হে প্রভু! আপনি আমাদের জন্য তিনটি পুরী তৈরি করুন এবং যখন অভিজিৎ নক্ষত্রে তিনটি পুরী একই সারিতে দাঁড়িয়ে থাকবে এবং কেউ যদি অসম্ভব রথ এবং অসম্ভব তীরের সাহায্যে খুব শান্ত অবস্থায় আমাদের হত্যা করার চেষ্টা করে তবে আমরা মারা যাব।” ব্ৰহ্মা তিনজনকেই আশীর্বাদ করলেন। এই বর পাওয়ার পর তাঁরা তিনজনই নিজেদের শক্তি দিয়ে পৃথিবী, স্বর্গসহ সমস্ত জগতের মানুষ ও দেবতাদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। উপায় না দেখে, সকলে মিলে শিবের কাছে সাহায্য চাইতে যান এবং অসুর বধের অনুরোধ করেন। এরপর শিব রাক্ষস ত্রিপুরাসুরকে বধ করেন। অসুরের অবসানের আনন্দে সমস্ত দেবতারা প্রসন্ন হয়ে কাশীতে, ভোলেনাথের নগরী বা অন্যত্র লক্ষ লক্ষ প্রদীপ জ্বালিয়ে আনন্দ উদযাপন করেন। যেদিন এই সব ঘটেছিল সেই দিনটি ছিল কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথি। তারপর থেকে, কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে সর্বত্র দেব দীপাবলি নামে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে এই উৎসব পালিত হয়। তবে অনেকে মনে করেন, শিখদের ধর্মগুরু গুরু নানক এবং জৈনদের ধর্মগুরু আদিনাথ তীর্থঙ্করের জন্ম হয়েছিল এই দিনে আর সে কারণেই দেবতারা সর্বত্র আলোকসজ্জায় সজ্জিত করেন।

অন্য মত অনুসারে, ত্রিশঙ্কুকে ঋষি বিশ্বামিত্র তাঁর তপস্যার দ্বারা স্বর্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। এতে দেবতারা ক্রুদ্ধ হয়ে ত্রিশঙ্কুকে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করেন। ক্ষুব্ধ হয়ে বিশ্বামিত্র তাঁর দৃঢ়তায় পৃথিবী-স্বর্গ প্রভৃতি মুক্ত এক নতুন সমগ্র জগৎ সৃষ্টি শুরু করেন। তিনি কুশ, মাটি, উট, ছাগল-ভেড়া, নারকেল ইত্যাদি সৃষ্টি করেছেন। এরই মধ্যে রাজর্ষি বর্তমান ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশের মূর্তি তৈরি করে তাঁদের মধ্যে প্রাণ জাগরণের কাজ শুরু করেন। ইতিমধ্যে দেবতারা ঋষি বিশ্বামিত্রের কাছে প্রার্থনা করলে মহর্ষি খুশি হয়ে নতুন জগৎ সৃষ্টির সংকল্প ত্যাগ করেন। এতেই সকল দেবতারা প্রসন্ন হয়ে দীপাবলির মতোই ত্রিভুবনে উৎসব পালিত করেন যা থেকেই দেব দীপাবলি পালিত হয়।

আবার এটিও বিশ্বাস করা হয় যে আষাঢ় শুক্ল একাদশী থেকে বিষ্ণু চার মাসের জন্য যোগ নিদ্রায় যান এবং তারপর তিনি শুধুমাত্র কার্তিক শুক্লা একাদশীতে জেগে ওঠেন। এই একাদশীতে তিনি তুলসীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং এরপর কার্তিক পূর্ণিমায় সকল দেব-দেবীরা বিষ্ণুর ঘুম থেকে জেগে ওঠার আনন্দে লক্ষ্মী ও নারায়ণের মহা আরতি করে প্রচুর প্রদীপ জ্বালিয়ে আনন্দ উদযাপন করেন।

অন্য একটি বিশ্বাস অনুসারে বলা হয় যে, বামনদেবের স্বর্গ প্রাপ্তির আনন্দে, সমস্ত দেবতা একসঙ্গে কার্তিক মাসের পূর্ণিমা উদযাপন করেছিলেন এবং গঙ্গার তীরে প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন, তখন থেকেই দেব দিপাবলি উদযাপনের প্রথা। কথিত আছে, এই দিনে সত্যযুগে বিষ্ণু মৎস্য অবতার ধারণ করেছিলেন। আর এই দিনেই তুলসীর আবির্ভাব হয়। এছাড়াও একটি বিশ্বাস আছে যে, কার্তিক পূর্ণিমায় কৃষ্ণ আত্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন।

আরও পড়ুন- সংস্কৃত শিখে গঙ্গার পুজো করেছিলেন বাংলায় প্রথম মসজিদের নির্মাতা এই তুর্কি সেনাপতি!

দেব দীপাবলির আচার অনুষ্ঠান

কার্তিক স্নান আর দীপদান এই দুটিই দেব দীপাবলির প্রধান আচার-সংস্কারের মধ্যে পড়ে। কার্তিক মাসের পুণ্য তিথিতে গঙ্গাস্নানকেই কার্তিক স্নান বলা হয়। লোকবিশ্বাস যাই থাকুক না কেন এই বর্ণময় উৎসব শুধুমাত্র বারাণসীতেই অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসব উপলক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগে দশাশ্বমেধ ঘাটের পাশে রাজেন্দ্রপ্রসাদ ঘাটে দেব দীপাবলির চারদিন আগে শুরু হয় গঙ্গামহোৎসব নামের মনমাতানো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই দুই উৎসব মিলিয়ে পাঁচদিন বারাণসী হয়ে ওঠে উৎসব নগরী। চারদিনের গঙ্গামহোৎসবে নদীঘাটের সাজানো মঞ্চে বসে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, ভজন, শাস্ত্রীয় নৃত্য, লোকসঙ্গীতের আসর। সন্ধে থেকে রাত পর্যন্ত চলে সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শহরের ময়দানে বসে হস্তশিল্পের মেলা। মেলা উৎসবের আনন্দে শহর জুড়ে রং আর আলোর রোশনাই। উৎসবের টানে ভিড় জমান দেশ-বিদেশের পর্যটক আর অজস্র আলোকচিত্রী। কার্তিক পূর্ণিমার আগের রাতে গঙ্গামহোৎসবের সুরেলা উৎসব শেষ হলে শুরু হয় দেব দীপাবলির প্রস্তুতি। কাছে দূরের গ্রাম, গঞ্জ, শহর থেকে পুণ্যস্নানে আসেন অজস্র মানুষ। মাঝরাত থেকেই শুরু হয় গঙ্গাস্নান। গঙ্গার ঘাট তখন লাখো মানুষের দখলে। তিথি যোগ মেনে পুণ্যার্জনে মানুষ ডুব দেন জলে। কার্তিক পূর্ণিমার দিন সকাল পর্যন্ত চলে সেই পুণ্যস্নান। ভিড় বেশি থাকে দশাশ্বমেধ আর পঞ্চগঙ্গা ঘাটে।

ভোরের আলো ফুটলে স্নান সেরে ঘাটে বসেই মেয়েরা ব্রতকথা পাঠ করেন। সবজি এবং ফুলের ঢিপি বানিয়ে রাধা দামোদরের পুজোও করেন অনেকে। এছাড়া, শিব ও গঙ্গাপুজোও চলে সাড়ম্বরে। লাখে মানুষের গঙ্গাস্নান শেষ হলে দুপুরের আগেই শুরু হয় ঘাট ধোওয়ার পালা। সন্ধের মুখে ঘাটের সিঁড়ি, বুরুজে লক্ষ লক্ষ ঘিয়ের প্রদীপ বসানো হয়। বাঁশের ডগায় ঝোলানো হয় আকাশ প্রদীপ। ঘাট লাগোয়া মন্দির, প্রাসাদ সাজানো হয় বিজলিবাতির মালায়। কার্তিক পূর্ণিমার দিন সন্ধের সময় শহরের ভিড় নামে গঙ্গার ঘাটে। দিনের আলো নিভলে ঘাটে ঘাটে জ্বলে ওঠে লাখো ঘিয়ের প্রদীপ। অখণ্ড আলোকমালায় সেজে ওঠে কাশীর গঙ্গাতীর। পঞ্চগঙ্গা ঘাটে বিশেষ পুজোপাঠ, আরতি দিয়ে শুরু হয় দেব দীপাবলি উৎসব। প্রতিটি ঘাটেই একে একে শুরু হয় গঙ্গারতি। সব থেকে বর্ণাঢ্য আরতি হয় দশাশ্বমেধ ঘাটে। নানা ধরনের গঙ্গারতি হয়। জলে ভাসানো হয় অজস্র প্রদীপ। সুসজ্জিত পুরোহিতের দল ঘণ্টাখানেক ধরে গঙ্গাপুজো ও গঙ্গারতি করেন। গঙ্গায় নৌকা নিয়ে ভেসে আলোকোজ্জ্বল ঘাটের বৈচিত্র্যময় ছবি দেখা এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা। দেব দীপাবলির সন্ধেতে ঘাটে ঘাটে আলোরমালা আকাশে আতসবাজির ফোয়ারা বারাণসীকে উৎসবের আলোয় ভরিয়ে দেয়। ধর্মীয় আচার-সংস্কারের পাশাপাশি এই বিশেষ দিনে বারাণসী পুলিশ প্রশাসনের তরফে দশাশ্বমেধ ঘাট এবং রাজপ্রসাদ ঘাটে ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’র স্মারক হিসেবে নিহত শহিদদের স্মরণে গঙ্গায় প্রদীপ ভাসানো হয় এবং শহিদদের স্মরণ করা হয়।

More Articles