সংস্কৃত শিখে গঙ্গার পুজো করেছিলেন বাংলায় প্রথম মসজিদের নির্মাতা এই তুর্কি সেনাপতি!
Zafar Khan Mosque of Bengal: জাফর খান ও তাঁর স্ত্রী ছাড়া আরও দু’টি কবরের দেখা মেলে। সেগুলি জাফর খানের দুই ছেলে আইন খান গাজী এবং ঘাইন খান গাজীর কবর। প্রসঙ্গত, মনে করা হয় জাফর খান গাজীর পুত্রবধূ ছিলেন হুগলির রাজকন্যা।
‘সেক্যুলার’! শব্দটির সঙ্গে ভারতীয়দের পরিচয় হয় ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর। যদিও, যত দিন এগোচ্ছে, শব্দ তার গৌরব হারাচ্ছে, হারাচ্ছে শব্দের মধ্যে লেগে থাকা ভারতীয় জোটবদ্ধতার গন্ধ। ভারতকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল, অর্থাৎ ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী এই রাষ্ট্রের কোনও জাতীয় ধর্ম নেই। দেশের প্রত্যেক নাগরিক স্বাধীনভাবে নিজের ধর্ম পালন করতে পারবেন। স্বাধীনতার দু’বছর পরে ‘সেক্যুলার’ হলেও, বাংলায় অনেক আগেই ধর্মনিরপেক্ষতার বীজ বোনা হয়েছিল। ‘একই বৃন্তে দু’টি কুসুম’ হয়ে উঠেছিল দেশের দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়।
বাংলার ইতিহাসে সম্প্রীতি আর ধর্মনিরপেক্ষতার জমি ছিল বরাবরই মজবুত। ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখলে এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত মেলে যেখানে হিন্দু-মুসলমান (যাঁদের ক্রমে ক্রমে যুযুধান করে তোলা হয়েছে) সাংস্কৃতিক, সামাজিক সাহচর্যে নিজেদের যাপন ভাগাভাগি করে নিয়েছে। আচারে প্রভেদ থাকলেও মননে এক হয়ে উঠেছে দুই সম্প্রদায়। দুই ধর্মের মানুষ মিলেই বাংলার পুনর্মিলনও ঘটিয়েছে। আজকের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে অবাক হতে হয়, যে ব্যক্তির কাঁধে ছিল বাংলায় প্রথম মসজিদ নির্মাণের দায়িত্ব তিনি জন্মসূত্রে মুসলিম হলেও ছিলেন গঙ্গার ভক্ত। গঙ্গাকে নিয়মিত পুজো করতেন এই মানুষটি।
ফিরে যাওয়া যাক দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগে অর্থাৎ মুঘল যুগেরও আগে। সেই সময়ে দিল্লিতে তুঘলক বংশের সুলতান ফিরোজ শাহের শাসন। কেবল দক্ষিণ ভারত ও বাংলা তখনও স্বতন্ত্র। বাংলায় তখন পালবংশের শাসন আর দক্ষিণভারতে চোল বংশের। এমতাবস্থায় দিল্লির সুলতান তাঁর একনিষ্ঠ বিশ্বস্ত সেনাপতি জাফর খানকে বাংলা জয় করতে পাঠান। সুলতানের আদেশে তিনি বাংলায় তুর্কি আক্রমণের নেতৃত্ব দেন। প্রথমেই এসেই তিনি হুগলি আক্রমণ করেন এবং স্থানীয় হিন্দু শাসককে পরাজিত করে বাংলায় প্রথম তুর্কি শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তাই তাঁকে বঙ্গভূমির প্রথম সুফি বংশের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন- এই ভারতীয়র নামে রয়েছে খুনের বিশ্বরেকর্ড, যার কারণে আজও ভুক্তভুগী ৬ কোটি মানুষ
শত্রু ভেবে আক্রমণ করতে আসার সময়ের জাফর খান স্বপ্নেও ভাবেননি, এই ভূমিতেই তিনি অমর হয়ে থেকে যাবেন। ভাগীরথী, যমুনা ও সরস্বতী নদীর ত্রিবেণী সঙ্গমস্থলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হন জাফর খান। বন্দর শহর হওয়ার কারণে সেই আদি সপ্তগ্রামেই নিজেদের রাজধানী স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। পরবর্তীতে তিনি ভূদেব নামক একজন স্থানীয় শাসকের সঙ্গে দ্বিতীয়বার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন এবং সেখানেই নিহত হন। তাঁর নির্দেশে ১২৯৮ সালে, ত্রিবেণীতে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয় যা বর্তমানে বাংলার সবচেয়ে প্রাচীনতম মসজিদ হিসাবে বিবেচিত। মসজিদের দেওয়ালে একটি শিলালিপি পাওয়া যায়, যেখানে লেখা ‘৬৯৮ হাজিরা’। এর থেকে অনুমান করা যায়, এই তারিখেই এই মসজিদের নির্মাণ হয়েছিল।
সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ হওয়ার পাশাপাশি এই মসজিদের এক বিশেষত্ব আছে। এই মসজিদে ব্যবহৃত পাথরগুলিতে টুকরো টুকরো করে খোদাই করা হিন্দু দেব-দেবতার মূর্তির ছাপ পাওয়া যায়। এর থেকে অনুমান করা যায়, কোনও এক হিন্দু তীর্থস্থানের ধ্বংসাবশেষ দিয়েই এই মসজিদ নির্মিত। তবে মসজিদটির অনেকবার পুনর্নির্মাণ ঘটলেও মূল মসজিদটি আজও বিদ্যমান। বলাই বাহুল্য, বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন এই মসজিদটি গঙ্গা নদীর তীরে একটি প্রধান হিন্দু তীর্থস্থানে অবস্থিত।
আরও পড়ুন-বন্ধ ঘরে যোগশিক্ষার আড়ালে… ইন্দিরা-যোগগুরুর সম্পর্ক নিয়ে ফিসফাস চলে আজও
১৩১৫ সালে, মসজিদের পূর্ব দিক বরাবর মাত্র কয়েক গজের দূরত্বেই, একটি খোলা উঠানের উপরে একটি দরগাও নির্মাণ হয়ে। দুই কক্ষ বিশিষ্ট এই দরগার ছাদটি ইতিমধ্যেই ধসে পড়েছে। মসজিদের পশ্চিম দিকে রয়েছে জাফর খান ও তাঁর স্ত্রীর সমাধি ক্ষেত্র। জাফর খান ও তাঁর স্ত্রী ছাড়া আরও দু’টি কবরের দেখা মেলে। সেগুলি জাফর খানের দুই ছেলে আইন খান গাজী এবং ঘাইন খান গাজীর কবর। প্রসঙ্গত, মনে করা হয় জাফর খান গাজীর পুত্রবধূ ছিলেন হুগলির রাজকন্যা। তুর্কি সেনাপতি বাংলায় কেবল নিজের বসতিই স্থাপন করেননি, এখানকার স্থানীয় জনগণের সঙ্গেও মিশে গেছিলেন। বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে তিনি আজও এক রহস্যময় ব্যক্তিত্ব। কেবল একজন মুসলিম যোদ্ধা নন, বাঙলার মানুষের কাছে তিনি পরিচিত গঙ্গার অন্যতম সাধক হিসেবেও। নিজ দক্ষতাতেই বাংলায় মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে সম্প্রীতির সেতুবন্ধন করেছিলেন জাফর।
তাঁর নির্মিত মসজিদের উত্তর দেয়ালে দশাবতারের চিহ্ন পাওয়া যায়, যার থেকে অনুমান করা হয় মসজিদ নির্মাণের আগে সেটি একটি বিষ্ণু মন্দির ছিল। দরগার অভ্যন্তরে, এমনকী পবিত্র সমাধিতেও সংস্কৃতে খোদাই করা শিলালিপি নজরে আসে, যেখানে রামায়ণ এবং মহাভারতের দৃশ্যগুলি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মসজিদের পূর্ব দরজাটি যে মন্দিরের প্রবেশদ্বার ছিল একথা স্পষ্ট। স্থাপত্যের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ, অন্যদিকে ‘মঙ্গল ঘাট’ মন্দিরের দেয়ালে নকশায় পূর্ণ। উত্তর দিকে থাকা একটি দরজাতেও মন্দিরের স্থাপত্য ও নকশার হদিশ মেলে। এই মসজিদের চারপাশটাই মন্দিরের দরজায় ঘেরা। এই মসজিদে বৈদিক অনাহত চক্রের একটি প্রাচীর পাওয়া যায়। আশ্চর্যজনক সেই কাঠামোটি হিন্দু মন্দির বা মুসলিম সমাধির সঙ্গে কোনওভাবেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
স্থানীয় মানুষের মুখে শোনা যায়, ত্রিবেণীতে বসতি স্থাপনের পর জাফর খান গাজী সংস্কৃত শিখেছিলেন। একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দুর মতোই প্রতিদিন গঙ্গার কাছে প্রার্থনা করতেন এবং ‘গঙ্গাষ্টক স্তোত্র’ পাঠ করতেন জাফর। অনেকের মতে এ ছিল তাঁরই রচনা। জাফর খান গাজীর সমাধিতে যে শিলালিপিটি পাওয়া যায় পরবর্তীতে তা এইচ বেলোচম্যান অনুবাদ করেন। সেই অনুবাদ থেকে জানা যায় সেখানে লেখা ছিল, খান সিংহের সিংহ প্রতিটি অভিযানে ভারতের শহরগুলি জয় করে এবং ক্ষয়প্রাপ্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি পুনরুদ্ধার করে আবির্ভূত হয়েছে এবং তিনি তাঁর তরবারি এবং বর্শা দিয়ে কাফেরদের মধ্যে অবাধ্যতাকে ধ্বংস করেছেন, দুঃস্থদের সাহায্য করার জন্য তাঁর সম্পদের ভান্ডার বিলিয়ে দিয়েছেন। আসলে শুধু সম্পদ নয়, ভালোবাসা বিলোতেও বাংলা ছিল অকৃপণ। এক সাহসী তুর্কি যোদ্ধাও তাই বাংলাকে জয় করতে এসে পেলব প্রেমে পড়ে যান এই ভূমির। এই ভূমিতেই কোথাও মিশে রয়েছেন জাফর, জাফরের সম্প্রীতির কাহিনি।