ড্রাগন কি শুধুই কল্পনা? বিজ্ঞানীদের যে দাবি ভেঙে দিচ্ছে সমস্ত ধ্যানধারণা...

Myths of Dragon: যে সময় এই পৌরাণিক কাহিনি বা মিথ তৈরি হচ্ছে সেই সময়ে কিন্তু সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সুযোগও ছিল না তেমন!

বিশ্বের যে কোনও প্রান্তেই এমন কিছু গল্পকথা শোনা যায় যা শিকড়ে খানিক একই। গল্পের চরিত্র পালটায়, ভূগোল পালটায়, কিন্তু কোথাও ঠিক একটা সুতো যেন লেগে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার পৌরাণিক, লোককাহিনিতে তাই দেখা যায়, অদ্ভুতভাবে মিল রয়েছে ড্রাগন নামের এক প্রাণীর। ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা এবং আমেরিকা মহাদেশের প্রাচীন কিংবদন্তিগুলিতে লম্বা লেজ এবং হিংস্র চেহারার খানিক কুমির আকৃতির এক প্রাণীর চিত্র দেখা যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সভ্যতায় এভাবে 'ড্রাগন' চরিত্রটিকে কল্পনা করেছে মানুষ? বাস্তবে তো কখনই ছিল না এই প্রাণীটি! নাকি ছিল?

প্রথমত, সমস্ত ড্রাগন যে একই রকম, এমনটা অনুমান করা খুবই ভুল। মধ্যযুগের ইউরোপের ড্রাগনগুলি ছিল দৃঢ় দেহ, বাদুড়ের মতো ডানা এবং শিংওয়ালা, নিঃশ্বাস দিয়ে আগুন বেরনো টিকটিকি জাতীয় প্রাণী। তাদের সাধারণত অশুভ প্রাণী হিসাবেই দেখা হতো। লোককাহিনি অনুযায়ী, প্রায়ই একজন সাহসী নায়ক ড্রাগনকে হত্যা করে তার সম্পদের ভাণ্ডার ছিনিয়ে নেয় বা আতঙ্কিত শহরবাসীকে শান্তি দেয়, মুক্তি দেয়- এমনটাই দেখা যায়। এমনকী ইউরোপিয় ড্রাগনগুলির ছবির মধ্যেও এদের বৈচিত্র্য লক্ষণীয়।

আরও পড়ুন- পিরানহা নয়, বিশ্বের প্রাচীনতম হ্রদে সত্যিই বাস ‘মানুষখেকো’ মাছের?

পূর্ব এশিয়ার সংস্কৃতিতে, ড্রাগনের ভূমিকা অবশ্য সামান্য ভিন্ন। এই ড্রাগনগুলি আরও রহস্যময়। এখানকার ড্রাগনগুলি শক্তি, ক্ষমতা এবং সৌভাগ্যের প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। চিনের সংস্কৃতির একটি সুপরিচিত ড্রাগন হলো তিয়ানলং বা মহাকাশীয় ড্রাগন যা মেঘের মধ্যে ভেসে যায় এবং স্বর্গকে রক্ষা করে।

মেসোআমেরিকান সংস্কৃতির একটি দেবতা রয়েছে যার নাম Quetzalcóatl, যার অর্থ 'পালকওয়ালা সাপ'। এই ড্রাগন-সদৃশ দেবতার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে মেসোআমেরিকানদের আধ্যাত্মিক বিশ্বাসে। স্থানীয় বিশ্বাসে মানবজাতির সৃষ্টিতে এই ড্রাগনের ভূমিকা রয়েছে।

পার্থক্য রয়েছে ঠিকই, কিন্তু একটি বিষয় এড়িয়ে গেলে চলবে না। পৌরাণিক এই ড্রাগনদের মধ্যের সাদৃশ্যগুলি কিন্তু যথেষ্ট লক্ষণীয়। মনে রাখতে হবে, এই সংস্কৃতিগুলি সবই কিন্তু ভৌগলিকভাবে পৃথক, পৃথক জায়গার। যে সময় এই পৌরাণিক কাহিনি বা মিথ তৈরি হচ্ছে সেই সময়ে কিন্তু সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সুযোগও ছিল না তেমন! তাহলে বিশ্বজুড়ে নানা সংস্কৃতিতে 'ড্রাগন' বিষয়টি এল কেমন করে?

স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ধ্রুপদী লোককাহিনিবিদ এবং প্রাচীন বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ অ্যাড্রিয়েন মেয়রের যুক্তি অনুযায়ী, প্রাচীন মানুষ বিলুপ্ত প্রাণীদের জীবাশ্মের ভুল ব্যাখ্যা করার পরেই এই জাতীয় পৌরাণিক প্রাণীদের জন্ম। বিশেষ করে, সেই সময় গ্রিফিনদের কল্পনা করা হয়। গ্রিফিন হচ্ছে এমন একটা প্রাণী যার মাথা আর ডানা ঈগলের মতো, দেহটা সিংহের মতো কিন্তু পা গুলো আবার ঈগলের মতো। টিরানোসরাস রেক্সের প্রাগৈতিহাসিক অবশেষ বা জীবাশ্ম আবিষ্কার হয়। তখন অত বড় প্রাণীটা যে আসলে কেমন দেখতে, কীভাবে এমন প্রাণী হওয়া সম্ভব এত বিশদে জানার অবকাশই বা কই! তাই সেই জীবাশ্মকে ভয়ঙ্কর ড্রাগন-সদৃশ জন্তু হিসেবে কল্পনা করে নেওয়া কিন্তু কঠিন নয়।

আরও পড়ুন- দেওয়ালে, দরজায় সর্বত্র আঁকা পুরুষাঙ্গ! ভুটানের এই রহস্যময় রীতির আসল কারণ কী?

আরেকটি তত্ত্ব বলছে, ড্রাগন আসলে মানুষের মনের গভীরে থাকা একটি আর্কিটাইপ। অ্যান ইনস্টিনক্ট ফর ড্রাগনস বইতে সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ববিদ ডঃ ডেভিড ই জোনস যুক্তি দেন যে, ড্রাগন সম্পর্কে পৌরাণিক কাহিনিগুলি এত সাধারণ কারণ আমরা বিপজ্জনক শিকারি সম্পর্কে আমাদের মনে একটি ছবি কল্পনা করেছি, যে কল্পনা শতাব্দী ধরে বিবর্তিত হয়েছে।

জোনসের মতে, আমাদের প্রাথমিক পূর্বপুরুষরা বন্য প্রাণীদের সহজাতভাবে ভয় পেতে শিখেছে এমন অনেক মোটিফ রয়েছে। এই আদিম প্রবৃত্তির ফলে আমাদের কল্পনা একটি প্রত্নতাত্ত্বিক প্রাণী তৈরি করে নিয়েছে আমাদের অবচেতনে যা কুমির, সাপ, শিকারি পাখি এবং বাঘ বা সিংহের সমস্ত হিংস্র বৈশিষ্ট্যগুলিকে একত্রিত করে তৈরি।

তবে পৌরাণিক এই চরিত্রের নেপথ্যের কারণ যাই হোক না কেন, ড্রাগন স্পষ্টতই বিবিধ সভ্যতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। তারা হাজার হাজার বছর ধরে সংস্কৃতির শিকড়ে ড্রাগনদের গল্প এখনও সতেজ। অনেকের কাছেই এখনও মুগ্ধতার বিষয় ড্রাগন, কল্পকাহিনির সবচেয়ে জনপ্রিয় এক অংশ, তা সে হবিট এবং হ্যারি পটার সিরিজ হোক বা গেম অফ থ্রোনস, এমনকী পোকেমন।

More Articles