দেওয়ালে, দরজায় সর্বত্র আঁকা পুরুষাঙ্গ! ভুটানের এই রহস্যময় রীতির আসল কারণ কী?
Bhutan Phallus Painting: ভুটানে গৃহপ্রবেশের সময়, পুরুষাঙ্গের চিহ্নগুলি ছাদের চারটি কোণে এবং একটি বাড়ির ভিতরে স্থাপন করা হয়।
একটা দেশজুড়ে শুধুই পুরুষাঙ্গ! ঘরে দরজায়, বাইরের পাঁচিলে, রেস্তোরাঁয়, মাঠের ধারে কেবল থই থই পুরুষাঙ্গ! দরজা, বাড়ি এবং মন্দির সর্বত্র আঁকা বা ভাস্কর্যে দেখা মিলবে অসামান্য শিল্পকর্মের যা আসলে পুরুষাঙ্গের ছবি। নানা ভঙ্গিমাতে আঁকা নানা রকমের পুরুষাঙ্গ। কিছু কিছু ছবি অযত্নে আঁকা, কিছু কিছু আবার এতটাই নিখুঁত যে তাতে চুল, চোখ (হ্যাঁ, সেরকমও আছে) এবং বীর্যও আঁকা হয়েছে সূক্ষ্মভাবে। লিঙ্গকেই করে তোলা হয়েছে আস্ত দেহ বা মুখ যাতে চোখ, চুল আছে এবং মুখ থেকে সাদা পদার্থ বের হচ্ছে। ভুটান এমন এক দেশ যেখানে পুরুষাঙ্গের এমন প্রদর্শন কোনও অশ্লীলতা নয়।
তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের বজ্রযান শাখার এক নিবিড় ঘাঁটি ভুটান। হিমালয় পর্বতের গায়ে সেঁটে থাকা এই দেশ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাকি বিশ্বের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজস্ব ছন্দে এগিয়ে চলেছে। ভুটান এতটাই নির্জন দেশ যে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এখানে কোনও রাস্তা ছিল না এবং ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ইন্টারনেট সংযোগও ছিল না। ভুটানের দৈনন্দিন জীবন তাই এখনও প্রাচীন ঐতিহ্য এবং বিশ্বাসের শিকড়ে বাঁধা। এখানে, ডিভাইন ম্যাডম্যান নামে পরিচিত একজন সন্ন্যাসীর উপরই আস্থা মানুষের যিনি তাঁর ভক্তদের সঙ্গে যৌন মিলনের মাধ্যমে আশীর্বাদ দিতেন এবং এই সমস্ত পুরুষাঙ্গের প্রতীক আসলে এক প্রাচীন বিশ্বাস ও পরম্পরার অংশ।
ভুটানের সংস্কৃতিতে প্রায়ই এমন চরিত্রদের কথা শোনা যায় যারা বজ্রযান শিক্ষাকে এক অদ্ভুত উপায়ে বয়ে নিয়ে গিয়েছেন বা সমর্থন করেছেন। তাঁদের এই সমর্থনের প্রকৃতি এমনই যা অন্য সংস্কৃতির মানুষদের কাছে উদ্ভট ঠেকতেই পারে। এই জনপ্রিয় চরিত্রগুলির মধ্যেই রয়েছে আটসার – মুখোশ পরা কৌতুক অভিনেতা যারা নিজেদের 'প্রভু'দের প্রতিনিধিত্ব করেন, সেই প্রভুদের বাণী ছড়িয়ে দেন। আর এই প্রচারের বা শিক্ষার হাতিয়ার হচ্ছে একটি বড়, হাতে তৈরি লিঙ্গ। আটসাররা বৌদ্ধধর্মের নানা জ্ঞানের কথা প্রচার করেন বিভিন্ন উৎসবে।
একইভাবে, রয়েছেন ডিভাইন ম্যাডম্যান ওরফে ড্রুকপা কুয়েনলি। ড্রুকপা আসলে একজন দার্শনিক। ড্রুকপা ১৫ শতকে ভুটান ভ্রমণ করেন এবং নিজের 'প্রজ্ঞার জ্বলন্ত বজ্র' অর্থাৎ নিজের লিঙ্গ ব্যবহার করে নাকি রাক্ষসদের হত্যা করেছিলেন। প্রায় ৫,০০০-এরও বেশি নারীকে ড্রুকপা দেখিয়েছিলেন নির্বাণ লাভ করতে হলে ব্রহ্মচর্যের প্রয়োজন নেই।
কিংবদন্তি অনুযায়ী, ড্রুকপা তাঁর বৌদ্ধ শিক্ষা প্রচার করার জন্য একটি নতুন জায়গা খুঁজছিলেন। নতুন অবস্থান চিহ্নিত করতে তিব্বত থেকে একটি তির ছোঁড়েন তিনি। তিরটি এসে পড়ে বর্তমানে পুনাখার ছিমি লাখাংয়ের কাছে। এখন সেখানেই তাঁর মঠটি রয়েছে। ভুটানে আসেন ড্রুকপা। তির অনুসন্ধানের সময় ড্রুকপার সঙ্গে দেখা হয় একজন যুবতীর। সেই মহিলার সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত হন ড্রুকপা এবং যুবতীকে সন্তানধারণের 'আশীর্বাদ' দেন। ছিমি লাখাংকে অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করা হয়। এখন এখানে একটি প্রাচীন ধনুক এবং তিরের পাশাপাশি ১০ ইঞ্চির হাতির দাঁত এবং কাঠের পুরুষাঙ্গের প্রতীকও রয়েছে।
আরও পড়ুন- ২,০০০ বছর আগেও ছিল সেক্স টয়! ৭ ইঞ্চির প্রাচীন ‘ডিলডো’ আবিষ্কার গবেষকদের!
ভুটানে আসার পর, লামা ড্রুকপা দেশ জুড়ে ভ্রমণ করেছিলেন। এই সফরেই তিনি ভুটানের কঠোর রীতি এবং সামাজিক গোঁড়া রীতিনীতিকে বুঝতে পারেন। জনগণকে প্রচলিত ধ্যানধারণা থেকে মুক্তি দিতে তিনি বুদ্ধের সত্যিকারের শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁর নানা উদ্ভট আচরণই তাঁকে 'দ্য ডিভাইন ম্যাডম্যান' নামে পরিচিত করে তোলে। উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে নিজের অশ্লীল কবিতা, যৌন হাস্যরসের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ করেন এবং ঐতিহ্যকে বদলে দেওয়ার রীতি প্রচলন করেন।
ভুটানের মানুষদের কাছে ড্রুকপা একজন 'রক স্টার-দার্শনিক'। ড্রুকপা কুয়েনলি ওয়াইন, মহিলা এবং গান পছন্দ করতেন এবং তিনি তাঁর জীবনে এসব ছেড়ে কখনই বেরিয়ে আসতে পারেননি। এখন সারা দেশ জুড়ে প্রদর্শিত পুরুষাঙ্গের চিত্রগুলিতে আসলে ডিভাইন ম্যাডম্যানের উত্তরাধিকারই ফুটে ওঠে যেন। বাড়ির বিমগুলিতে খোদাই করা বা দেওয়ালে আঁকা, এই খাড়া লিঙ্গগুলির জ্বলন্ত চোখ এবং ভয়ঙ্কর বীর্যপাত নাকি অশুভ আত্মাকে ঠেকায়। পুরুষাঙ্গ উর্বরতারও প্রতীক। পুনাখা শহরে রয়েছে ড্রুকপা কুয়েনলির প্রতিষ্ঠিত মঠ ছিমি লাখাং। এই মঠে গর্ভধারণ করতে ইচ্ছুক বৌদ্ধরা প্রতিনিয়ত পরিদর্শন করেন। এখানে, ভক্তরা একটি বিশাল কাঠের লিঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে ধন্য হন।
আরও পড়ুন- লিঙ্গের দৈর্ঘ্যে ভারতের অবস্থান বিশ্বে কোথায়? যৌনাঙ্গের মাপ নিয়ে অবাক করা তথ্য এল সামনে
সংস্কৃতির এক অন্য অংশ পুরুষাঙ্গকে শাসন ও দমনের প্রতীক হিসেবেই মনে করে। ভুটানিদের কাছে এই প্রতীক একেবারেই ভিন্ন। তাঁদের কাছে পুরুষাঙ্গ এমন এক শক্তি যা ভালো এবং মন্দ দুই কাজেই ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রজ্ঞা দিয়ে ব্যবহৃত হলে পুরুষাঙ্গ হলো এক সৃজনশীল, ইতিবাচক শক্তি। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত পুরুষাঙ্গ মানুষকে বন্য, লম্পট প্রাণীতে পরিণত করে। পুরুষাঙ্গ আসলে পুরুষদের শক্তি নিয়ন্ত্রণ এবং ইতিবাচকতার এক অনন্য প্রতীক, ভুটানিরা এই শক্তিকে মানেন, চর্চা করেন, জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রাখেন।
ভুটানে গৃহপ্রবেশের সময়, পুরুষাঙ্গের চিহ্নগুলি ছাদের চারটি কোণে এবং একটি বাড়ির ভিতরে স্থাপন করা হয়। বাড়ির ছাদে কাঠের খোদাই করা পুরুষাঙ্গ ভরা একটি ঝুড়ি তোলা হয়। বাড়ির মালিক ছাদে ঝুড়ি ওঠাতে সাহায্য করার জন্য পুরুষ ও মহিলাদের নিয়োগ করেন। এই সময়, বিশেষ গান গাওয়া হয়। পুরুষাঙ্গগুলি একটি ছুরি দিয়ে বাঁধা এবং পাঁচটি ভিন্ন রঙে আঁকা হয়, যা পাঁচটি ঐশ্বরিক অভিব্যক্তিকে প্রকাশ করে। পশ্চিমে রাখা হয় শান্তি, বিশুদ্ধতা এবং সম্প্রীতির প্রতীক একটি সাদা ছোরা, সম্পদ এবং ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে একটি লাল রঙের ছোরা দক্ষিণদিকে স্থাপন করা হয় এবং উত্তরে সুরক্ষার প্রতিনিধি হিসেবে একটি সবুজ রঙের ছোরা স্থাপন করা হয়। পঞ্চম খঞ্জর, যা সাধারণত নীল রঙের হয় তা জ্ঞানের প্রতীক। এটি বাড়ির মধ্যে স্থাপন করা হয়।