পিরানহা নয়, বিশ্বের প্রাচীনতম হ্রদে সত্যিই বাস 'মানুষখেকো' মাছের?
Lake Baikal Cannibal Fish: মাছের স্বচ্ছ দেহ, আঁশ নেই একটিও, লম্বায় প্রায় ২১ সেন্টিমিটার বা ৮.৩ ইঞ্চির কাছাকাছি।
হ্রদের বয়স ২৫ মিলিয়ন বছর! বিশ্বের প্রাচীনতম হ্রদটি রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব সাইবেরিয়ায়, ২৫ মিলিয়ন বছর আগে থেকে। বিশ্বের প্রাচীন হওয়ার মুকুট নয় স্রেফ, পৃথিবীর গভীরতম হ্রদ হওয়ার শিরোপাও রয়েছে এর। ছোটবেলায়, ইস্কুলের পাঠ্যবইয়ে এই হ্রদের নাম সকলেই পড়েছেন। সাইবেরিয়ার বৈকাল হ্রদ ১,৭০০ মিটার, মানে ৫,৬০০ ফুট গভীর, বিশ্বের প্রায় ২০ শতাংশ অহিমায়িত স্বাদু জল ধরে রেখেছে বৈকাল। তবে পাঠ্যে অনেকেরই অজানা ছিল এই হ্রদে বসবাসকারী মাছেদের কথা, বলা ভালো, 'মানুষখেকো' মাছেদের কথা। বৈকাল হ্রদের নীচে স্পঞ্জ, লিম্পেট, মাছ আর ব্যাকটেরিয়ার ছড়াছড়ি। বিশ্বাস করা হতো, লুসুদ-খান নামের একটি ড্রাগনও নাকি বৈকালের নীচে লুকিয়ে ছিল, যদিও প্রমাণ মেলেনি কখনই।
বৈকাল হ্রদে অনেক অদ্ভুত এবং বৈচিত্র্যময় প্রজাতির বাস, সেই কারণেই হ্রদটিকে 'রাশিয়ার গ্যালাপাগোস' নামেও ডাকা হয়। প্রতি বছর পাঁচ মাস বরফের পুরু স্তরে এই হ্রদ ঢাকা থাকলেও, হ্রদে যে বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠেছে তা বিস্ময়কর। বিজ্ঞানীদের অনুমান, এই হ্রদে বসবাসকারী ৮০ শতাংশ উদ্ভিদ এবং প্রাণীই এই গ্রহের অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এই বিরল প্রাণীদের মধ্যেই অন্যতম হলো বৈকাল অয়েলফিশ যা গোলোমিয়াঙ্কস নামেও পরিচিত। মাছের স্বচ্ছ দেহ, আঁশ নেই একটিও, লম্বায় প্রায় ২১ সেন্টিমিটার বা ৮.৩ ইঞ্চির কাছাকাছি। মূলত দু'টি প্রজাতি রয়েছে এই অয়েলফিশের, C. baikalensis এবং C. dybowski।
আরও পড়ুন- সায়ানাইডের চেয়ে ১২০০ গুণ বিষাক্ত! এই মাছ খাওয়া মাত্রই কোমাতে স্বামী, স্ত্রীর মৃত্যু!
অদ্ভুত চেহারা ছাড়াও আরও কিছু অস্বাভাবিক কারণ গভীর হ্রদের বাস্তুতন্ত্রে এদের ভূমিকা বিশাল। বিশ্বের সবচেয়ে গভীর মিঠে জলের মাছ এরাই। আর মিষ্টি জলের এই মাছই নাকি 'নরখাদক'! আসলে ক্যানিবাল শব্দটির বাংলা করলে দাঁড়ায় মানুষখেকো। কিন্তু ক্যানিবাল আসলে তারাই যারা নিজেদের মতো প্রজাতির মাংস খেয়ে নেয়। প্ল্যাঙ্কটোনিক কোপেপড, অ্যাম্ফিপড এবং লার্ভার মতো খাবার ছাড়াও এই মাছেরা নিজেদের বাচ্চাদেরও গিলে ফেলে। নিজের বাচ্চা খেয়ে ফেলার জন্যই এই মাছেদের বলা হয় 'ক্যানিবাল'। মানুষ খেতে মোটেও পছন্দ করে না এই মাছ।
সারা বছর ধরে, বৈকাল হ্রদের তাপমাত্রা বেশ নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়। গ্রীষ্মে হ্রদের কিছু এলাকায় জলপৃষ্ঠের স্তরটি ১৬° সেলসিয়াসের কাছাকাছি উষ্ণ হতে পারে। তবে জানুয়ারি থেকে মে মাসের শুরুর দিক পর্যন্ত চার মাস বরফে ঢাকা থাকে এই হ্রদ। গড়ে প্রায় ০.৫ থেকে ১.৪ মিটার (১.৬ থেকে ৪.৬ ফুট) বরফে মোড়া থাকে বৈকাল। কিছু এলাকায় হামক, বরফের জমাট গিঁটের মতো অংশ জলপৃষ্ঠের উপরে উঠে যায়, এটি ২ মিটারের (৬.৬ ফুট) মতো পুরু হতে পারে।
শীতের মাসগুলিতে বরফের বলয়ের জন্য দীর্ঘকাল ধরে বিখ্যাত এই হ্রদ। বৈকালের এই বরফের বলয় এতই বিশাল যে মহাকাশ থেকেও তাদের দেখা যেত। NASA ২০২০ সালে এই বিশাল বলয়ের রহস্য সমাধান করে।
আরও পড়ুন- চুনো পুঁটি থেকে রাঘব বোয়াল, ৫১৬ বছরের এই মেলা মাছপ্রেমীদের কাছে স্বর্গ!
স্যাটেলাইট এবং সেন্সর থেকে সংগৃহীত তথ্য ব্যবহার করে আবিষ্কৃত হয়েছে যে, হিমায়িত হ্রদের পৃষ্ঠের গভীরের উষ্ণ ঘূর্ণিগুলি ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘোরে, এই ঘূর্ণিগুলি কড়া শীতের মাসগুলিতেও জলের উষ্ণ প্রবাহ তৈরি করছে। স্রোতের শক্তি কেন্দ্রেই সবচেয়ে দুর্বল, তাই পৃষ্ঠের বরফ জমেই থাকে। তবে ঘূর্ণির বাইরের শক্তিশালী স্রোত বরফকে গলাতে পারে।
বরফ জমা হ্রদের উপর দিয়ে যদি কেউ গাড়ি নিয়ে যেতে চান, তাহলে এই বলয়গুলি তাঁদের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। স্যাটেলাইটের দৃষ্টিকোণ থেকে বরফের এই বলয় স্পষ্ট বোঝা যায় ঠিকই, কিন্তু হ্রদে নেমে স্থল স্তরে এদের চিহ্নিত করা বেশ কঠিন। ফ্রান্সের টুলুসে ফেডারেল ইউনিভার্সিটির ল্যাবরেটরি ফর স্টাডিজ ইন স্পেশিয়াল জিওফিজিক্স অ্যান্ড ওশানোগ্রাফির (LEGOS) সহকারী অধ্যাপক আলেক্সি কওরায়েভ, নিয়মিতভাবে তাঁর গবেষক দলের সঙ্গে নতুন নতুন গঠিত বরফের বলয়গুলির অবস্থান চিহ্নিত করে একটি ওয়েবসাইটে আপডেট করেন।