ভিড় ঠাসা মণ্ডপে দায়িত্বের উর্দি, আইনের ছকে বাঁধা পুলিশের পার্বণ

Durgapuja of Police: অনেক ক্ষেত্রে কাজের চাপে পরিবারকেই নিজের কর্মস্থলে ডেকে নেওয়ার চেষ্টা করতে হয়। পুজোর ক'টা দিন হয়তো তাদের সঙ্গে থাকা যায়, সমস্ত দায়িত্ব, কাজ সামলেও।

জাগো দুর্গা, জাগো মহিষাসুরমর্দিনী! বীরেন্দ্রকৃষ্ণ-কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ আর এই গানের সুরেই মনে হয় পুজো এসেছে। আলোকময় প্যান্ডেল, থিম-সাবেকি সূক্ষ্ম লড়াই আর দেদার আড্ডার পরশে মন ভালো হয় প্রায় সকলেরই! প্রত্যেক দিনের কাজ, চিন্তা আর একাধিক প্রিয়জনের থাকা না থাকার মধ্যেও পুজো কিন্তু আনন্দই বয়ে আনে সর্বত্র। ভালো কাটে আপনার পুজো, আমার পুজো। কিন্তু ওঁরা? কেমন কাটে ওঁদের পুজো? যাঁরা প্রত্যেক মুহূর্তে অন্যকে ভালো রাখার কর্তব্য পালনে অবিচল। পুলিশের পুজোর হালহকিকত জানতে ইনস্ক্রিপ্ট যোগাযোগ করেছিল এক পুলিশ আধিকারিকের সঙ্গে। ‘ঘর-সংসার’ সামলানো বিশ্বের কোটি কোটি কন্যার মতো তিনিও পালন করে চলেছেন পুলিশের দায়িত্ব। তিনি আসানসোল দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার অব পুলিশ (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) ইপ্সিতা দত্ত।

কেমন কাটে ইপ্সিতার পুজো? আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন সেই স্মৃতিই। ঈপ্সিতা জানালেন;

আমিও পুজো কাটাই, আমিও পুজোয় আনন্দ করি। কিন্তু ভিন্নভাবে। অনেকেই বলেন, এ আর এমন কী! আপনারা পুলিশ। চিকিৎসক, দমকল, সাংবাদিক-সহ একাধিক জরুরি ক্ষেত্রে চাকরি করেন, কর্তব্য পালন করেন শুধু! এগিয়ে যান তাই নিয়েই! হ্যাঁ, আমি অথবা আমার মতো হাজার হাজার মানুষ এই ধরনের পেশাতেই রয়েছেন। কিন্তু বহুবিধ পেশার মতো সেই কাজও আসলে কিন্তু মানুষের জন্য, জনগণকে ভালো রাখতে। চিকিৎসক সুস্থ করেন যেমন, উৎসবের আবহ তাঁর কাছে আর পাঁচটা দিনের মতোই, মানুষের সেবার জন্য। আর পুলিশ? পুলিশের আবার পুজো হয় নাকি! পুজোয় আপনি কেমন থাকবেন, আপনার পুজো নির্বিঘ্নে কাটবে কিনা, তাই নিশ্চিত করতেই তো তৎপর হই আমরা। আমাদের বিভাগের সিভিক ভলান্টিয়ার থেকে হোমগার্ড, কনস্টেবল থেকে আমি অথবা আমার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ- প্রত্যেকেই সরব হই, কঠিন হই আপনাদের জন্য। আপনাদের ভালো পুজোর তাগিদে।

আরও পড়ুন- শারদীয়া পুজোসংখ্যায় সাহিত্য হয়? নাকি গোটাটাই ঝোঁক?

দুর্গাপুজো বাঙালির কাছে বরাবরই বিশেষ। আর এই ‘পুলিশ’ আমি, এই ‘বাঙালি’ ইপ্সিতার কাছেও কিন্তু ভালোলাগার জায়গা, ইমোশনের জায়গা পুজো। পড়াশোনা আর নতুন জামায় স্বপ্নের মতো ছিল ছোটবেলার সবটা। পুজো এলেই ভর করত কত কিছু। বাড়িতে অতিথি, পরিবার-প্রিয়জন মিলিয়ে সে এক দারুণ ব্যাপার। আস্তে আস্তে বড় হলাম। পুজোর আনন্দ হল একটু অন্য রকম। স্কুল জীবনের বন্ধু, কলেজ জীবনের বন্ধু, সবমিলিয়ে পুজো মানেই যে দেদার পরিকল্পনা, এটা স্পষ্ট হয়েছিল তখন থেকেই। আমি তো প্রচুর ঠাকুর দেখতাম। বন্ধুদের সঙ্গে গুণে গুণে প্যান্ডেল ঘোরা ছিল দারুণ আনন্দের। সে যে কী মজার আর ভালোলাগার- এখন মিস করি খুব। তবে আপনারা যে ভালো করে পুজো কাটাচ্ছেন, এটাই আরও ভালো অনুভূতি দেয় রোজ। আগে পুজোয় বেরিয়ে ওই খাকি উর্দির মানুষগুলোকে দেখতাম, মাঝে মাঝে ভিড় প্যান্ডেলে একটু আধটু বকুনিও জুটত। ‘তাড়াতাড়ি সরুন’ বলায় রাগ হত খুব। সেই খাকি উর্দি গায়ে উঠল আমারও। ক্রমশ পূরণ করলাম স্বপ্ন। একটা সময় ভেবেই নিয়েছিলাম, হলে প্রশাসনের কিছুই হব। মানুষের জন্য কাজ করার এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর নেই! পশ্চিমবঙ্গ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাশ করলাম। ২০১৯-এ স্বপ্নপূরণ। রাজ্য পুলিশের আধিকারিক হিসেবে যোগ দিলাম কাজে। হলাম ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ। তারপর, বর্তমানে দুর্গাপুর-আসানসোল পুলিশ কমিশনারেটের স্পেশাল ব্রাঞ্চ আমার দ্বিতীয় ঘর। সেখানেই অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ কমিশনার হিসেবে কাজ করছি।

যাইহোক, ২০১৯ সালে কাজ শুরুর বছরের পুজো কাটল। ঠিক তারপরেই এল সংকট। হঠাৎ উপস্থিত হল করোনা! নাম না শোনা দানবাসুরে ঢাকল চারপাশ। চাপ আর দায়িত্ব বাড়ল আমাদের। পুলিশের করোনা যেমন চিন্তার পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, বিপরীতভাবে করোনার সময়ে পুলিশের ভূমিকাও ছিল প্রশংসার। স্বাস্থ্যকর্মীসহ অন্যান্য জরুরি পেশার সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গেই আমাদেরও চ্যালেঞ্জ ছিল এই যুদ্ধ জেতার। এর মধ্যেই কাটল পুজো। আদলতের নির্দেশ! ভিড় নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা, করোনা ছড়াতে না দেওয়া, মানুষকে বোঝানো- ২০২০ সালের দুর্গাপুজো যেন শিখিয়ে দিয়েছিল অনেককিছুই। ২০২১-এ তখন করোনার কালো মেঘ কাটছে খানিকটা। পুজো কাটল। প্রায় একই ভাবে দায়িত্ব পালন করলাম আমরা। ২০২২, আশার আলো বেড়েছে। নিরন্তর গান, আলো আর ভিড়ের ছবিতে উৎসবমুখর হচ্ছেন মানুষ। আর আমরা? এই উৎসবে ভালো থাকার চেষ্টা করছি রোজ। প্রত্যেক মুহূর্তে মানুষের কথা ভাবা, নিরাপত্তা নিয়ে কাটাছেঁড়া করেই কাটাচ্ছি পুজো। তাহলে কি ভালো লাগে না? ভালো নেই? না, এই কাজ, এই অনন্য ভূমিকা পালনেই আমাদের দারুণ আনন্দ। এখানেই আমিও অনন্যা।

আসলে এই চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই ছুটির সঙ্গে আপোস করতে হয়েছে নিরন্তর। আর উৎসব এলে তো আমাদের ছুটি বন্ধই হয়ে যায় ছটপুজো অবধি। ঠিক উৎসবের মরশুমে পুলিশের পুজো কেমন কাটে বুঝলাম তখন। আগে রাস্তায় ব্যস্ত থাকা পুলিশকর্মীকে দেখে মনে হয়েছে বারবার, ওঁরাও তো পুজোয় আনন্দ করতে পারেন! কিন্তু এখন ভালো লাগে যে, এই অন্যরকম পুজো কাটানোর সুযোগ পান না অনেকেই। আমরা পাবলিক সার্ভেন্ট, জনতাকে পরিষেবা প্রদানকারী। আমরা আইন-শৃঙ্খলা ঠিক রাখি যাতে সবাই নির্বিঘ্নে পুজোর কয়েক দিন আনন্দ করতে পারেন। তাই খারাপ লাগলেও তার মধ্যে একটা সন্তুষ্টি রয়েছে।

আরও পড়ুন- ‘মা’ ডাকে বলি, ডুবন্তকে দেবীর উদ্ধার, রহস্য-কথকতায় ভরা শীতলগ্রামের চৌধুরীদের দুর্গাপুজো

ত্যাগও করতে হয় বারবার! বন্ধু, পরিবার-পরিজনকে পুজোয় সময় দেওয়ার সুযোগ থাকে না একদম। মানুষের সঙ্গেই ঠাকুর দেখার আনন্দ যেন ভাগ করে নিই, এই বেশ ভালো আছি! অনেক ক্ষেত্রে কাজের চাপে পরিবারকেই নিজের কর্মস্থলে ডেকে নেওয়ার চেষ্টা করতে হয়। পুজোর ক'টা দিন হয়তো তাদের সঙ্গে থাকা যায়, সমস্ত দায়িত্ব, কাজ সামলেও।

আর একটা কথা বলা প্রয়োজন, পুজোয় এই মানুষকে ভালো রাখার তাগিদে কিন্তু পরিবারের সমর্থন খুবই জরুরি। আসলে পরিবারকে বুঝতে হয়, এই পেশায় কর্মরতদের কাজ, দায়িত্ব-কর্তব্য অন্যের তুলনায় ভিন্ন। এমন একটা চাকরি করেন তিনি, সেখানে সবটা অনেক আলাদা। আর এই সমর্থন, কাছের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার থাকলে উৎসবে সবকিছুর মধ্যেও একটু কম খারাপ লাগে। আসলে মহান ক্ষমতা আসে মহান দায়িত্ব-কর্তব্য থেকেই। আর আমরা সেটা করি বলেই আজও পুজোয় মানিয়ে নিয়েছি সব। সকলে আনন্দ করুন, ভালো থাকুন, এই তো সামান্য চাওয়া, অতল পথে লিখে দেব আনন্দের এই ধারা।

More Articles