'মা' ডাকে বলি, ডুবন্তকে দেবীর উদ্ধার, রহস্য-কথকতায় ভরা শীতলগ্রামের চৌধুরীদের দুর্গাপুজো

Burdwan Shitalgram Durgapuja: পাশেই রয়েছে ঐতিহাসিক ক্ষীরগ্রাম। সেটি ৫১ সতীপীঠের একটি যেখানে দেবী পার্বতীর একটি আঙুল পড়ে বলে জানা যায়। সেই মন্দিরে দেবী যজ্ঞদা রূপে পূজিত হন দুর্গা।

যা দেবী সর্বভূতেষু শান্তিরূপেণ সংস্থিতা..

এখানে মেঘের কোলেই বিচ্ছুরিত হয় আনন্দ, মাতৃরূপে শান্তির অমোঘ বাণী। এখানে দেবীকে ছাপিয়ে এক মেয়ে আসেন ঘরে। এই গ্রামে মায়ের কাছেই আদর পান মেয়ে। স্বর্গলোকের ঈশ্বর নন, বর্ধমানের চৌধুরী বাড়িতে মা দুর্গা থাকেন মেয়ে হয়েই। বঙ্গের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে থাকা দুর্গাপুজোর ইতিহাসে এই পুজো আজও মৌলিক-অভিনব-অনন্য। জমিদারি প্রথা, সামন্ততান্ত্রিক উদযাপনের আবহ ছাড়িয়ে এই পুজো এখনও সর্বজনীন, সকলের পুজো। কেন আর কীভাবে মৌলিক হয়ে উঠেছে ৩২০ বছরের বেশি বছর ধরে চলে আসা এই পুজো?

তখনও দেশের ছত্রে ছত্রে শাসন করছেন মুঘলরা। বর্গী হানার পর্ব ছাড়িয়ে দেশজুড়ে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে পুজো, সনাতন ধর্মের মানুষের অবস্থানের সংকটের অভিযোগের কথা ইতিহাস দাবি করলেও বর্ধমানের মঙ্গলকোট ব্লকের শীতলগ্রাম ছিল ভিন্ন। চৌধুরী বাড়ির সদস্যদের কথায়, তখন রায়বাড়ি আর চৌধুরী বাড়ির প্রভাব ওই অঞ্চলে। একদিন জানা গেল, দেবী দুর্গার প্রতিমা, মন্দির-সহ রায় বাড়ির বিরাট অংশ পুড়ে ছাই। গ্রামজুড়ে চাউর হল, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রায়বাড়ির পুজোয় ঘটেছে অনাচার! অমঙ্গলের পাপে এই সর্বনাশ হয়েছে ওই পরিবারে।

ঠিক এই পরিস্থিতিতেই শীতলগ্রামের চৌধুরী বাড়ির বড়কর্তা পেলেন স্বপ্নাদেশ। স্বপ্নে দেবী তাঁকে বললেন, তিনি তাঁর কাছে ফের পুজো পেতে চান। চৌধুরী বাড়িতে আসতে চান আবার। সেই স্বপ্নের সূত্রেই তিনি গেলেন বাড়ির কাছের এক দিঘির পাড়ে। সেখানেই পেলেন এক মাতৃ অবয়ব। তাই নিয়েই প্রতিষ্ঠা করলেন ঠাকুরদালানে। শুরু হল মায়ের পুজো। কিন্তু মেয়ের মতো করেই। সেই থেকে আজও বংশ পরম্পরায় চলে আসছে দুর্গার বাড়ির মেয়ের মতো করে আরাধনা।

এখানে দেবী একচালা। সন্তানদের নিয়ে পুজোর চারদিন আপ্যায়ন করা হয় তাঁকে। বাড়ির মেয়েকে ঠিক যেভাবে যত্নে রাখা হয়, ভোগ থেকে আদর- সবই চলে এই বাড়ির পুজোয়।

আরও পড়ুন- বনেদি আভিজাত্যে বিলুপ্তির পথে নীলকণ্ঠ পাখিরা! দশমীর দিনে কেন ওড়ানো হয় এই বিশেষ পাখি?

এই পুজোর রয়েছে আরও ইতিহাস। মূলত, ষষ্ঠীর দিন বেলতলায় বোধনের পরে সপ্তমীর দিন নবপত্রিকা স্নানের সময় সেই দিঘির জল ভরা হয় ঘটে। বিরাট শোভাযাত্রা করে সকলে একই রঙের পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে রওনা দেন ঘটে জল ভরতে। এই পুজোয় দু’টি ঘট থাকে। চরণঘট এবং শান্তিঘট। চরণঘটে মূল পুজো সম্পন্ন করেন বাড়ির কুল পুরোহিত। এরপর অষ্টমীর পুজো, অঞ্জলি এবং সন্ধিপুজোর সময় বলি হয় চৌধুরী বাড়িতে। পশুবলির রেওয়াজ কোনওকালেই নেই চৌধুরীদের মেয়ের পুজোয়, চালকুমড়ো বলি হয়।

এই বলি নিয়েও রয়েছে জনশ্রুতি। বলা হয়, পাশেই রয়েছে ঐতিহাসিক ক্ষীরগ্রাম। সেটি ৫১ সতীপীঠের একটি যেখানে দেবী পার্বতীর একটি আঙুল পড়ে বলে জানা যায়। সেই মন্দিরে দেবী যজ্ঞদা রূপে পূজিত হন দুর্গা। বলা হয়, ওই মন্দিরে বলির সময়ে ‘মা’ বলে চিৎকারের শব্দ শুনে চৌধুরীদের পুজোর বলি দেওয়া হত। পরবর্তীতে ওই একই শব্দে ভর করে বাকি নয়টি পুজোর বলি হত। আর সেই শব্দ শোনার জন্য গ্রামের আলপথ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন গ্রামের বহু বাসিন্দা। পরে সময় মেনে বলি হলেও সেই শব্দ শোনার প্রচলন চলে এসেছে গ্রামের কুলদেবতা সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে। এখনও সেই মন্দিরে বলির সময় ‘মা’ ডাকের শব্দ শুনে বলি হয় চৌধুরীদের বাড়িতে। এই মন্দিরেই রোজ পুজো পাঠানোর প্রথাও রয়েছে এই বাড়িতে।

এই পুজো নিয়ে গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে আছে বহু কথকতা। বলা হয়, চৌধুরীদের বাড়ির মেয়ে দুর্গা নাকি দেখা দেন মাঝে মাঝেই। কেউ কেউ বলেন, ঠাকুর দালানে সারাবছরই থাকেন মা দুর্গা। আবার বিসর্জনের দিন নাকি ঘটেছিল এক অলৌকিক ঘটনা! জানা যায়, বিসর্জনের সময় এক ব্যক্তি আটকে যান প্রতিমার বাঁশের কাঠামোর মধ্যে। ডুবে যান তিনিও। কিন্তু দেখা যায়, কিছুক্ষণ পরেই ওই ডুবন্ত ব্যক্তি উঠে আসছেন ঘাটে। তিনি দাবি করেন, ডুবন্ত অবস্থায় তাঁকে নাকি কেউ টেনে তুলেছেন। তবে সেই উদ্ধারকারীকে দেখেননি তিনিও।

আরও পড়ুন- বাগানের মাটিতে শিশুকন্যার অলীক পায়ের ছাপ! যেভাবে শুরু হল শিবপুরের রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো

এই পুজোর ভোগে থাকে মেয়েকে যত্নের ছাপ। বাড়ির সকলে মিলে ভোগ রান্না করেন। পুজোর পাঁচদিন অর্থাৎ দশমীর সকল পর্যন্ত নানা পদের নাড়ু, অন্নভোগ, ফল, মায়ের জন্য বিভিন্ন পদের মিষ্টি দেওয়া হয়। সবটাই নিরামিষ। এই প্রসাদ জোটে গ্রামের সকলের ভাগেই। দশমীর দিন ঘট বিসর্জনের পরে বাড়িতে আসে মাংস। আমিষ খাওয়া হয় সেদিন। বাদ যান না আগত কেউই। বিসর্জনের পরদিন মিষ্টি প্রদানের ব্যবস্থা এখনও করেন চৌধুরীরা।

ওই পরিবারের অন্যতম সদস্য তামসী চৌধুরী ইনস্ক্রিপ্টকে বলেন, “একটা সময় এমন অবস্থা হয়েছিল যে, আমাদের বাড়ির প্রায় সব জিনিস নিলামে ওঠে। জমিদার বাড়ির অবস্থা করুণ হয়। সেদিন কাঁসার বাসন বেচেও মায়ের পুজো করেছি আমরা। আজও সেই পরম্পরা, ইতিহাস বজায় রাখার চেষ্টা করি। অবারিত দ্বারে আমাদের মেয়ের পুজোয় আসতে বাধা নেই কারও। এখনও যতটুকু পারি সকলে মিলে, সব শরিকরা মিলে একই রাখি পুজো।”

এই পুজো এখনও জমায় ভিড়। শীতলপ্রসাদ নিতে হাজির হন শয়ে শয়ে মানুষ। পুজোর উপাচারে ঘটের গুরুত্ব এখানে বেশি। প্রতিমার সঙ্গেই মহাজাঁকজমকে ঘট আসে বাড়িতে। আবার বিসর্জনের সময় প্রতিমা নয়, ঘট বিসর্জন হয় আগে। বলিতেও রয়েছে অভিনবত্ব। সব মিলিয়ে বর্ধমানের চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজো এখনও যতটুকু বজায় রেখেছে, সবটার ছত্রে ছত্রে বিরচিত এক ইতিহাস, আচার আর সর্বজনীনতার মোক্ষম আবহ।

More Articles