শারদীয়া পুজোসংখ্যায় সাহিত্য হয়? নাকি গোটাটাই ঝোঁক?

Durga Puja Sharodiya: বাঙালির প্রথম শারদীয়া বের করেছিলেন কেশব চন্দ্র সেন। ‘ভারত সংস্কার সভা’ তখন তাদের বিখ্যাত সাপ্তাহিক ‘সুলভ সমাচার’ বের করত। হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত হল ১২৮০ বঙ্গাব্দে, অর্থাৎ ১৮৭৩ সালের পুজোয় তাঁরা একটি...

শরৎ যখন আসে তখন দোটানা। একদিকে বর্ষার রেশ, অপর দিকে শীতের ছোঁয়া। শরতের ছোট হয়ে আসা দুপুরে এককালে খুব মনখারাপ জমত। আশ্বিনের ফাঁকে ফাঁকে হেমন্তের উঁকি। চড়া রোদ, নীল আকাশ আর মেঘের তরঙ্গ। যখন তখন বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির হাত ধরেই মনখারাপের বায়না আসে। হঠাৎ কোনও একদিন দুপুর নামার ঠিক আগে ক্রিং ক্রিং। সাইকেলের ঘণ্টি। রোজ আসে নিশ্চুপে। দরজার তলা দিয়ে গলিয়ে দেয় কাগজ। বা ব্যালকনিতে ছুঁড়ে দেয়। কিন্তু আজ সে উপস্থিতি জানান দেয় কেন? সে আসলে নিজের না, উপস্থিতি জানান দিত একটি অন্য বস্তুর। শারদীয়া। শুকতারা আর আনন্দমেলা। আসত মোট দু’টিই। মফসসলে বাকি এক দু’টি শারদীয়া হয়তো লাইব্রেরি বা বন্ধু বান্ধবদের কাছ থেকে নিয়ে বাবা মায়েরা পড়তেন। কিন্তু সেগুলি ঘরে রাখা হত না। শুকতারার বাহাদুর, নন্টে ফন্টে, হাঁদাভোঁদা, বাঁটুল সবার আগে পড়া হয়ে যেত। কতদিনের অপেক্ষায় ক্ষীর জমেছে ধীরে ধীরে। সবটা মিলিয়ে স্বাদ হত অনবদ্য। তারপরে নানারকম বিভাগ। সামাজিক গল্প, ভূতের গল্প, গোয়েন্দা গল্প ইত্যাদি ইত্যাদি। আনন্দমেলায় পরের দিকে ফেলুদা, হর্ষবর্ধন—এইসব কমিক্স বেরোত। এ বছরও দেখলাম সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায় সমগ্র ‘চাঁদের পাহাড়’ নিয়ে গ্রাফিক নভেল বার করছেন। তবে তখন এত ভালো কাজ আরও সুলভ ছিল চলতি শারদীয় গুলিতে। এ কথা সত্যি। কিন্তু আজ আমরা এমন এক সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি, যে পুজোসংখ্যা ব্যাপারটা অনেকের কাছেই বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজেই পুজোসংখ্যার সেকাল ও একালের মধ্যে একটা তুলনা এসেই পড়ে। এখন মনে রাখা দরকার এই এই 'একাল' এবং 'সেকাল' কোনও জল-অচল ক্ষেত্র নয়, দু’টিই আপেক্ষিক এবং সদা-পরিবর্তনশীল। কাজেই বিভিন্ন প্রবন্ধ ক্ষতিয়ে দেখে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করা যাক।

‘পুজোসংখ্যার সেকাল একাল’ বর্তমানে বহুচর্চিত বিষয়। ফলে দীর্ঘদিন ধরে তাদের লেখকদের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছে তাঁদের প্রিয় পত্রিকার নাম, রুচি, বিষয়বস্তু। বদলে যেতে বাধ্য। এ নিজেও একটা বেশ আগ্রহের বিষয়। লেখকের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকার কাটতি, জনপ্রিয়তা, লেখার বিষয়, লেখার মান— বদলে যায় সবটাই। যেহেতু বইবাজার মূলত কলকাতাকেন্দ্রিক, বেশিরভাগ নাম কলকাতার পত্রিকারই। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যখন 'পূজা সংখ্যা' প্রবন্ধ লেখেন, তখন পুজোসংখ্যা ছিল 'নতুন সংক্রামক প্রথা', বাঙালি পাঠকের যৌথমানসে যার প্রভাব “মোটেই বহিরঙ্গ বলিয়া উপেক্ষিত নহে।” সন্দীপ কুমার দাঁ যখন এই নিয়ে আলোচনা করছেন দেখা যাচ্ছে হরেদরে তখন পুজো সংখ্যা বেরোচ্ছে শ’খানেক প্রায়। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের 'পিরিয়ড পিস' তখনও বেরোচ্ছে শারদীয়া বর্তমানে। তবে পুজোসংখ্যা নিয়ে হা হুতাশের শুরু হয়ে গিয়েছে। পুজোসংখ্যার আর আগের মতো ঝাঁঝ নেই। ২০১৮ সালে প্রতিভা সরকার ‘শারদসংখ্যা: সেকাল একাল’-এ লিখছেন, “যদি জিজ্ঞাসা করা হয় কী সেই বস্তু যা আছে অথচ নেই, উত্তর হতে পারে পূজাবার্ষিকী। যদি প্রশ্ন হয় অমাবস্যার চন্দ্রকলার মতো কী ক্রমাগত ক্ষীণতনু ধারণ করেছে, উত্তর হতে পারে পূজাসংখ্যা সাহিত্য পত্রিকা। কারণ আজকাল পূজাসংখ্যার সেই রমরমা নেই, পড়ার জন্য সেই আকুলিবিকুলিই বা কই!” তাঁর ছোটবেলায় দেখছি বাড়িতে কালো শক্ত বাঁধাইয়ের ওপর সোনালি জলে লেখা প্রবাসী, ভারতবর্ষ বা বার্ষিক বসুমতী। ছোটবেলায় প্রিয় শারদীয়া ছিল কিশোরভারতী, শুকতারা (এ তথ্য সে প্রবন্ধে নেই)। গতবছর বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ জানাচ্ছে, বর্তমানে সারাবিশ্বে বাংলাভাষায় পাঁচ হাজারের ওপর পত্রপত্রিকা, ওয়েবজিন ইত্যাদি প্রকাশিত হয়। ২০২১-এই আপনপাঠে প্রকাশিত প্রবীর মিত্রের লেখায় উল্লেখ রয়েছে, তাঁর প্রথম ভালোলাগার শারদীয়া আনন্দমেলা ও দেব সাহিত্য কুটিরের পত্রিকা। এছাড়া ‘নবকল্লোল’, ‘প্রসাদ’, ‘উল্টোরথ’, ‘আনন্দলোক’ ইত্যাদিও ছিল জনপ্রিয়। এ বিষয়ে ডঃ সুবীর মণ্ডলের লেখাটিতেও তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকা নেই। তবে বর্তমানের পুজোসংখ্যা নিয়ে বিতৃষ্ণা রয়েইছে।

শ্রীকুমারবাবু যখন লিখছেন, তখনও প্রবন্ধের নাম 'পুজোসংখ্যা'। কারণ পুজোসংখ্যা ব্যাপারটাই তখন একেলে। কিন্তু সন্দীপবাবুর সময়ে আমরা দেখছি একটা অভাববোধ এসে গিয়েছে। আমরা জানি, ইতিহাসের এক পিঠ উত্তল হলে অপর পিঠ অবতলই হয় সাধারণত। অর্থাৎ দু’ দশকের হতাশা যখন প্রবন্ধের রূপ পাচ্ছে, একটা খোঁজের তাগিদ অনুভূত হচ্ছে, তার অপরপিঠে অবশ্যই একটা অভাববোধের তাড়না রয়েছে। এই লেখকদের বিভিন্ন বয়স, ভিন্ন ভিন্ন ছোটবেলা, বড় হয়ে ওঠার পথেও যেসব পত্রিকা তাঁরা পড়েছেন, আজ আর তাদের সেই মান নেই। অথচ এখন পুজোসংখ্যার সংখ্যা বেড়েছে প্রচুর পরিমাণে। কেন পুজোসংখ্যা নিয়ে আকর্ষণ হারাচ্ছে মানুষ? তবে কি অধুনা বাংলা সাহিত্যে শরৎ আসে বর্ষার যাবতীয় জল নিয়েই? শুধু কি মান, নাকি বদলে গিয়েছে পুজোর পরিবেশও, 'পাঠক' নামে অস্তিত্বটিও কি সদা পরিবর্তনশীল নয়? বারেবারে এ সব প্রশ্নগুলি গুরুতর হয়ে উঠতে থাকে।

বাঙালির প্রথম শারদীয়া বের করেছিলেন কেশব চন্দ্র সেন। ‘ভারত সংস্কার সভা’ তখন তাদের বিখ্যাত সাপ্তাহিক ‘সুলভ সমাচার’ বের করত। হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত হল ১২৮০ বঙ্গাব্দে, অর্থাৎ ১৮৭৩ সালের পুজোয় তাঁরা একটি ‘ছুটির সুলভ’ বের করবেন। পুজো নয়, পুজোর ছুটি ছিল এই সংখ্যার উপলক্ষ্য।

“ছুটির সুলভ!!

আগামী ছুটি উপলক্ষ্যে সুলভের বিশেষ একখণ্ড বাহির হইবে।

উত্তম কাগজ, উত্তম ছাপা। দাম কিন্তু ১ পয়সা।

মজা করে পড়িতে পড়িতে ঘরে যাও। একটা পয়সা দিয়ে সকলের কিনিতেই হইবে। দেখ যেন কেউ ফাঁকি পেড় না।”

আরও পড়ুন- গরু পারাপারের সেতু থেকে আজকের টালা ব্রিজ! যে ইতিহাস অনেকের অজানা

সে বছর পয়লা আশ্বিন এই বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল। পুজোসংখ্যার প্রথম বিজ্ঞাপন। এই পত্রিকাতে পুজোসংখ্যার বিশেষ বৈশিষ্ট্য কিছু না থাকলেও বিজ্ঞাপনে ‘দক্ষিণা দিয়া ইহার পূজা’ করতে অনুরোধ করেছেন বিজ্ঞাপনদাতা। এই একটি অ্যানালজি পত্রিকাটির ভাগ্যে জুটেছিল। দুর্গাপুজো নিয়ে নানা পত্রপত্রিকায় লেখাটেখা বেরোত। বটতলা থেকে এক পয়সার নানান বই বেরোত। তাতে লেখা থাকত, ‘দুর্গাপুজোর রংতামাসা, পড় দিয়ে একটি পয়সা’। তবে প্রথম পূর্ণাঙ্গ শারদীয়া বের করে ‘ভারতবর্ষ’। ১৯১৩ সালের কার্তিক সংখ্যা ছিল প্রথম শারদীয়া সংখ্যা। এরপরে পুজোসংখ্যার সংক্রামক হয়ে ওঠা। আনন্দবাজার প্রথম শারদীয়া করছে ১৯৩৫ সালে। সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার সম্পাদক। ছাপা হয়েছিল তিরিশ হাজার কপি। এই পত্রিকাতে প্রফুল্লচন্দ্র রায়, যদুনাথ সরকারের মতো মানুষেরা মনোজ্ঞ প্রবন্ধ লিখেছেন। নরেন্দ্র দেবের একটি লেখাও ছিল এই সংখ্যায়, বাংলা সিনেমার সূচনাপর্ব নিয়ে।

তবে উপন্যাস এল আরও বছর চারেক পরে। আনন্দবাজার শারদীয়ায় প্রথম উপন্যাস ছাপে ১৯৩৯-এ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শহরতলী’। সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘রবিবার’। এই গল্প যখন লিখছেন রবীন্দ্রনাথের তখন আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গীন। বুদ্ধদেব বসুকে লেখা একটি চিঠিতে লিখছেন, “অর্থের প্রয়োজনে গল্প লিখতে হয়েছে, অর্থ উপার্জনের অন্য কোনও সহজ পথ জানিনে— বিপদে পড়লে সরস্বতীকে পাত্তা করে লক্ষ্মীর দরজায় যেতে হয়। সে লেখাটা বিক্রি করেছি। ভবিষ্যতে আবার গল্প লিখতে হবে কিন্তু একই কারণে। ব্যবসাটা অর্থকরী নয় কিন্তু ভিক্ষার চেয়ে অন্তত ভদ্র।” পুজোসংখ্যাটির দাম ছিল এক টাকা। একটা জিনিস লক্ষ্যনীয়, পুজোসংখ্যায় ব্যবসার একটা ব্যাপার কিন্তু তখনও ছিল। বিজ্ঞাপন থেকে কপির সংখ্যা এবং দাম— ইত্যাদি লক্ষ্য করলেই একটা ধারণা পাওয়া। এ জিনিস হঠাৎ করে আসেনি। আর পাঁচটা পুজোর ব্যবসার সঙ্গেই পুজোসংখ্যার ব্যবসাও একটা ভালো পরিমাণ টাকা এনে দিত পত্রিকাগুলির ট্যাঁকশালে। রবীন্দ্রনাথের ল্যাবরেটরিও বেরোয় এই শারদীয়া আনন্দবাজারেই। ১৯৪০-এ। তখন রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত অসুস্থ। উপন্যাস হিসাবে ল্যাবরেটরি ছাপা হয়েছিল।

প্রতিমা দেবী 'নির্মাণ' বইটিতে জানাচ্ছেন, সেদিন প্রবল অসুখের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ নাকি বেশ ভাল ছিলেন। আবার পুজোসংখ্যার আগাম অর্থ বন্যাপীড়িতদের সাহায্যেও পাঠাচ্ছেন। ১৯৪৯-এ 'দেশ' শারদীয়া প্রথম উপন্যাস ছাপে সুবোধ ঘোষের 'ত্রিযামা'। ১৯৬৫ অবধি পুজোসংখ্যায় একটিমাত্র উপন্যাস বেরোনোরই নীতি ছিল। ধীরে ধীরে সেখানে তিনটি হল। সেই সংখ্যা ক্রমে বাড়তে থাকল। এই দেশ শারদীয়াতেই তখন সত্যজিতের 'গ্যাংটকে গণ্ডগোল' বেরোচ্ছে, 'সোনার কেল্লা' বেরোচ্ছে। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস 'পায়রা' বা শীর্ষেন্দুর প্রথম উপন্যাস 'ঘুণপোকা' বেরোচ্ছে। যুগান্তর, দৈনিক বসুমতী পাল্লা দিয়ে পুজোসংখ্যা বের করত। বিনোদনের দিকটা সামলাত 'নাচঘর', 'উল্টোরথ', একটু পরের দিকে 'প্রসাদ'। মজার ব্যাপার এই 'প্রসাদে'ই বেরিয়েছিল মহাশ্বেতা দেবীর 'হাজার চুরাশির মা'। এইখানেই উদারনীতিবাদের গুঁতোয় বেরনো পত্রিকাদের সঙ্গে সেকালের শারদীয়ার পার্থক্য। আসানসোলের 'কোল্ডফিল্ড টাইমস্' এবং আন্দামানের 'দ্বীপবাণী'ও চমৎকার শারদীয়া বের করত।

এ গেল তথ্যের কথা। প্রাণের কথা যদি বলতে হয়, সমস্ত সমালোচক লেখক এবং পাঠক শুরু করবেন ছোটদের শারদীয়া দিয়ে। আমরা দেখছি শেষ কয়েকটি প্রজন্ম প্রাথমিকভাবে শারদীয়ার স্বাদ পেয়েছে কিশোরভারতী, শুকতারা, আনন্দমেলা ইত্যাদি দিয়ে। এত দীর্ঘদিন ধরে এত ভালো মান ধরে রাখা শারদীয়া পত্রিকা বোধহয় কমই ছিল। কাজেই একটা সাধারণ পাঠক যুগ তৈরি করেছিল তারা। পরবর্তীতে আনন্দলোক, নবকল্লোল, উল্টোরথ ইত্যাদির স্বাদ পেয়েছেন তাঁরা। এই ছোটদের শারদীয়ার ১৯১৮য় অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গা ঘেঁষে, নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বের করলেন 'পার্বনী'। সেই পুজোসংখ্যা সম্বন্ধে নগন্দ্রনাথ বলছেন, “সকল দেশেই পূজা-পার্বণ প্রভৃতি আনন্দোৎসব ছেলেমেয়েদের জন্য অনেক আয়োজন করা হয়… এসব আয়োজনের সঙ্গে ছেলেমেয়েরা পড়ে খুশি হবে, অনেক বিষয় জানতে পারবে, এজন্য ইউরোপ ও আমেরিকায় নানা ধরনের বই ছাপানো হবে… বিদেশে ছেলেমেয়েদের জন্য এত আয়োজন দেখে মনে মনে সংকল্প করেছিলাম, বাংলাদেশের নামজাদা লেখক, লেখিকা ও চিত্রশিল্পীদের কাছ থেকে নানা বিষয়ে লেখা ও ছবি সংগ্রহ করে প্রতি বছর পূজার সময় তোমাদের জন্য একখানি বই বের করব।”

ঔপনিবেশিক প্রভাব থাকলেও, সেদিন খোদ নগেন্দ্রও হয়তো ধারণা করতে পারেননি এক যুগান্তকারী ধারার তিনি জন্ম দিতে চলেছেন, যা আগামী এক শতাব্দী প্রায় সময় ধরে পাঠকদের মন জয় করে রাখবে। পত্রিকার নাম রেখেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। লেখক? কে লেখেননি বলা শক্ত। দ্বিজেন্দ্রলাল, অবনীন্দ্রনাথ, দীনেন্দ্রনাথ, রথীন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ, খোদ রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, সুকুমার রায়, সত্যেন দত্ত, শিবনাথ শাস্ত্রী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, প্রিয়ম্বদা দেবী, শান্তা দেবী, সীতাদেবী ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। নাম সব বলে শেষ করা যাবে না। প্রচ্ছদ ছিল নন্দলাল বসুর, অলংকরণে অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু, সুরেন্দ্রনাথ কর প্রমুখেরা। সে সময়‌ দাম ছিল দেড় টাকা। অথচ দু’ মাসে হাজার কপি বই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। পত্রিকার এই অভূতপূর্ব সাফল্যে রবীন্দ্রনাথ জামাতা নগেন্দ্রকে লিখছেন, “আমি ইহার বৈচিত্র্য, সৌষ্ঠব ও সরসতা দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছি— অথচ ইহার মধ্যে পাঠকদের জানিবার, ভাবিবার, বুঝিবার কথাও অনেক আছে। তোমার এই সংগ্রহটি কেবলমাত্র ছুটির সময় পড়িয়া তাহার পরে পাতা ছিঁড়িয়া, ছবি কাটিয়া, কালি ও ধূলার ছাপ মারিয়া জঞ্জালের সামিল করিবার সামগ্রী নহে— আমাদের শিশুসাহিত্য ভাণ্ডারে নিত্য ব্যবহারের জন্যই রাখা হবে।” প্রথম ছোটদের শারদীয়া সেই যে একটি আদর্শে বাঁধা হয়ে গেল, বহুদিন দেবসাহিত্য কুটির থেকে আনন্দ, যাঁরাই সফল ছোটদের শারদীয়া করেছে, তাদের মূলমন্ত্র ছিল রবীন্দ্রনাথের সেই উক্তি। পত্রিকার গণ্ডি ছাড়িয়ে আলমারিতে জায়গা করে নিতে হবে। মায়ের ছোটবেলার হলুদ বিবর্ণ পাতার বাঁধানো ইয়াম্মোটা শুকতারা পড়েছি আমিও। সে সব সম্পদ হয়ে রয়ে গিয়েছে। 'পার্বনী' খুব বেশিদিন চলেনি। কিন্তু বার্ষিক শিশুসাথী, ছোটদের বার্ষিকী ইত্যাদি পেরিয়ে দেব সাহিত্য কুটির যখন প্রথম শারদীয়া বার করে তখন সেটি ছিল কেবল কবিতার। ছোটদের জন্য কেবল কবিতার শারদীয়া এর আগে কেউ কল্পনাও করেননি। সুনির্মল বসু, গিরিজাকুমার বসু নাম দিয়েছিলেন 'ছোটদের চয়নিকা'। রবীন্দ্রনাথ সহ যতীন্দ্রমোহন বাগচি, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, সত্যেন দত্ত, কামিনী রায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, প্রিয়ম্বদা দেবী, কাজী নজরুল ইসলাম, মোহিতলাল মজুমদার হেমেন রায়, সুকুমার রায়, নরেন্দ্র দেব, রাধারানী‌ দেবী, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখের লেখা ছাপা হয়েছিল।

ধীরে ধীরে এর জয়যাত্রা অনেকেই চোখে দেখেছেন। অনেকে মানে অনেকগুলি প্রজন্ম। কিন্তু গত দু’ দশকে হঠাৎ কী হল, যে পাঠকদের মধ্যে এই পরিমাণ ক্ষোভ? প্রতিভা সরকারের লেখাতে পাচ্ছি, “নিজের শারদসাহিত্যের জন্য আগ্রহ ঘুচে গেছে এইরকম একটি কারণে। আমার প্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন খুব অসুস্থ। কিন্তু আনন্দবাজারী শারদসম্ভার তাঁকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। তাই একটি অসম্পূর্ণ আধাখ্যাঁচড়া লেখা উপন্যাস অপ্রকাশিত বলে ছাপা হয় সম্ভবত দেশ বা আনন্দবাজার পত্রিকায়। আজ তার নাম চরিত্র কিছুই মনে নেই, শুধু মনে আছে সেটিতে অকারণ যৌনতার কাঁচা মাংসের বিকট গন্ধ। সম্ভবত প্রতাপ নামের এক অভিযানপ্রিয় যুবকের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যাত্রার কাহিনী।” দেখা যাচ্ছে, নিজেদের উদযাপিত লেখক, তারকা লেখকদের শেষ বয়সে এসে ক্ষমতাহীন অবস্থাতেও লেখালেখি এই বিরক্তি উদ্রেকের একটা বড় কারণ। ব্র্যান্ডভ্যালু ব্যাপারটা আর যেখানেই চলুক, সাহিত্যের ক্ষেত্রে চলছে না সেরকম। যদিও 'নামজাদা' লেখকের শর্ততেই শারদীয়া প্রকাশ শুরু হয়েছিল একরকম। কিন্তু যুগের ফেরে কেবল ব্র্যান্ডভ্যালু পাঠক আর নিতে চাইছেন না। এখন তাঁরা আরও অনেক বেশি সচেতন।

দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞাপনের বাড়াবাড়ি নিয়ে আপত্তি প্রকাশ করেছেন অনেকেই। পুজোসংখ্যায় লেখার মানের থেকে এই যে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির বাড়াবাড়ি, তাতে বিরক্ত মানুষ। অপেক্ষা নেই, সেই মাধুর্য নেই। ফলে পুজোসংখ্যার সেই গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ঢুকে আসা শরতের মেদুর দুপুরগুলি গিয়েছে হারিয়ে। গবেষণাধর্মী লেখার জায়গায় ধীরে ধীরে জায়গা করে নিয়েছে ফিচারধর্মী হালকা লেখা, তাতেই মানুষের উৎসাহ। প্রশ্ন ওঠে, তবে কি ভালো পুজোসংখ্যা বেরোচ্ছে না? প্রচুর ভালো ভালো পুজোসংখ্যা বেরোচ্ছে চারিদিকে। দু’টি উদাহরণ দিই। 'বকলম' দিব্যি তাদের পুজোসংখ্যা বের করেছে। ‘রূপান্তরের পথে’ এবারও শারদীয়া সংখ্যা বের করেছে। শুভ্র মৈত্রের সম্পাদনায়, দাম মাত্র একশো টাকা। বহু ই-ম্যাগাজিন শারদ সংখ্যা করেছে, হরপ্পার নতুন সংখ্যা এসে গিয়েছে। এমন বহু ভালো মানের পত্রিকা আছে বাজারে। যেটা হয়েছে, শারদীয়ার কলকাতাকেন্দ্রিকতা খানিক ঘুচেছে। আসলে একটা যুগ শেষ হয়েছে উদারনৈতিক অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গে। প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাগুলি পুজোকে কেবলমাত্র ব্যবসার মাধ্যম হিসেবেই দেখতে চাইছে। কিন্তু লেখকপুঁজি তাদের শেষ। একটা করে গত তাঁরা তৈরি করেছিলেন প্রত্যেকে। সেই গতে আর নতুন লেখকেরা পড়ছেন না। ফলে জোর করে সেই গত টেনে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টাটাই চোখে লাগছে। প্রাচুর্যটা সমস্যা না, যতক্ষণ তাতে বহুত্ব মিশে থাকে। অত্যধিক ব্যবসায়িক ঝোঁক এবং গতকে মহিমান্বিত করার সুবাদে নতুন যুগকে বুঝতে না চাওয়ার মানসিকতাই চলতি পুজোসংখ্যা গুলিকে বিচ্ছিন্ন করছে পাঠকের থেকে।

আরও পড়ুন- ধূম জ্বর গায়েই পুজো! বেলুড় মঠের দুর্গাপুজোয় দ্বিতীয়বার রইতে পারেননি খোদ স্বামীজিই

ডিজিটাল জামানায় পাঠকের বৃত্ত বড় হয়েছে। আগের থেকে পাঠাভ্যাস বদলেছে মানুষের। ফলে প্রতি পত্রিকার বেছে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে, তারা কী ধরনের কাজ উপহার দিতে চান মানুষকে। মনে রাখতে হবে পাঠকেরাও বদলেছেন। উদারনৈতিক অর্থনীতির পরে দেখানো, ঘোরা, হুল্লোড়ের একটা ঝোঁক এসেছে। ফলে, পাঠকের মনন জগতে এখন পড়ার থেকে গাল দেওয়ার প্রবণতা বেশি। সাধারণ পাঠকের মধ্যে পুজোসংখ্যার উদ্দেশ্যে জোরে জোরে গাল পাড়ার অন্যতম কারণ, এভাবে সহজেই পুজোসংখ্যাগুলি এড়িয়ে যাওয়া যায়। একটা বিরাট অংশের পাঠক এখনও পুজোসংখ্যা কেনেন অভ্যেসে। অভ্যেস ব্যাপারটাই সাহিত্যের সঙ্গে যায় না। নস্টালজিয়ায় কি ওঁচা সাহিত্যকে উত্তম করে তোলা সম্ভব? আপনি বাস্তব জীবনে কী করেন? কোনও একটি রেস্তোরাঁয় খাবার ভালো না দিলে অবিলম্বে রেস্তোরাঁ পাল্টান। তবে পুজোসংখ্যার বেলা সেই একই পুজোসংখ্যায় আটকে থাকা কেন? একই লেখক যখন প্রাচুর্যের সঙ্গে জুড়ে যান, অর্থাৎ প্রচুর লেখা লিখতে হয় তাঁকে এখানে ওখানে, তখন তাঁর লেখা দায়সারা হতে বাধ্য। কিন্তু বহুজন বহুভাবে নিজেদের পত্রিকা বের করছেন এখন। হাজারো লেখক, হাজারো অপশন, হাজারো সম্পাদক। কেন তবে পত্রিকার ভূত বয়ে ফেরা?

ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ‘হাতে গোনা কয়েকটি পত্রিকা’র পবিত্রতা তাতে মার খাচ্ছে বটে, কিন্তু প্রচুর লেখক মানেই লেখা খারাপ হবে, এ একটি গতবাঁধা চিন্তামাত্র। জ্যান্ত পত্রিকাদের দিকে বরং চোখ ফেরান। “বাংলা সাহিত্যে ভালো কাজ হচ্ছে না” যেমন একটি বাজেকথা, মূলত যাঁরা পড়তে চান না, তাঁরা এরকম একটা কথা ছড়ান, তেমনই “সামগ্রিক বাংলা শারদীয়ার মান নেমে গেছে”— এই কথারও মানে হয় না। যে সব প্রবন্ধের উল্লেখ করা হয়েছে এই লেখায়, সমালোচকেরা কিন্তু নির্দিষ্ট পত্রিকার মান খারাপ হওয়ার কথা বলেছেন। কী তাঁদের পছন্দ ছিল, কীসের প্রচুর জনপ্রিয়তা ছিল, অথচ এখন আর তেমনটি নেই— তা বিচার করে দেখিয়েছেন। কিন্তু সাধারণ পাঠকের এই “আগে সব ছিল, এখন কিছুই নেই” মার্কা কথাবার্তা পাঠক হিসেবে নিজেদের দায় এড়ানোর একটা মাধ্যম মাত্র আর কিচ্ছু নয়। নইলে ‘বকলম’ এবং ‘রূপান্তরের পথে’-র মতো সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী দু’টি পত্রিকা এতখানি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠত না। 'বকলম'-এর কাজ মূলত তত্ত্বভিত্তিক, ফিচারধর্মী লেখাও সে ছাপে না, গবেষণা মূলক প্রবন্ধ ছাপে। অথচ তার বিক্রি রয়েছে ভালোই। অন্যটি একেবারে সাহিত্য পত্রিকা। তাতে বর্তমানের গুরুত্বপূর্ণ সব লেখকেরা লিখেছেন। মাত্র একশো টাকায় সুন্দর একটি পত্রিকা হয়েছে। সাড়ে পাঁচশো ছ’শোতেও তাঁদের যেতে হয়নি অথচ গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা হয়েছে। একবিংশ শতকে এসে শুধু কলকাতা আর শুধু পরিচিত হাতেগোনা কয়েকটি পত্রিকার শারদসংখ্যা কেন আগের মতোন থাকল না— এই নিয়ে কপাল চাপড়ানোর তেমন মানে আছে বলে মনে হয় না। যা রয়েছে তা খোঁজের অভাব, খুঁজে নেওয়ার দায়বদ্ধতার অভাব।

 

তথ্যঋণ—

পুজো সংখ্যার সেকাল একাল, সন্দীপ কুমার দাঁ

শারদসংখ্যা—সেকাল ও একাল, প্রতিভা সরকার, ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

শারদসংখ্যার একাল-সেকাল, প্রবীর মিত্র, আপনপাঠ

বাঙালির শারদীয়া পূজাবার্ষিকীর সেকাল ও একাল, ডঃ সুবীর মণ্ডল

বাঙালির অন্দরে অন্তরে যেভাবে ঢুকে পড়েছিল শারদীয়া পুজোসংখ্যা, বঙ্গদর্শন

More Articles