মূলস্রোতে ফেরার হাতিয়ার দুর্গাপুজো! সত্যিই কি বদলায় যৌনকর্মীদের যাপন?

Sonagachi Durgapuja 2022: অতীতকালে বারাঙ্গনারা কীভাবে দুর্গাপুজোয় ভূমিকা নিতেন তার বর্ণনা পাওয়া যায় কালীপ্রসন্ন সিংহের বিখ্যাত ‘হুতোম প্যাঁচার নকশায়’।

সমাজের চোখে ওঁরা দুয়োরানি। সমাজ ওঁদের ব্রাত্য করে রেখেছে বহুকাল। কিন্তু এই ‘পতিতাপল্লির’ মাটি ছাড়া দুর্গাপুজো হয় না। হাইকোর্টের অনুমতি আদায় করে নেওয়ার পর থেকে প্রতিবারই পুজোয় নতুন কিছু করে সোনাগাছি। এবার তাদের থিম ‘মন দিয়ে যদি মাকে খোঁজো, এই মাটিতে মাকে পাবে’। সোনাগাছিতে এবার থিমের প্রতিমা। আর সেই সঙ্গে এশিয়ার বৃহত্তম যৌনপল্লিকে যে সমাজ ‘পতিতা’ ভাবে তাদের প্রতি সেই অভিমানে ‘সহভোজে’র কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছে গতবছর থেকে। অষ্টমীর রাতভর খিচুড়ি রান্না হবে সোনাগাছিতে। সঙ্গে পাঁচমেশালি চচ্চড়ি, চাটনি আর পায়েস। নবমীর সকাল থেকে কলকাতার নানা যৌনপল্লিতে পৌঁছে যাবে সেই খাবার। নবমীর দুপুরে শহরের সব যৌনকর্মী খাবেন সেই খাবার। একদিকে যেমন পুজোর ভোগ নিয়ে স্বাবলম্বী হতে চাইছেন তাঁরা, তেমনই অভিমান বুকে চেপে ঘোচাতে চাইছেন ‘পতিতা’ নাম। এই অভিমান বহুদিনের।

বাঙালির দুর্গাপুজোর সঙ্গে বারাঙ্গনাদের সম্পর্ক আদি অনন্তকালের। দুর্গাপুজোর একটি অনিবার্য উপাদান গণিকাপল্লির মাটি। সমাজ যাঁদের দূরে ঠেলে রেখেছে, আদিশক্তি কিন্তু তাঁদেরই কাছে টেনে নিয়েছে। তাঁর ত্রিনয়নে সবাই সমান। বলা ভালো, এই ‘অশুচি’ যৌনপল্লির মেয়েরা বরং তাঁর নজরে উঁচু স্থানে আছেন। তাই তো দেবীমূর্তি গড়তে অবশ্যম্ভাবী এখানকার মাটি। শাস্ত্রে তেমন বিধানই দেওয়া আছে। বলা আছে, অকালবোধনের সময় মহিষাসুরমর্দিনীকে গড়তে হবে যৌনপল্লির মৃত্তিকাতেই। সম্পূর্ণ না হলেও আংশিকভাবে এই মাটি লেপতেই হবে চিন্ময়ীর কাঠামোয়। কিন্তু কেন?

বলা হয়, পুরুষ যৌনপল্লিতে যায়। সে তার জীবনের সমস্ত সঞ্চিত পুণ্য সেখানে ফেলে আসে। বদলে পুরুষ সেখান থেকে মুঠো ভর্তি করে নিয়ে আসে পাপ। বহু পুরুষের পুণ্যে সেখানকার মাটি পরিপূর্ণ। এক কথায় সমাজকে বিশুদ্ধ রাখতে সাহায্য করে এই ‘অশুদ্ধ’ বণিতারাই। তাই পুজোর মূর্তি তৈরিতে অনস্বীকার্য যৌনপল্লির মাটি।

অতীতকালে বারাঙ্গনা, বারনারীরা কীভাবে দুর্গাপুজোয় ভূমিকা নিতেন তার বর্ণনা পাওয়া যায় কালীপ্রসন্ন সিংহের বিখ্যাত ‘হুতোম প্যাঁচার নকশায়’। বাবুদের বাড়ির পুজো এবং বারোয়ারি পুজোতেও বাবুদের আমোদের একটি বড় উপকরণ ছিল নটীদের নাচ, গান, রঙ্গ। এখনকার 'বাবু'রা সোনাগাছির নামে লজ্জা পান। তাঁদের তালিকায় জুড়েছে ‘এসকর্ট গার্ল’। দুর্গাপুজোয় এবার পার্কস্ট্রিটের বার বিলাসিনীদের ভিড় খানিকটা বেশি হওয়ার আশা। গত দু’বছর পুজোও অতিমারির হাত থেকে রেহাই পায়নি। পরিণাম! উৎসব মাস্কের আবর্তে মুখ ঢেকেছিল। এখন অবশ্য উৎসবে মেতেছে সোনাগাছিও।

আরও পড়ুন- বাগবাজার না সিমলা ব‍্যায়াম সমিতি, কোন সার্বজনীন পুজো সবচেয়ে পুরনো? জানুন আসল তথ্য

কালীপ্রসন্নের কালে বাঙালি বাবুরা দুর্গাপুজোর সময় গঙ্গাবক্ষে নৌকা বা বাজরা ভাসিয়ে রক্ষিতাদের নিয়ে আমোদে মাততেন। তখন দুর্গাপুজোয় গঙ্গাবক্ষে ভাসত জনপদবধূদের মেলা। সেই রাজনটীদের কলকাতা আজ আর নেই। উৎসব মানে এখন পার্কস্ট্রিটে আলোর মেলা। তবে দুর্গাপুজো খানিক আলাদা। দুর্গাপুজো মানে এখন কানির্ভ্যাল। প্রায় সব বড় পুজোই পায় সরকারি অনুদান। শহর সেজে উঠেছে আলোর মেলায়।

সোনাগাছিতেও তাই উৎসবের রঙ লেগেছে। তবে কয়েক বছর আগেও ছবিটা এমন ছিল না। ২০১৭ সালে কলকাতা হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে সোনাগাছির যৌনকর্মীরা ম্যারাপ বেঁধে পুজো করার অনুমতি পান। ২০১৩ সাল থেকে ঘুপচি ঘরে পুজো শুরু হলেও মন ভরেনি। আগের দিনগুলো ছিল বিষাদে ভরা। যৌনকর্মীরা অপেক্ষায় থাকতেন 'বাবু'দের জন্য। এই অন্ধকার ঘরে বেড়ে ওঠা তাঁদের সন্তানদের গায়ে কোনওমতে নতুন জামা চড়লেও, রাত কাটত দরজায় জুলজুল চোখে দাঁড়িয়ে। এমনটাই জানালেন সোনাগাছির এক কর্মী বীথি দাস (নাম পরিবর্তিত)। উৎসবের অঙ্গ হয়ে ওঠা তাঁদের কাছে ছিল স্বপ্নের জাল বোনা।

অদালতে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে ছাড়পত্র। সালটা ২০১৭। মিলল অনুমতি। যৌনপল্লি সোনাগাছির দুর্গাপুজোর অনুমতি নিয়ে জটিলতা ছিল প্রতিবারের ঘটনা ৷ সেবারেও পুজোর অনুমতি পেতে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন সোনাগাছির যৌনকর্মীরা ৷ অবশেষে কোর্টের হস্তক্ষেপে খুলেছিল জট ৷

সেবার থেকে সোনাগাছিতে ম্যারাপ বেঁধে দুর্গার আরাধনা হয়ে আসছে৷ পুজো উদ্যোক্তাদের পছন্দমতো জায়গাতেই পুজো করার অনুমতি দেয় কলকাতা হাইকোর্ট। সেই বছর থেকে মসজিদবাড়ি লেনে হয়ে আসছে সোনাগাছির পুজো মণ্ডপ৷ লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত থাকতে পারে এই মণ্ডপ৷ দুর্গাপুজোর পর লক্ষ্মীপুজো শেষ হলে তারপরই খুলে ফেলতে হয় মণ্ডপ৷ এই নির্দেশই দিয়েছিলেন বিচারক দেবাংশু বসাক৷ এরপর একরাশ আলো ঢোকে সোনাগাছিতে। এখন এক ফোঁটা অবসর নেই শিউলি, বীথি, পূজাদের (নাম পরিবর্তিত)।

এবার কীভাবে উৎসব পালন করছে সোনাগাছি? দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সম্পাদক পুতুল সিং জানালেন, “আসলে আমরা যতই সচেতন হই না কেন এখনও যৌনকর্মীদের ‘পতিতা’ হিসেবে দেখে সমাজের বড় অংশ। তাই মুখে যতই সকলের উৎসব বলা হোক, এই পেশায় যুক্তদের সঙ্গে উৎসবের যোগ থাকে না বললেই চলে। তবে পুজো শুরুর পর থেকে ছবিটা কিছুটা পাল্টেছে। এই সময় সবাই ভোগ পেতে ভালোবাসেন। আমরা এমন কর্মসূচি নিয়েছি যাতে কলকাতার সব যৌনকর্মীদের কাছে ভোগ পৌঁছে দেওয়া হয়।”

দুর্বার সূত্রে জানা গেছে, কোনও রান্নার ঠাকুর আসবেন না। যৌনকর্মীরাই রান্নার জোগাড় করবেন। এটা চলবে অষ্টমীর রাত থেকে। নিজেরাই রাঁধবেন। আর নবমীর সকাল থেকে বড় বড় ডেকচি ভরে খিচুড়ি গাড়িতে করে যাবে এখানে ওখানে। আগে থেকে সবাইকে পাত্র নিয়ে তৈরি থাকতে বলা হয়েছে। গত বছর থেকে এই রেওয়াজ চলে আসছে। এবছরও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। আসলে দুর্গাপুজোর ভোগ নিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি ‘পতিতা’ নাম ঘোচাতে চান পূজা, বীথিরা।

পুতুল সিং জানিয়েছেন, এবার পুজোয় তাঁরা বিশেষ বিনোদন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম পুরুলিয়ার ছৌ নাচ। পুরুলিয়া থেকে বিশেষ নাচের সম্প্রদায় আসবেন সোনাগাছির পুজোয়। কাজেই এই পুজোয় সমস্ত দর্শনার্থীর জন্যই থাকছে ছৌ নাচ উপভোগ করার সুযোগ। এখানেই শেষ নয়। ব্যস্ততার আরও বাকি। কেউ কাটবেন ফল, কেউ গাঁথবেন মালা। কারও উপর দায়িত্ব আলপনা দেওয়ার। একই সঙ্গে, যাঁরা ভোগ রান্না করবেন, তাঁদের নামও চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে। সব মিলিয়ে, দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি ঘিরে সোনাগাছিতে এখন চূড়ান্ত ব্যস্ততা। পূজা, পায়েল, বীথি দাসদের (নাম পরিবর্তিত) বক্তব্য একটাই— “কবে থেকে এই চারটে দিনের জন্য অপেক্ষা করে থাকি! এটা আমাদের পুজো, আমাদের। তাই, সব দায়িত্ব আমরা নিজেদের মধ্যেই ভাগ করে নিই।”

আরও পড়ুন- সাবর্ণদের ৪১৩ বছরের দুর্গাপুজো! পোড়া ল্যাটা মাছের ভোগে আজও অমলিন দুর্গার আরাধনা

যৌনকর্মীদের পরিচালনায় এবার পুজোর ভাবনা বা থিম, ‘মন দিয়ে যদি মাকে খোঁজ, এই মাটিতে মাকে পাবে’। পুতুল সিংয়ের কথায়, “সমাজের অনেকের কাছে যৌনকর্মীরা এখনও অবেহেলিত, ব্রাত্য। নানা ক্ষেত্রে তাঁদের নিয়মিত বৈষম্যের শিকারও হতে হয়। কিন্তু সমাজের আর পাঁচ জন মহিলার মতো তাঁরাও মা। সেটা অনেকেই মানতে চান না। সেই ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করার লক্ষ্যেই আমাদের এবারের দুর্গাপুজোর ভাবনা।” সোনাগাছির দুর্গাপুজোয় এবার শঙ্খ বাজানো, হাঁড়ি ভাঙা, মোমবাতি জ্বালানো-সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতাও থাকছে।

হালফিলে শুধু কলকাতায় নয়, দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতির উদ্যোগে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের যৌনপল্লিতেই দুর্গাপুজো হচ্ছে। তবে কলকাতার যৌনপল্লিগুলির মধ্যে দুর্গাপুজোর আয়োজন এখনও পর্যন্ত হচ্ছে কেবল সোনাগাছিতেই। সেই জন্য সোনাগাছির পুজো থেকে নবমীর ভোগ পাঠানো হবে বউবাজারের হাড়কাটা গলি, প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিট, কালীঘাটের লকার মাঠ, টালিগঞ্জের ইউকে মণ্ডল লেনে থাকা কলকাতার অন্যান্য যৌনপল্লিতে। মেনু? খিচুড়ি, পাঁচমেশালি তরকারি, চাটনি এবং পায়েস। অন্ধকার ঘরগুলোতে এখন ঢুকে পড়েছে উৎসবের আলো, হাওয়া-বাতাস। কিন্তু যৌনকর্মীদের অবস্থার বদল হচ্ছে কি? এই আলো কতটাই বা দীর্ঘস্থায়ী হতে পাচ্ছে যৌনপল্লীতে বেড়ে ওঠা সন্তানদের কাছে, কোন আলোতে স্নাত হচ্ছে দূর কোনও প্রান্তের পাচার হয়ে যাওয়া নাবালিকা? দুর্গাপুজোর সুযোগ আদৌ কি 'মেইনস্ট্রিমে' নিয়ে আসছে সোনাগাছির যৌনকর্মীদের? এসব প্রশ্নের অন্ত নেই। দুর্গোৎসবে মেতে ওঠার সুযোগ বঞ্চনা ভুলে থাকার বা 'সহনাগরিক' হতে না পারার ঘায়ের মলম নয়তো, এই শঙ্কা প্রতিমার সঙ্গে ভেসে যায় না বিসর্জনের জলে। যৌনকর্মীদের শারদীয়া, অনেক ঘা খুঁচিয়ে তোলে। 

More Articles