সাবর্ণদের ৪১৩ বছরের দুর্গাপুজো! পোড়া ল্যাটা মাছের ভোগে আজও অমলিন দুর্গার আরাধনা

Durga Puja 2022: সাবর্ণ পরিবারের পুজোর অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল মাষভক্তবলি অর্থাৎ পশু এবং অপদেবতার জন্য ১৮০ টি মাটির খুঁড়িতে মাষকলাই ঘি দিয়ে মাখিয়ে নিবেদন করা হয়।

কলকাতায় দুর্গাপুজোর ইতিহাস বেশ কয়েকশো বছরের পুরনো। ঐতিহ্য ও বনেদিয়ানার মিশেলে উমার আগমনের স্মৃতি আজও অমলিন বাঙালির হৃদয়ে। শহরের প্রাচীন বনেদি পরিবারগুলির মধ্যে অন্যতম বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার। সাবর্ণ রায়চৌধুরী ছিলেন কলকাতার জায়গীরদার। বাবু সংস্কৃতিতে জাঁকজমক করে দুর্গাপুজো শুরুর প্রায় একশো বছর আগে রায়চৌধুরী পরিবারে দুর্গাপুজো শুরু হয়। চারশো বছরেরও বেশি সময় ধরে এই জমিদার পরিবারে দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হয়। সাবর্ণদের আটটি বাড়িতে দেবীর আরাধনা চলে পুজোর চারদিন। থিম পুজোর প্রতিযোগিতার দিনেও ঐতিহ্যবাহী বনেদি বাড়ির সাবেকি প্রতিমা কলকাতাবাসীর নয়নের মণি।

১৬০৮ সালে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় বাংলার মানসিংহ প্রতাপাদিত্যকে দমন করে লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়কে বঙ্গের আটটি পরগনার নিষ্কর জমিদারি দিয়েছিলেন। যেটি উত্তরে হালিশহর থেকে দক্ষিণে লক্ষ্মীকান্তপুর পর্যন্ত বিস্তৃত। ১৬০৮ সালে জমিদারি পাওয়ার পর লক্ষ্মীকান্ত ও তাঁর স্ত্রী ভগবতী দেবী বড়িশার আটচালা বাড়িতে চণ্ডী মণ্ডপ নির্মাণ করে সপরিবারে দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেন।তবে ১৬০০ সাল থেকে হালিশহরের বাড়িতেও দুর্গাপুজোর প্রচলন ছিল। মাঝের কিছু বন্ধ থাকার পর লক্ষ্মীকান্ত ও তাঁর স্ত্রী সেই পুজো স্থানান্তরিত করে নিয়ে এলেন বড়িশার বাড়িতে। তৎকালীন সময়ে কলিকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানুটি জনপদের থেকেও বড়িশা উন্নত ছিল। ১৬১০ সালে বড়িশার বাড়িতে পুজো শুরু হয়।

সাবর্ণদের পরিবারে একচালার সাবেকি প্রতিমায় দেবীর পুজো হয়। তবে রায়চৌধুরী পরিবারের প্রতিমার বিশেষত্ব হল একচালার ওপর ত্রিচালা বসে অর্থাৎ টানাচৌরি আকৃতির চালচিত্র লক্ষ্য করা যায়। চালচিত্রে দশমহাবিদ্যা এবং রাধাকৃষ্ণের পট অঙ্কিত থাকে। দেবী প্রতিমার একপাশে থাকেন রামচন্দ্র, লক্ষ্মণ ও সীতা এবং অন্য পাশে থাকেন মহাদেব। পুজোর দিনগুলিতে তাদেরও নিত্য সেবা হয়। সাবর্ণদের পরিবারে বর্তমানে আটটি পুজো হয়। এর মধ্যে বড়িশার ছ'টি বাড়ি যথা আটচালা, বড়বাড়ি, মেজবাড়ি, বেনাকি বাড়ি, কালীকিংকর ভবন ও মাঝের বাড়ি এবং উত্তর ২৪ পরগনার রায়চৌধুরী বাড়ি এবং নিমতার একটি বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়।

আরও পড়ুন- কলকাতার পুজোর ভিড় থেকে মুক্তি? মন ভালো করবে জয়নগরের বনেদি বাড়ির এই পুজোগুলি

রায়চৌধুরী পরিবারের বংশধর শুভদীপ রায়চৌধুরী ইন্সক্রিপ্টকে জানান, "আটচালা বাড়ির দেবীর গায়ের রং হয় শিউলি ফুলের বোঁটার মতো। চোখ হয় পান পাতার মতো টানা। অসুরের গায়ের রং সবুজ এবং গণেশের রং লাল হয়। তবে অন্যান্য বাড়িগুলিতে দেবীর গায়ের রং স্বর্ণবর্ণের হয়ে থাকে।" প্রতিমার গড়ন সব বাড়িতেই একরকম হলেও বড়বাড়ি, মেজবাড়ি এবং নিমতা বাড়িতে সিংহ অশ্বমুখী অর্থাৎ বৈষ্ণব মতে তৈরি দেবীর প্রতিমা। তবে প্রতিটি বাড়িতেই কিন্তু অন্নভোগের নিয়ম রয়েছে। ষষ্ঠীর দিন সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের পুজোয় দেবীর বোধন হলেও আটচালা বাড়িতে কৃষ্ণানবমীর দিনে দেবীর বোধন হয়।

আটটি বাড়ির মধ্যে সাতটি বাড়িতেই দেবীকে আমিষ ভোগ নিবেদন করা হয়। আমিষ ভোগের মধ্যে থাকে খিচুড়ি, সাদা ভাত, পোলাও, পাঁচ রকমের ভাজা, মাছ, চাটনি ও পায়েস। তবে দশমীর দিন পান্তা ভাত, কচুর শাক, চালতার চাটনি, খেসাড়ির ডাল সহযোগে দেবীকে ভোগ দেওয়া হয়। শুভদীপ রায়চৌধুরীর কথায়, "আমাদের পুজোর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে যে সন্ধিপুজো হয় তাতে ১০৮ টি প্রদীপ এবং ১০৮ টি পদ্মের মতো একটি পোড়া ল্যাটা মাছ ভোগ দেওয়া হয়। এছাড়াও অতীতে পশু বলিদান প্রথা ছিল কিন্তু বর্তমানে তা বন্ধ রয়েছে। দশমীর দিন দেবী দুর্গাকে কনকাঞ্জলি দিয়ে বিদায় জানানো হয়। বাড়ির যিনি বয়োজ্যেষ্ঠা তিনি পুরোহিতের থেকে কনকাঞ্জলি নেন। এমনকী আমাদের অতীতে দুর্গাপুজোয় মাকে কাঁধে করে বিসর্জন দিতে নিয়ে যাওয়া হতো কিন্তু আজ সেই প্রথা বন্ধ থাকায় ট্রলারে করে বিসর্জনের জন্য প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হয়।"

আরও পড়ুন- মাটিতে পোঁতা ছিল তিন ফুটের দুর্গা! বাগবাজারের হালদার বাড়ির যে ইতিহাস আজও অবাক করে

সাবর্ণ পরিবারের পুজোর অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল মাষভক্তবলি অর্থাৎ পশু এবং অপদেবতার জন্য ১৮০ টি মাটির খুঁড়িতে মাষকলাই ঘি দিয়ে মাখিয়ে নিবেদন করা হয়। নবমীর দিন বড়বাড়ি এবং বিরাটি রায়চৌধুরী বাড়িতেই কেবলমাত্র কুমারী পুজোর নিয়ম রয়েছে। এছাড়া একমাত্র বিরাটি বাড়িতেই ধুনো পোড়ানোর রীতি রয়েছে। বিদ্যাপতি রচিত দুর্গা ভক্তিতরঙ্গিনী মতেই সবকটি বাড়িতে দেবী প্রতিমার আরাধনা করা হয়। অতীতে স্মৃতিতীর্থ, কাব্যতীর্থ উপাধিপ্রাপ্ত ব্রাহ্মণরা পুজো করতেন। তবে কালের নিয়মে সেই প্রথাতেও ইতি টানতে বাধ্য হয়েছে রায়চৌধুরী পরিবার। অতিমারির কারণে দু'বছর বাইরের মানুষের জন্য প্রতিমা দর্শনের সুযোগ না থাকলেও এবছর কিন্তু বনেদি রায়চৌধুরী বাড়ির দ্বার উন্মুক্ত রয়েছে সকলের জন্য।

শুভদীপ রায়চৌধুরীর কথায়, "এবছর দুর্গাপুজোয় 'বনেদি কলকাতার দুর্গোৎসব' নামে আমার একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। ওই বইতে বাংলায় দুর্গাপুজোর শুরুর থেকে বর্তমানে আমরা মা দুর্গার যে বিগ্রহ দেখি অর্থাৎ মা দুর্গা এবং তার সন্তানদের জন্য যে পৃথক পৃথক চালা আমরা দেখতে পাই তার একটি ঐতিহাসিক নথি আমার বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে তুলে ধরেছি। এছাড়াও কলকাতার সাতটি প্রাচীন বনেদি পরিবারের শুধু দুর্গাপুজো নয় তাঁদের পারিবারিক ইতিহাস এই বইতে লিপিবদ্ধ করা রয়েছে। এই পরিবারগুলির মধ্যে শোভাবাজার রাজবাড়ি, বড়িশার রায়চৌধুরীর বাড়ি, বাগবাজার হালদার বাড়ি, দক্ষিণ কলকাতার মিত্র পরিবার, ঘোষ রায় পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে পাল যুগের আমলে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গামূর্তির প্রচলন বেশি। এর মধ্যে নিখুঁত একটি মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি বাগবাজার হালদার বাড়িতে আজও পুজো হয়, যার ইতিহাস আমার বইতে ধরা রয়েছে।" এক কথায় বলা চলে, বাংলার মানুষের জন্য এক পুঙ্খানুপুঙ্খ ঐতিহাসিক দলিল তৈরি করেছেন লেখক শুভদীপ রায়চৌধুরী।

More Articles