বিয়ের মণ্ডপে বর হাজির ল্যাপটপ হাতেই, চলছে ‘ওয়ার্ক ফ্রম ওয়েডিং’

Work form home : ‘ওয়ার্ক ফর্ম হোম’, সুবিধা বেশ কিছু আছে ঠিকই, তবে এছাড়া অসুবিধাও রয়েছে ঢের

করোনা আবহে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে নতুন ট্রেন্ড, 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম।’ অর্থাৎ এখন জ্বর বা শরীর খারাপ হলেও অফিস থেকে নিস্তার নেই। বাড়িই বদলে হয়েছে দপ্তর। জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে অবসর। ব্যক্তিগত পরিবেশেও সেঁধিয়ে গিয়েছে অফিস। এমনকী বিয়ের আসরেও রেহাই মেলেনি অফিস থেকে। সম্প্রতি ভাইরাল একটি ভিডিওতে রয়েছে সেই নজিরই। বিয়ের পিঁড়িতে বসেও বরের কোলে ল্যাপটপ, মন্ত্রের পাশাপাশিই পুরোদমে চলছে ‘ওয়ার্ক ফর্ম ছাদনাতলা’।

২০২০ সাল, সবেমাত্র থাবা বসিয়েছে করোনা, নিমেষে থমকে গিয়েছিল ব্যস্ত জীবন। তবে ভয় একটু কাটিয়ে উঠতেই শুরু হয়ে যায় ‘নিউ নর্মাল’। নামেই নর্মাল, তবে আদ্যোপান্ত নতুন একটা পদ্ধতি। যার জেরে একটা চিরাচরিত অভ্যাস বদলে গেল নিমেষে। বদলে গেল রোজকার জীবনের হালচাল। আর সেই রেশ চলছে এখনও। অফিসে যাওয়ার জন্য বাসের পিছনে ছোটা নেই, নেই ট্রেন লেট থাকার ফিরিস্তিও। এমনকী ঠিক সময়ে অফিসে ঢুকতে না পারলে ‘লেট ফাইন’ করার হিসেবও এখন অস্তাচলে। এখন কেবল বাড়ি থেকেই ‘লগ ইন’ করার তাড়া। কিন্তু এই যে আস্ত একটা নতুন নিয়মে অচিরেই বাঁধা পড়ে গেলাম আমরা, কী তার পরিণতি? ওয়ার্ক ফর্ম হোম শাপে বর নাকি, গলার ফাঁস? ভাবাচ্ছে এসব প্রশ্ন।

আরও পড়ুন : এক মাসে ৩২ লক্ষ বিয়ে! বাঙালির বিয়ে যেভাবে হয়ে উঠল ‘ইভেন্ট’

মুঠোফোনে আচ্ছন্ন একটা গোটা প্রজন্ম। কলম ধরার বয়স থেকেই ফোন ধরছে শিশুরা। সবকিছুই এখন ওই চারকোণা যন্ত্রে আটকা পড়ে গেছে। বয়স আরেকটু বাড়লেই এ অভ্যাসে যোগ হচ্ছে ট্যাব, ল্যাপটপ সহ নানা কিছুই। যার জের এখন স্কুল কলেজ ছড়িয়ে অফিসে গিয়ে ঠেকেছে। সর্বক্ষণ হোয়াটসঅ্যাপ অথবা মেসেঞ্জারের টুং শব্দে সতর্ক আমরা। আর এই সতর্কতাই পিছু ধাওয়া করতে করতে এক্কেবারে হাজির হয়েছে ছাদনাতলায়। কী আর করা! বরও তাই একসঙ্গেই সামলাচ্ছেন দুই দায়িত্ব। সব্যসাচীর মতো। পুরোহিত মন্ত্র বলে যাচ্ছেন নিজের মতো, কানে শুনেই বিয়ের দায়টুকু সারছেন বর। কিন্তু হাত চলছে ল্যাপটপে। আসল ঘটনা অবশ্য জানে না কেউই। তবে ছবি দেখে নিজেদের জীবনের সঙ্গে তুলনা টানাকেই দস্তুর ভাবছেন নেটিজনেরা। আর কপাল চাপড়ে দেখে নিচ্ছেন, ভাবছেন তাদের জীবনেও এমন দশাই আসন্ন বুঝি!

ধরা যাক, বিয়ের দিন সবেমাত্র মন্ত্রপাঠ শুরু হয়েছে মণ্ডপে। পুরোহিত বুঝি হাতে তুলে দিয়েছেন ফুল অথবা কুশি। এইবারই বলতে হবে সেই চিরাচরিত মন্ত্র ‘যদিদং হৃদয়ং তব’, ব্যাস এমন সময় হঠাৎ নোটিফিকেশনের শব্দ। আর ওমনি সব ফেলে পাশে রাখা ল্যাপটপটা কোলে তুলে টাইপ করতে লাগলো বর। ভাবুন তো এবার, ‘হৃদয়ং’-এর হৃদয় খানা আসলে কোথায় বাধা পড়লো তাহলে!

‘ওয়ার্ক ফর্ম হোম’, সুবিধা বেশ কিছু আছে ঠিকই। এই যেমন বাড়িতে থাকার সময়সীমা বেড়েছে। একটু ফিকির খুঁজে দুয়েকটা নিমন্ত্রণ খেয়ে নেওয়াও যাচ্ছে বেশ কিছু সময়। তবে অসুবিধাও রয়েছে ঢের। এখন আর কোনো কিছুরই নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। খাওয়া, ঘুম সবই চলছে অফিসের বয়ানে।

এর একটা বড় দিক হল, কর্পোরেটের প্রেসারে আমাদের শরীর দিন দিন এমন একটা যন্ত্রে পরিণত হয়েছে যে কাজ ছাড়া থাকতে নেই, এমনটাই বিশ্বাস করেছে সে। তাই কাজের তথাকথিত সময়সীমার বাইরেও নজর রাখছে গ্রুপে। ছুটির দিনেও এর অন্যথা নেই। তার ওপর বাড়িতে থেকেই কাজ বলে হিসেবের ছুটিও গেছে কমে। তাই অহেতুক ছুটি নষ্ট করেনা কেউই। যাতে বছর শেষে কটাদিন বাইরে ঘুরতে যেতে পারে। ফলে অবসরকে নিয়ত গ্রাস করছে এই প্রক্রিয়া। আর সবশেষে যেটা না বললেই নয়, তা হল টার্গেটের চাপ। বছরের শেষে হিসেবে খামতি হলে আর ব্যক্তিগত জীবনে কীই বা এল, কীই বা গেল! কর্পোরেট জীবনের একটা নেশা আছে। বুঁদ হয়ে থাকি আমরা। একটা অকৃত্রিম উপরে ওঠার হাতছানি সর্বক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে আমাদের। এর বুঝি সত্যিই কোনও শেষ নেই। আরও খানিক নিজেকে প্রমাণ করা, প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে আরও খানিকটা ছুটে নেওয়া, এটাই জীবন হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। তাই সম্প্রতি নেটমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া বিয়ের সকালের ছবিটি, যেখানে ল্যাপটপ হাতে বরের বেশে বসে রয়েছেন একজন, তা সাময়িকভাবে হাস্যকর মনে হলেও, এর আড়ালের ছবিটা মোটেই মজার নয়।

আরও পড়ুন : ওয়ার্ক ফ্রম হোমে বিরক্ত? এই বাস্তু টিপসগুলি আপনাকে করে তুলবে আবার চনমনে

কোভিড মহামারির পর অনেকেই বাড়িতে বসে কাজ করেন কিন্তু বিয়ের মণ্ডপে বরের এই হাল দেখে তাজ্জব সকলেই। সম্প্রতি ছবিটি ইন্সটাগ্রাম থেকে শেয়ার হওয়া মাত্রই ঝড় তুলেছে নেট মাধ্যমে। যদিও বাঙালি বিয়ের এ ঘটনাই প্রথম নয়, এর আগেও কিছু ক্ষেত্রে সামনে এসেছে এরকম ঘটনা। কিছুদিন আগেই মহারাষ্ট্রের এক বিয়েবাড়িতে দেখা গিয়েছে এক চিত্র। বিয়ের আসরে বর, বউ দু’জনেই রয়েছেন, রয়েছেন পুরোহিতও। কিন্তু বরের কোলে রয়েছে সেই ল্যাপটপ। যেন বিয়ের ছুটি কাটছাঁট করে, কাজের ফাঁকে ফাঁকেই সেরে নিচ্ছেন আচার। আর এইসব ঘটনাই ভাইরাল হচ্ছে নিমেষের মধ্যে। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে এ আর নতুন কি!

চিকিৎসকরাও রীতিমত চিন্তিত এই নিয়ে। এই কাজের চাপ তো কেবল কয়েকটা প্রশ্নেই শেষ হয়ে যাচ্ছে না। এর সঙ্গে এসে জড়ো হয়েছে নানারকম শারীরিক সমস্যাও। এক জায়গায় বসে ১০ ঘণ্টা থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ, এ ডেকে আনছে স্পন্ডেলাইটিস, বাত, মাইগ্রেন, ওবেসিটি এবং চোখের সমস্যার মতো হাজারটা রোগকে। ছুটি বাঁচানো নাকি কাজের চাপে যন্ত্রসম হয়ে যাওয়া, হাজার প্রশ্নের ভিড়ে জর্জরিত বর্তমান প্রজন্ম। তবে লাখ টাকার প্রশ্ন তো একটাই। পেশাগত জীবন কি এভাবেই গিলে খাবে ব্যক্তিগত পরিসরকে? নাকি বদল আসবে? উত্তর দেবে ভবিষ্যতই।

More Articles