ইউক্রেনে ভিটেমাটি হারাল কয়েক লক্ষ, কোথায় যাবেন শরণার্থীরা
ভিটেমাটি বড় প্রিয়। ছাড়তে চায় না কেউ। তবু নিরাপত্তা বড় দোহাই। তাই প্রাণটুকু বাঁচাতেই সন্তান কোলে ইউক্রেন ছাড়ছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। এ শতকটা রিফিউজির শতক, শরণার্থীর শতক। এর আগেও মায়ানমারে রোহিঙ্গানিধন পর্বের পরে ইউরোপের দেশগুলির সীমান্তে ভিড় করেছেন উদ্বাস্তুরা। আফগানিস্তান থেকে রাতারাতি পালিয়েছেন লক্ষ বাসিন্দা। আরও একবার যুদ্ধের দামামা, ঘরছাড়া হচ্ছেন ইউক্রেনিয়রাও। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখনও পর্যন্ত প্রায় ছয় লক্ষ মানুষ ইউক্রেন ছেড়ে পালিয়েছেন। আশঙ্কা সংখ্যাটা চল্লিশ লক্ষে দাঁড়াতে পারে। গত সপ্তাহে রাশিয়ার আক্রমণের পর থেকেই ক্রমাগত বেড়ে চলেছে রিফিউজির সংখ্যা। পশ্চিমের দেশগুলির সীমা পেরিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে রিফিউজি ঢুকে পড়ছে পোল্যাণ্ড, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, মলদোভা প্রভৃতি দেশগুলিতে।
এ পর্যন্ত পোল্যান্ড আশ্রয় দিয়েছে ৩৭৭০০০ জন রিফিউজিকে। পোলিশ সরকার জানিয়েছে তারা প্রতিদিন ৫০ হাজার রিফিউজিকে আশ্রয় দিতে রাজি। একটি মেডিক্যাল ট্রেইনও চালু করছে পোল্যান্ড ইউক্রেনিয়ানদের নিয়ে আসার জন্য। এই বিষয়ে তারা ১২৩০ টি হাসপাতালের তালিকা তৈরি করেছে। আহতদের সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে ট্রেনটির মাধ্যমে। এ পর্যন্ত দশ লক্ষেরও বেশি ইউক্রেনিয়ান উদ্বাস্তু পোল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছেন। বিশেষত ২০১৪তে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পর থেকেই এই সংখ্যা বেড়ে চলেছে।
বাকি দেশের হিসেব পয়লা মার্চ রাত একটা পর্যন্ত যা ঘোষণা করেছে ইউএন–
- হাঙ্গেরি আশ্রয় দিয়েছে ৮৯৫৬১ জনকে
- মলদোভা আশ্রয় দিয়েছে ৬৫৩৯১ জনকে
- স্লোভাকিয়া আশ্রয় দিয়েছে ৫৪৩০৪ জনকে
- রোমানিয়া আশ্রয় দিয়েছে ৩৮৪৬১ জনকে
- বেলারুশ আশ্রয় দিয়েছে ৩২৯ জনকে
৫১৭৯৭ জন ছড়িয়ে গিয়েছেন ইউরোপের বাকি দেশগুলিতে।
ইতিমধ্যে উদ্বাস্তুদের জানানো হয়েছে, যে প্রতিবেশী দেশগুলিতে প্রবেশের জন্য তাদের কোনও রকম নথিপত্রের প্রয়োজন হবে না। তবে আভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক ট্রাভেল পাসপোর্ট, সঙ্গে থাকা বাচ্চাদের বার্থ সার্টিফিকেট এবং মেডিক্যাল রিপোর্ট কাছে রাখা ভাল। রিফিউজি হিসেবে তারাই গণ্য হবেন যারা ইউক্রেনের নাগরিক অথবা সরকার স্বীকৃতভাবে ইউক্রেনে বসবাস করেন। যেমন অনেক বিদেশী ছাত্রই পড়াশোনার জন্য ইউক্রেনে থাকেন। তবে রিফিউজি সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলায় নানা রকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বহু মানুষকে পোল্যান্ডে প্রবেশের জন্য প্রায় ষাট ঘন্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে সীমানায়। চারিদিকে প্রচণ্ড শীত। বরফ। তার মধ্যে ১৫ কিলোমিটার ব্যপী লাইন লেগে রয়েছে উদ্বাস্তুদের। এই অবস্থা সত্যিই ভয়াবহ। রোমানিয়াতে প্রবেশের জন্যও প্রায় ঘন্টা কুড়ির লাইন দিতে হচ্ছে। অনেকেই ইউক্রেন থেকে বেরনোর জন্য যে ট্রেইনগুলি ব্যবহৃত হচ্ছে, সেগুলিতে চড়তে পারছেন না।
পোল্যান্ড এবং অন্যান্য আশ্রয়দাতা দেশগুলি উদ্বাস্তুদের সুবিধার জন্য নানা ব্যবস্থা নিয়ে চলেছে। প্রথমত সেখানে বহু রিসেপশন সেন্টার তৈরি হয়েছে। যে সব রিফিউজির কোনও পরিচিত ব্যক্তি এইসব দেশে বাস করেন না, যাদের কোনও রকম মাথা গোঁজার জায়গা নেই, তারা এই রিসেপশন সেন্টারগুলিতে থাকবেন। তাদের খাবার দাবার এবং চিকিৎসার সমস্ত রকম সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে। হাঙ্গেরি এবং রোমানিয়া নগদ ভাতা দিচ্ছে খাদ্য-বস্ত্রের জন্য। স্থানীয় স্কুলগুলিতে শিশুদের জায়গা দেওয়া হচ্ছ। এর আগে রিফিউজিদের রিসেপশন ক্যাম্পে আশ্রয় দেওয়ার একটা সময়সীমা বেঁধে দিত আশ্রয়দাতা দেশগুলি। কিন্তু এবারে সে সব কিছুই মানা হচ্ছে না। বেশিরভাগ দেশই জানিয়ে দিয়েছেন, ইউক্রেনের উদ্বাস্তুরা যতদিন প্রয়োজন থাকতে পারবেন রিসেপশন ক্যাম্পগুলিতে। চেক রিপাবলিক তাদের ‘মাইগ্রেশন ওয়েভ প্রিপেয়ার্ডনেস প্ল্যান’ চালু করেছে। এই পরিকল্পনা প্রয়োজনে এক বিশেষ ধরনের ভিসা পেতে উদ্বাস্তুদের সাহায্য করবে। সমস্ত ব্যবস্থাপনা হবে অত্যন্ত সহজ সরল। এই ভিসার মাধ্যমে দীর্ঘদিন চেক রিপালবিকে থাকতে পারবেন উদ্বাস্তুরা।
ব্রিটিশ-র প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জানিয়েছেন, ২ লক্ষ ইউক্রেনিয়ান রিফিউজিকে জায়গা দিতে পারবেন তাঁরা। এছাড়াও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যারা পালিয়ে আসছেন তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। এমনকি প্রত্যেক রিফিউজির অর্থনৈতিক দায়ভার বহন করতে পারে ইউ কে। এ ব্যাপারে তাঁদের স্বরাষ্ট্র কার্যালয় আরো বিশদে জানাবে বলে খবর। প্রসঙ্গত, পূর্বে ইউনাইটেড কিংডম জানিয়েছিল, একমাত্র কোনও আত্মীয় স্বজন ব্রিটেনে থাকার ভিত্তিতেই তারা ইউক্রেনিয়ান উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিতে সম্মত হবে। ২৭ ফেব্রুয়ারি ব্রিটেন ‘টেম্পোরারি ভিসা কনসেশনস’ ঘোষণা করে। এই নীতি অনুসারে উদ্বাস্তুরা একটি বিনামূল্যে পারিবারিক মাইগ্রেশন ভিসার জন্যে আবেদন করতে পারে, যদি তাদের ব্রিটিশ আত্মীয়–
- সম্পর্কে স্বামী / স্ত্রী বা নাগরিক সহাবস্থানের সঙ্গী হয়।
- অবিবাহিত সঙ্গী (এক্ষত্রে অন্তত বছর দুয়েকের লিভ ইন সম্পর্ক বাধ্যতামূলক)
- অভিভাবকাদি (এক্ষেত্রে আবেদনকারীর বয়েস ১৮-র কম হওয়া বাধ্যতামূলক)
- আঠেরো বছরের কম বয়েসী কিশোর
- প্রাপ্ত বয়স্ক আত্মীয়, যার দেখভাল করেন আবেদনকারী বা স্বাস্থ্যজনিত কারণে যদি তাঁর সাথে থাকতে হয় আবেদনকারীকে।
- ঠাকুমা ঠাকুর্দা, দাদু দিদা
- প্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান সন্ততি
- ভাইবোন
- খুব কাছের পারিবারিক সম্পর্কের কেউ
কিয়েভের ভিসা প্রোসেসিং সেন্টারটি বর্তমানে বন্ধ। তবে লিভিভের কার্যালয়টি খোলা রয়েছে। এবং মানুষজন প্রতিবেশী দেশগুলি থেকেও এই ভিসার জন্যে আবেদন করতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকেই যায়, ব্রিটেনের যা ক্ষমতা, সে অনুযায়ী যথাসাধ্য সাহায্য তারা করছে কি?
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ জানিয়েছে ইউক্রেনের ভিতরেই নিজের বাস্তু থেকে উৎখাত হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার। দেশের ভিতরেই উদ্বাস্তু এই মানুষেরা। ই ইউ আশঙ্কা করছে সংখ্যাটা বেড়ে ৭০ লক্ষে দাঁড়াতে পারে। এবং প্রায় ১ কোটি ৮০ লক্ষ ইউক্রেনিয়ান যুদ্ধের বিষময় ফল ভোগ করবে। হিউম্যানিটারিয়ান এইড এবং ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের ইউরোপিয়ান কমিশনার জেনেজ লেনারিক জানান, “সংখ্যাগুলি যদিও খসড়ার পর্যায়ে, তবু সামগ্রিক অঙ্কটা নেহাত কম নয়। বিপুলাকারের এই ঐতিহাসিক উদ্বাস্তু সঙ্কটের জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে।” ইউ এনের হাই কমিশন জানিয়েছে তারা এই ইউক্রেনের ভিতরেই থাকা উদ্বাস্তুদের সাহায্য করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যুদ্ধের পরিস্থিতি উদ্ধারকর্মীদেরও নিরাপত্তা ব্যহত করছে পদে পদে। তাই ইউএন আপাতত ইউক্রেনের পশ্চিম ভাগে উদ্ধারকার্য পরিচালনাকেই গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি, কারণ এই অঞ্চলে কাজ চালানো তুলনামূলক ভাবে সহজ।