অভাবনীয় বৃদ্ধি সম্পত্তির! উইপ্রো, নেসলে, ওএনজিসির থেকেও ধনী তিরুপতি মন্দির

Tirupati Balaji Temple Asset: তিরুপতি মন্দির সম্পদের দিক থেকে দেশের বৃহত্তম কোম্পানি যেমন উইপ্রো, নেসলে এবং ওএনজিসিকেও ছাড়িয়ে গেছে। সোজা কথায়, তিরুপতি মন্দির দেশের এই তিনটি বড় কোম্পানির থেকেও ধনী।

যে মন্দির যত ধনী, সেই মন্দিরের দেবতা নাকি তত জাগ্রত। কিংবা উল্টোটাও বলা যায়, যে দেবতা যত জাগ্রত, সেই মন্দির তত ধনী। এসব নিয়ে তর্কের আসর বসানো এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। বিশ্বাসীরা মন্দিরের পুজো দিন, দান করুন, মানত করুন, আর অবিশ্বাসীরা মন্দিরের ইতিহাস, শিল্পকলা দেখেই মনকে খুশি করুন, যাই করুন না কেন- অগ্রাহ্য করতে পারবেন না যে এই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দেশে মন্দিরকে ঘিরেই রাজনীতি, মন্দিরকে ঘিরেই অর্থনীতি, মন্দিরকে ঘিরেই সমাজও! তাই দেশের ধনীতম প্রতিষ্ঠানের তালিকায় থাকে মন্দিররা। এই তালিকার একছত্র অধিপতি বলা যায় এই বিশেষ মন্দিরকে। অবশ্য শুধু দেশই নয়, বিদেশেও এই মন্দির দারুণ বিখ্যাত। আমাদের দেশের ধনী মন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম তিরুপতি বালাজি মন্দির। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, কলিযুগের দুঃখ ও যন্ত্রণা থেকে মানব সমাজকে ত্রাণ করতে বিষ্ণু তিরুমালায় ‘ভেঙ্কটেশ্বর’ রূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। এই মন্দিরের আরাধ্য দেবতার প্রতি ভক্তদের বিশ্বাস অসীম। বালাজির কাছে ভক্তি ভরে যা চাওয়া যায় তাই নাকি পাওয়া যায়। আর মনোবাঞ্ছা পূরণ হলেই ভক্তরা সোনা সহ নানা মূল্যবান ধাতু, অর্থ ইত্যাদিতে মুড়ে দেন ঈশ্বরের মূর্তিকে।

আজও আমাদের দেশে ধর্মই সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করে। কেজো বিষয়গুলি নিয়ে তাই মোদির ভারতে মাথা ঘামনো হয় কম। উল্টে মন্দির নিয়ে বেশি মাতামাতি দেশ জুড়ে। আর ভক্তরাই দেশ জুড়ে মন্দির ব্যবসাকে বাঁচিয়ে রাখেন। এটাই এদেশের দস্তুর। তবে মন্দির ব্যবসায় অনেকটা এগিয়ে দক্ষিণ ভারত। এবার রীতিমতো রেকর্ড গড়ল তিরুপতি বালাজি মন্দির। ভক্তদের নানাবিধ দানে এই মন্দিরের তহবিলে প্রতি বছর যে পরিমাণ টাকা জমে তা চোখ কপালে তুলে দেওয়ার মতো। শুধু একমাসেই এই মন্দির যা আয় করেছে তা তাক লাগিয়ে দেবে। তিরুমালা তিরুপতি দেবস্থানম (টিটিডি) শ্রী ভেঙ্কটেশ্বর স্বামীর ভক্তদের কাছ থেকে অনুদানের আকারে ১৩০.২৯ কোটি টাকারও বেশি সংগ্রহ করেছে কেবল মে মাসে। হুণ্ডি সংগ্রহে একটি সর্বকালের রেকর্ডও গড়েছে, গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন টিটিডি-র কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা এভি ধর্ম রেড্ডি।

আরও পড়ুন- ঈশ্বরকে দীপাবলি উপহার! শিরডি সাই মন্দিরে ১.৫ কোটি টাকা দান অনন্ত আম্বানির!

তাঁর কথায়, মে মাসে তিরুমালার শ্রী ভেঙ্কটেশ্বর স্বামীর মন্দিরে ২২,৬২,০০০ ভক্ত এসেছিলেন। ১.৮৬ লক্ষ লাড্ডু বিক্রি হয়েছে, প্রায় ৪৭ লক্ষ ভক্ত মাতৃশ্রী তারিগোল্ডা ভেঙ্গামাম্বা অন্নপ্রসাদ ভবনে ‘অন্নপ্রসাদম’ গ্রহণ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, এই একই মাসে দেবতাকে চুল দান করেছেন ১০,৭২,০০০ ভক্ত। হিসেব অনুযায়ী, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দৈনিক প্রায় ২০ হাজার ভক্ত এই মন্দিরে চুল দান করেন। আর ভক্তদের চুল কাটার জন্য মন্দিরে রয়েছে ৫০০-র বেশি নাপিত। বাকি হিসেবটা আপনাদেরই হাতে।

মে মাসে রেকর্ড সংখ্যক ভক্তদের তিরুমালা পরিদর্শনের অন্যতম কারণ হল, দুই বছর ধরে চলা মহামারী। করোনা পরিস্থিতিতে মন্দিরে আসতে পারেননি ভক্তরা। তার উপর, মে মাসে গরমের ছুটি চলায় ব্যাপক পরিমাণে ভক্তরা মন্দির দর্শনে এসেছেন। কার্যনির্বাহী আধিকারিকরা জানিয়েছেন, শনি ও রবিবার তিরুমালায় অপ্রত্যাশিত ভিড় হয়। সপ্তাহান্তে ভেঙ্কটেশ্বরের দর্শন পেতে ভক্তদের দু’দিন ধরে অপেক্ষা করতে হয়।

ইতিমধ্যেই তামিলনাড়ুর ভক্তরা টিটিডি-এর অধীনে বিভিন্ন ট্রাস্টে অনুদানের আকারে ১০ কোটি টাকা দিয়েছেন। চেন্নাইয়ের এক ভক্ত সরোজা সূর্য নারায়ণন, হিরে জড়ানো একটি সোনার সুতো এবং ২.৪৫ কোটি টাকা মূল্যের ৪.১৫০ কিলোগ্রাম ওজনের একটি সোনার নেকলেসও দান করেছেন তিরুপতি বালাজিকে, জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

এ তো গেল মে মাসের হিসেব। সম্প্রতি আরও একটি প্রতিবেদন পেশ করা হয়েছে মন্দির কর্তৃপক্ষ থেকে। বলা হয়েছে, তিরুমালা তিরুপতির মোট সম্পত্তির পরিমাণ ২.২৬ লক্ষ কোটি টাকা। এতে আরও বলা হয়েছে যে, ব্যাঙ্কে ৫,৩০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের ১০.৩ টন সোনাও জমা আছে। এর বাইরে নগদ ১৫,৯৩৮ কোটি টাকা জমা রয়েছে। যেখানে ২০১৯ সালে সোনা জমা ছিল ৭.৪ টন, গত তিন বছরে তাই ২.৯ টন বেড়ে গেছে। আগে ব্যাঙ্কে স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ ছিল ১৩,০২৫ কোটি টাকা, সেখানে এখন তা বেড়ে ১৫,৯৩৮ কোটি হয়েছে। অর্থাৎ তিন বছরে ২,৯০০ কোটি টাকা বেড়েছে।

সম্পত্তির খতিয়ান তুলে ধরতে গিয়ে টিটিডির চেয়ারম্যান আরও জানান, দেশ জুড়ে মন্দিরের অছি পরিষদের মোট ৯৬০ টি সম্পত্তি রয়েছে যার মূল্য ৮৫,৭০৫ কোটি টাকা। তাঁর কথায়, ১৯৭৪ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে সরকারের আমলে ১১৩ টি অছি পরিষদের সম্পত্তি বিক্রি হয়েছে।

আরও পড়ুন- চুলের ওজন এক কেজি, দৈর্ঘ্যে ৭ ফুট! যা দেখতে এই গ্রামে আসেন সারা পৃথিবীর পর্যটক

প্রশ্ন উঠছে, গত বছরই শ্বেতপত্র প্রকাশ হওয়ার পর আবার নতুন করে এই বছর দ্বিতীয় শ্বেতপত্র কেন প্রকাশ করা হল? এর উত্তরে মন্দির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত কয়েকদিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই দাবি করেছেন যে মন্দিরের উদ্বৃত্ত তহবিল অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারের নিরাপত্তা বিভাগে লগ্নি করা হয়। কিন্তু এই দাবি সত্যি নয়। নতুন প্রকাশিত শ্বেতপত্রে এই দাবি খারিজ করেছে তারা। ট্রাস্টের দাবি, উদ্বৃত্ত তহবিল নির্ধারিত ব্যাঙ্কেই লগ্নি করা হয়। তাই ভক্তরা যেন এই ষড়যন্ত্রমূলক প্রচার বিশ্বাস না করেন। ট্রাস্টের আরও দাবি, বিভিন্ন ভক্ত, ব্যবসায়িক সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানের অনুদানই তাদের আয়ের একমাত্র উৎস।

মন্দিরের তরফে জানানো হয়েছে, নিয়ম অনুসারে ব্যাঙ্ক গচ্ছিত দানের ওপর চড়া সুদ দেয়। মন্দিরের নামে ব্যাঙ্কে দান হিসেবে টাকা বা সোনা জমা করতে গেলে বোর্ডের অনুমোদন লাগে। বিনিয়োগ সংক্রান্ত নির্দেশিকা মেনেই ব্যাঙ্ক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা এবং সোনা জমা রাখা হয়। মন্দিরের তরফে সেইসব ব্যাঙ্কেই টাকা গচ্ছিত রাখা হয় যেখানে সুদের হার বেশি।

আরেকটি চাঞ্চল্যকর তথ্য হল, তিরুপতি মন্দির সম্পদের দিক থেকে দেশের বৃহত্তম কোম্পানি যেমন উইপ্রো, নেসলে এবং ওএনজিসিকেও ছাড়িয়ে গেছে। সোজা কথায়, তিরুপতি মন্দির দেশের এই তিনটি বড় কোম্পানির থেকেও ধনী। তিরুমালা তিরুপতি দেবস্থানমের (টিটিডি) দেওয়া বিশদ বিবরণের ভিত্তিতে যে তথ্য পাওয়া গেছে সেই অনুসারে, তিরুমালায় ভেঙ্কটেশ্বরের মন্দিরের সম্পদের পরিমাণ ২.৫ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি (প্রায় $৩০ বিলিয়ন), যা তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা উইপ্রো, খাদ্য ও পানীয় সংস্থা নেসলে এবং ইন্ডিয়ান অয়েলের মূলধনের চেয়েও বেশি। স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুসারে, বর্তমান ট্রেডিং মূল্যে, তিরুপতি মন্দিরের নেট মূল্য অনেক ‘ব্লুচিপ’ ভারতীয় কোম্পানির চেয়ে বেশি। সুইস বহুজাতিক কোম্পানি নেসলের ভারতীয় ইউনিট, যা খাদ্য ও পানীয় উত্পাদন করে, এর বাজার মূলধন ১.৯৬ লক্ষ কোটি টাকা। পাবলিক সেক্টরের উদ্যোগ অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস কর্পোরেশন লিমিটেড (ওএনজিসি) এবং আইওসি-এরও তিরুপতি মন্দিরের ট্রাস্টের তুলনায় কম মূলধন রয়েছে। ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন (এনটিপিসি) লিমিটেডের বাজার মূলধনও এই মন্দিরের সম্পত্তির চেয়ে কম।

More Articles