আনিস কাণ্ডে কেন কাঠগড়ায় পুলিশ, ফিরছে রিজওয়ান স্মৃতি

হাওড়া আমতার ছাত্রনেতা আনিস খানের রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় ইতিমধ্যেই বাংলা রাজনীতি একেবারে তোলপাড়। অভিযুক্তদের গ্রেফতারের দাবিতে মহাকরণ অভিযান থেকে শুরু করে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শহিদ স্মরণ, এমনকী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনেও প্রদর্শিত হয়েছে বিক্ষোভ। মহাকরণের সংখ্যালঘু উন্নয়ন দপ্তর ঘেরাও করা থেকে শুরু করে সিআইটি রোড এবং শিয়ালদহ ফ্লাইওভারের মাঝামাঝি এলাকায় পুলিশের সঙ্গে পড়ুয়াদের ধস্তাধস্তি, আনিস খান হত্যাকাণ্ড প্রতিদিনই নতুন নতুন বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে। আসল হত্যাকারী কে? পুলিসকর্মীরাই কি আনিস খান কে মেরেছে? এখনও সবটা অজানা। আনিসের বাবা ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য তার দেহ কবর থেকে তুলতেও অনুমতি দেননি। কিন্তু আনিসের বাবার দাবি পুলিশই ছেলেকে খুন করেছে।

অন্য দিকে আবার আনিস খানের রহস্য মৃত্যুর ঘটনায় কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগে আমতা থানার তিন পুলিসকর্মীর বিরুদ্ধে শাস্তি মূলক ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন। এএসআই নির্মল দাস, কনস্টেবল জিতেন্দ্র হেমব্রমকে সাসপেন্ড করা হয়েছে এবং হোমগার্ড কাশীনাথ বেরাকে কাছ থেকে সম্পূর্ণরূপে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মৃতের পরিবারের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগও উঠেছে। সূত্রের খবর, আনিসের পরিবারের তরফ থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগ আনা হয়েছিল তার ভিত্তিতেই এই ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ। 

আমতা থানায় পুলিশকে ঘেরাও থেকে শুরু করে পরিবারের অনুমতি বিনা ময়নাতদন্ত, সব কিছুই ঘটে গিয়েছে এই কয়েকদিনের মধ্যে। প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধেও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের ভূমিকা নিয়েও একাধিক প্রশ্ন চিহ্ন উঠেছে। একদিকে যেমন মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, আনিস নাকি তার ফেভারিট ছিল, এবং নির্বাচনের সময় মুখ্যমন্ত্রী কে সাহায্য করেছিল, সেখানেই প্রশ্ন উঠছে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ থাকা সত্বেও আনিসের নিরাপত্তাহানি ঘটলো কি ভাবে? শিক্ষাবিদ এবং বুদ্ধিজীবীদের প্রশ্ন, চাকরি দেওয়ার লোভ দেখানো বা গদিতে থাকার জন্যেই মুখ্যমন্ত্রীর এরকম ঘোষণা নয় তো? বিরোধী দল বিজেপিই বা এই মৃত্যু রহস্য নিয়ে এতটা শান্ত কেন? দিলীপ ঘোষ কিংবা সুকান্ত মজুমদারের মতো নেতারা আজকে তেমনভাবে সরকারের বিরুদ্ধে তেমন একটা প্রশ্ন তুলছেন না কেন? সর্বোপরি, বামফ্রন্ট এবং এসএফআই কর্মীরা আনিস খানের মৃত্যু নিয়ে এতটা সোচ্চার কেন? সব প্রশ্নেরই উত্তর লুকিয়ে রয়েছে আনিসের জীবদ্দশার বিভিন্ন ঘটনায়। 

আনিস কোন দলের?

মৃত আনিস খান কোন দলের সদস্য? আমতার এই ছাত্র নেতার মৃত্যুর পর বিজেপি ব্যতিরেকে প্রায় প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল আনিসকে নিজেদের দলের কর্মী বলে দাবি করে এসেছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় তো সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন, গত বিধানসভা ভোটের শাসক দলকে সাহায্য করেছিল আনিস খান। কোন দিকে আবার মমতার দাবি নস্যাৎ করে দিয়েছে বাম ছাত্র সংগঠন এসএফআই। তারা আনিসকে একেবারে 'কমরেড' বলেই দেগে দিয়েছে। বাম নেতারা দাবি করছেন, কমরেড আনিস খান বামপন্থী ছিলেন। অন্যদিকে আবার, আব্বাস সিদ্দিকী এবং নওশাদ সিদ্দিকী দাবি করছেন আনিস খান নাকি আইএসএফ-র কর্মী। তবে এই তিনটি দল ছাড়াও তাদেরকে নিজের লোক হিসেবে দাবী করছে আরো একটি রাজনৈতিক দল। সেটি হল হায়দ্রাবাদের আসাদুদ্দিন ওয়াইসি পরিচালিত এআইএমআইএম। একটি ভিডিও প্রকাশ করে আনিসকে তাদের লোক বলে দাবি করেছে এআইএমআইএম। বাকি রয়েছে কংগ্রেস। তারাও আনিসকে ছাত্র পরিষদের সদস্য বলে উল্লেখ করে দিয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠছে, আনিস খান আদৌ কোন দলের কর্মী? তার রাজনৈতিক পরিচয়টা ঠিক কি? 

যদিও এই সমস্ত বিতর্ক শুরু হয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরেই। সোমবার নবান্নের সাংবাদিক বৈঠকে আনিস খানকে নিজেদের 'ফেভারিট' ছেলে বলে দাবি করেছেন মমতা। আবার মুখ্যমন্ত্রীর দাবি উড়িয়ে দিয়েছে বাম ছাত্র সংগঠন এসএফআই। এসএফআইয়ের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্যের জানিয়েছেন, 'মুখ্যমন্ত্রী অসত্য কথা বলছেন। বিধানসভা নির্বাচনের আগে সংযুক্ত মোর্চার ব্রিগেড সমাবেশে এসেছিল আনিস। সে আমাদের দলের কর্মী ছিল।' যদিও আনিসের দাদাও নিজে জানিয়েছেন, আনিস কখনো তৃণমূল করেনি। 

এই সমস্ত বিতর্কের মাঝখানে আনিসের ফেসবুক পেজ জুড়ে একাধিক শাসক-বিরোধী পোস্ট বামেদের দাবিকে কিছুটা সমর্থন করে। পশ্চিমবঙ্গে চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন থেকে শুরু করে হিজাব বিতর্কে মমতা কেন নীরব? সেই সব কিছু নিয়েই প্রশ্ন তুলে গিয়েছেন আনিস খান। অন্যদিকে আবার ভাঙ্গড়ের আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকী বলেছেন, তিনি নাকি ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্টের হাওড়া শাখার কর্মী। তাঁর কথায়, বিধানসভা নির্বাচনের সময় নাকি আইএসএফ এর হয়ে কাজ করেছিল আনিস খান। এছাড়াও, আনিসের ফেসবুক পেজে আইএসএফ দলের কিছু উল্লেখ রয়েছে। ফলে তাঁর দাবিকেও একেবারে ফেলে দেওয়া যায় না। এরই মধ্যে, মিম একটি ভিডিও শেয়ার করে দাবি করেছে, তাদের সভায় বক্তব্য রেখেছিল আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত ছাত্রনেতা আনিস খান। আসাদুদ্দিন ওয়াইসি দাবি করছেন, তার দলের হয়ে কাজ করতো আনিস। তার মধ্যেই আবার, কংগ্রেস ছাত্র পরিষদের যোগদান নিয়ে বড় ঘোষণা করেছেন সংগঠনের রাজ্য সভাপতি সৌরভ প্রসাদ। তিনি জানিয়েছেন, ২০১৮ সালের ২৮ আগস্ট নাকি আনিস খান কংগ্রেস ছাত্র পরিষদে যোগদান করেছিল। ফলে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও, তিনি কোন দলের কর্মী সেই নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা কাটেনি। 

আনিসের বাবার বক্তব্য

মৃত আনিস খানের বাবা জানিয়েছিলেন তিনি নিজের চোখের সামনে নিজের ছেলেকে খুন হতে দেখে ছিলেন। তার অভিযোগ ছিল, শুক্রবার গভীর রাতে পুলিশের পোশাকেই চারজন আনিসের বাড়িতে আসে এবং তাকে উপর থেকে রাস্তায় ধাক্কা মেরে ফেলে হত্যা করে। পুলিশকে এই ঘটনার কথা জানালেও তাদের কাজের গড়িমসি দেখে আরো হতবাক হয়ে যান আনিসের বাবা। আমতা থানায় অভিযোগ জানানো হলেও পুলিশ আসতে অনেক দেরি হয়। ময়নাতদন্তের জন্যও দেহ নিয়ে যেতে পুলিশ তার বাবার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। প্রথম থেকেই পুলিশের তদন্ত নয় বরং সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়ে আসছেন আনিস খানের বাবা। তার প্রধান অভিযোগ, তার ছেলেকে খুন করেছে পুলিশ। এছাড়াও আনিসের বাড়ির লোক তার হারিয়ে যাওয়া মোবাইল ফোন খুঁজে পেলেও পুলিশের হাতে সেটা দিতে চায়নি। আনিসের বাবার বক্তব্য ছিল, পুলিশ নাকি ওই মোবাইল ফোন খুঁজে পেলে সেখান থেকে সমস্ত ডেটা ডিলিট করে দেবে, তাই তারা মোবাইল ফোন শুধুমাত্র সিবিআইয়ের হাতে দেবে। এমনকি শুধু পুলিশের বিরুদ্ধে নয়, রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধেও তার অভিযোগ। সিট এর তরফ থেকে ঘটনার তদন্ত করা হলেও তিনি কোন ভাবে সাহায্য করতে রাজি নন। তিনি শুধুই সিবিআই তদন্তের দাবি রাখছেন। 

পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

আনিস রহস্যে ক্রমেই জড়াতে শুরু করেছে পুলিশ। আনিসের বাবার অভিযোগ থেকে উঠে আসছে ওই রাতে আনিসের বাড়িতে পুলিশই গিয়েছিল। তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে এই সমস্ত তথ্য উঠে আসায় ইতিমধ্যেই স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম আমতা থানার তিন পুলিশকর্মীকে গ্রেফতার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়াও দোষীদের চিহ্নিত করে যোগ্য শাস্তি দিতে হবে বলেও ভূমিকা ব্যক্ত করেছে সিট। প্রশ্ন উঠছে, ১৯ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ জানানোর পরে পুলিশ কি আদৌ আনিসের মিসিং মোবাইল খোজার চেষ্টা করেছিল? তাহলে পুলিশ হয়তো আগেই জানতে পারত মোবাইল আনিসের বাড়িতে আছে। ২১ তারিখ পর্যন্ত পরিবারের লোকজন না বলা পর্যন্ত পুলিশ জানতেই পারলো না কেন যে আনিসের ফোন বাড়িতে রয়েছে?

দ্বিতীয়ত, এখনো পুলিশের তরফ থেকে ওই হত্যাকারীদের কোনো স্কেচ তৈরি করা হয়নি। আনিসের বাবা যেখানে বারবার বলছেন যে তিনি ওই ব্যক্তিদের দেখলে চিনতে পারবেন, সেখানে তার থেকে তথ্য নিয়ে স্কেচ তৈরি করার কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করল না কেন পুলিশ? এছাড়াও আনিসের গ্রামে ঢোকার রাস্তায় সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। পুলিশ সেই ফুটেজ চেক করে নি কেন? এছাড়াও, গ্রামের একজন সিভিক ভলেন্টিয়ার নিজেই স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে জানিয়েছিলেন আনিস নাকি আত্মহত্যা করেছে, তিনি এরকম কথা বললেন কেন?

এই সমস্ত বিষয় উঠে আসার পরেই রাতভর তদন্ত করা হয় পুলিশকর্মীদের। এছাড়াও একজন কনস্টেবল, একজন এএসআই, এবং একজন হোমগার্ডকেও সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। কর্তব্যরত পুলিশ কর্মীদের মোবাইল লোকেশন ট্র্যাক করা হচ্ছে। তবে এখনো স্পষ্ট নয় যে তিন পুলিশকর্মীকে সাসপেন্ড করা হয়েছে, তারা ঘটনার দিন সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন কিনা।

আমতা থানার পুলিশকে সিটের দুই তদন্তকারী আধিকারিক সোমবার রাতভর জিজ্ঞাসাবাদ করে। ডিউটিতে কারা ছিলেন তাদের একটি তালিকা তৈরি করে জেরা করার পর এই তিনজনকে গ্রেফতার করার এবং তাদেরকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নেয় সিট। শুরু থেকেই আনিসের পরিবার অভিযোগ করে এসেছে, ওই রাতে পুলিশ এসেছিল। তাহলে জেলা পুলিশ আমতা থানার পুলিশ কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করল না কেন সেই নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তবে সিট তদন্ত শুরু করেই প্রথমে পুলিশ কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। ফলে পুলিশ যে এই ঘটনায় সরাসরি সন্দেহের তালিকায় রয়েছে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সম্প্রতি আবার গ্রেফতার হওয়া দুই পুলিশকর্মী দাবি করছেন, তাদের ইচ্ছে করেই ফাঁসানো হয়েছে। ওসির নির্দেশে আনিসের বাড়ি গিয়েছিলেন তারা। এই স্বীকারোক্তিতে রহস্য আরও ঘণীভূত হল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সোশ্যাল মিডিয়ায় আনিসের গতিবিধি

মৃত ছাত্রনেতা আনিস খান প্রথম থেকেই সোশ্যাল মিডিয়াতে অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন মুখ হিসাবে পরিচিত। সিএএ কিংবা এনআরসি বিতর্ক হোক অথবা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন, সব কিছুতেই মুখ খুলতে দেখা যেত এই ছাত্রনেতাকে। জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সিএএ এবং এনআরসি বিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন করে একাধিক পোস্ট তাকে দিতে দেখা গিয়েছিল। এছাড়াও কাশ্মীর ইস্যুতেও তার বক্তব্য ছিল বেশ জোরালো। এই বিষয়টা স্পষ্ট যে, ভারত সরকারের বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ ছিলই। সম্প্রতি কৃষক আন্দোলন এবং স্কুল খোলার দাবিতেও তাকে সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করতে দেখা যায়।

তার পুরনো কিছু পোস্ট নিয়ে এই মুহূর্তে বেশ বিতর্ক চললেও আনিস খান হত্যা মামলায় তার সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট বেশ বড় ভূমিকা গ্রহণ করে। তবে, তার সম্পূর্ণ সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলি খুঁজে দেখার পরেও তাঁর তৃণমূল মনস্ক হওয়ার তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। আনিস প্রথম থেকেই বাম মনস্ক। শুরুতে বাগনান করেছে থাকাকালীন সময়ে এসএফআইয়ের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। পরে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার সময় আইসা এবং এফআইএফবি এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। পরে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব করতে বেছে নিয়েছিলেন আইএসএফ-কে। স্থানীয় সূত্র মারফত, তৃণমূল কংগ্রেস যে এলাকায় বেশ সক্রিয় ছিল সেইখানে আইএসএফ এর সংগঠন বিস্তার করতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। এবং এই বিষয়টি তার ফেসবুক প্রোফাইলেও কিছুটা ফুটে ওঠে।

পকসো আইনে মামলা

আনিস খানের মৃত্যুর তদন্ত করতে নেমে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে পুলিশের হাতে। পুলিশের দাবি, আনিস খানের বিরুদ্ধে নাকি পকসো আইনে মামলা ছিল। শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন নিগ্রহের বিচারের জন্য তৈরি এই আইন। হাওড়া গ্রামীণ পুলিশ সুপার সৌম্য রায় সোমবার একটি সাংবাদিক সম্মেলনে দাবি করেছেন, বাগনান থানায় আনিসের বিরুদ্ধে মামলা ছিল। সেই মামলায় পকসো ধারার উল্লেখ রয়েছে। এই নিয়ে এর আগে সমন জারি করা হয়েছিল। এই অভিযোগ যদি সত্যি হয় তাহলে এই মামলার মোড় অনেকখানিই ঘুরে যাবে মুহূর্তেই।

বামেদের ভূমিকা 

মৃত ছাত্রনেতা আনিস খান প্রথম থেকেই এসএফআইয়ের একজন কর্মী ছিলেন। এছাড়াও তার মানসিকতা এবং তার রাজনৈতিক মতাদর্শ অনেকটাই বামপন্থীদের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ ছিল। তাই আনিস খানের এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে শহরের একাধিক জায়গায় প্রতিরোধ মিছিল গড়ে তোলে এসএফআই এবং বামফ্রন্টের কর্মীরা। পাক সার্কাস ৭ পয়েন্ট, আলিয়া ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, কলেজস্ট্রিট সহ একাধিক জায়গায় বাম ছাত্র সংগঠন এসএফআই রাস্তা অবরোধ এবং বিক্ষোভ দেখায়। "আমার রক্ত দিয়ে সংগ্রামী ব্যানার লেখা হোক / আনিস খান হত্যার শাস্তি চাই", স্লোগানে ভরে ওঠে কলকাতার রাজপথ। রাজ্য বামফ্রন্টের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফ থেকেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করা হয়। মমতা ব্যানার্জি প্রথম থেকেই সিবিআই তদন্তের বিরোধী, এই বিষয়টিকে নিয়ে তার ভূমিকা কে তীব্র কটাক্ষ করেছে সিপিআইএম।

এসএফআই নেত্রী দীপ্সিতা ধর বলছেন, পুলিশের ভূমিকা যখন এই ঘটনায় প্রশ্নের মুখে পড়েছে, তখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন সিবিআই তদন্তের বিরোধিতা করছেন? বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধেও পুলিশের আচরণকে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি দীপ্সিতা। এন্টালী থেকে শুরু করে পার্কসার্কাসের সম্পূর্ণ রাস্তায় নামে এসএফআই কর্মীদের ঢল। বাম ছাত্র নেতা সৃজন ভট্টাচার্য্য সরাসরি পুলিশের উপরে অভিযোগ করে বলছেন, পুলিশ তাদের বিক্ষোভ মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করছে। কলকাতার প্রাক্তন মেয়র তথা সিপিআইএম রাজ্যসভার সাংসদ বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য তার ফেসবুক প্রোফাইলে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি অভিযোগ তুলেছেন, আনিসের পরিবারকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। 

তবে এসএফআইয়ের বিক্ষোভ কর্মসূচি যে শুধুমাত্র কলকাতায় সীমিত রয়েছে তা কিন্তু নয়। দিল্লি জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেও এই নিয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি করেছে এসএফআই। বঙ্গভবনের সামনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিক্ষোভ করেছে এসএফআই কর্মীরা। এই বিক্ষোভের নেতৃত্বে ছিলেন বাম ছাত্রনেত্রী ঐশী ঘোষ। 

তৃণমূলের ভূমিকা

আনিস খান হত্যাকাণ্ডে সবথেকে বেশি বিতর্কের মুখে পড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার প্রতিটা বিষয় নিয়েই এই মুহূর্তে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। পুলিশকর্মীদের সাসপেন্ড করা থেকে আনিসকে তাদের ফেভারিট ঘোষণা করা, সবদিকেই বিতর্কের মুখে পড়েছেন মমতা। আনিসের পরিবারকে তিনি সুবিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। তবে আগের মতই এবারেও তিনি সিবিআই তদন্তের বিরোধী। যেখানে আনিসের বাবা নিজেই সিবিআই তদন্তের দাবি জানাচ্ছেন, সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্য সরকারের স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম এর উপরে ভরসা রাখার আশ্বাস দিয়েছেন তাকে। এই ঘটনা নিয়ে তৃণমূলের তরফ থেকে সরাসরি বক্তৃতা রাখার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ফিরহাদ হাকিমকে। অবশ্য সে কারণটা সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকও হতে পারে। ফিরহাদ হাকিম সেই এলাকার বিধায়ক কিংবা কোনো নেতা নন, অথবা সেই কাজের সঙ্গে তিনি জড়িত নন, তাহলে তাকেই কথা বলতে পাঠানো হলো সেই নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। উপরন্তু, আনিসের বাবা সালিম খানকে নবান্নে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করার আহ্বান জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, যা সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন আনিসের বাবা। এই নিয়েও মমতার মুখ পুড়েছে। পাশাপাশি, হাওড়া গ্রামীণের বর্তমান পুলিশ সুপার সৌম্য রায় সম্পর্কে তৃণমূল বিধায়ক লাভলি মৈত্রীর স্বামী। তাই তৃণমূলের সঙ্গে এই মামলার বেশ গভীর যোগাযোগ রয়েছে এবং সেটা অস্বীকার করারও কোনো উপায় নেই।

অন্যদিকে, রাজ্য সরকারের গঠন করা স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম এর সদস্যদের ট্র্যাক রেকর্ড নিয়েও বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। রাজ্য সরকারের এই স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিমের প্রধান মুখ হয়েছেন জ্ঞানবন্ত সিং। এই আইপিএস অফিসারের ট্র্যাক রেকর্ড খুব একটা ভালো নয়। বছর ১৫ আগে তিনজলার রিজওয়ান-উর রহমান হত্যাকাণ্ডে তার বিরুদ্ধে উঠেছিল প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ। যদিও সেই অভিযোগের কোনো সারবত্তা এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি, কিন্তু তবুও সেই হত্যাকাণ্ড তার ক্যারিয়ারকে কালিমালিপ্ত করেছিল একটা সময়ে। আনিস খান হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি নিজের ট্র্যাক রেকর্ড আবার ফিরিয়ে আনার সুযোগ পাবেন, কিন্তু প্রশ্ন উঠছে এরকম একটা হাইপ্রোফাইল মামলায় সিটের প্রধান দায়ভার তার মতো একজন বিতর্কিত পুলিশ অফিসারের উপরে বর্তানো কি ঠিক হলো?

বিজেপির ভূমিকা

এই পুরো ঘটনায় বিজেপি কার্যত কিছুটা ধীরগতিতে চলারই পরিকল্পনা নিয়েছে। এমনিতেই আনিস খানের রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং তার সোশ্যাল মিডিয়া গতিবিধি বিজেপির বিপরীতেই। নাগরিকত্ব বিল, কৃষক আইন, বেকারত্ব সমস্যা, করোনাকালে সরকারের ভূমিকা, সমস্ত আন্দোলনেই অন্যতম মুখ হিসাবে দেখা গিয়েছে আনিসকে। ছাত্র আন্দোলনেও আনিসের ভূমিকা বিজেপির বিপরীতে। তাই এই ঘটনায় বিজেপি বিরোধিতা করলেও তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে আন্দোলন গড়ে তোলাটাকে তারা খুব একটা সমীচীন বলে মনে করছেন না। তার সাথেই, কাশ্মীর ইস্যুতেও আনিসের মতাদর্শ বিজেপির খুব একটা ভালো লাগার কথা নয়। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এবং রাজ্য পুলিশের ভূমিকার বিরোধিতা করলেও বিজেপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের এই আন্দোলনে খুব একটা বড় ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে না। 

রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, দিলীপ ঘোষের মতো নেতারা আনিসের পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা দেখালেও, এবং সিবিআই তদন্তের দাবি রাখলেও যে সময় বিরোধী দল হিসেবে তাদের রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা ছিল, সেই সময় তারা কেবলমাত্র ঠাণ্ডা ঘরে বসে মিডিয়া কনফারেন্স করেই খালাস। এ বিষয়টিও রাজ্যের মানুষের নজর এড়ায়নি। 

অক্টোবর ১৩, ২০০৭, রিজওয়ানুর রহমানের মৃত্যুর সেই ঘটনার পরে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে রিজওয়ানুরের মা করুণ আর্তি রেখেছিলেন, যেন তিনি তার ছেলের হত্যার সঠিক ন্যায় বিচার পান। ১৫ বছর হতে চলল এখনো সেই মামলার শুনানি চলছেই। বামফ্রন্ট সরকারের কফিনে একটি পেরেকের মত গেঁথে গিয়েছিল সেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। ২০০৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর যখন রেল লাইনের ধার থেকে সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার রিজওয়ানুরের দেহ মেলে তখন বাংলার রাজনীতি কার্যত একেবারে উত্তাল হয়ে ওঠে। অভিযোগ ওঠে প্রভাবশালী এক ব্যবসায়ী পরিবারের বিরুদ্ধে। দাবি উঠেছিল সিবিআই তদন্তের। হয়েওছিল সেই তদন্ত। কিন্তু সেই তদন্ত রিপোর্টেও এই ঘটনাকে কার্যত আত্মহত্যা বলেই দাবি করা হয়েছিল। ১৫ বছর কেটে গিয়েছে। সেই প্রভাবশালী পরিবারের মেয়ে এখন বিয়ে করে বাইরে থাকে। আনিস খান মামলায় সিটের প্রধানের সূত্র ধরে ১৫ বছর আগের মামলার স্মৃতি আবারো উঠে আসে। সেখানে রিজওয়ানুরের মায়ের জায়গায় আজকে আনিসের বাবা। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তিনিও আর্জি রাখলেন সঠিক তদন্তের, ন্যায় বিচারের। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আর্জি রাখলেন সিবিআই তদন্তের। এরকম তদন্ত এর আগেও হয়েছিল। কিন্তু সেই তদন্তের রিপোর্টে জানানো হয়েছিল রিজওয়ানুর আত্মহত্যা করেছে। আনিসের মামলাতেও তৈরি হয়েছে তদন্ত কমিটি। তদন্ত করছে সিট। হয়ত দাবি আরো জোরালো হলে হবে সিবিআই তদন্ত। কিন্তু, সবশেষে প্রশ্নটা একটাই জায়গায়, ন্যায় বিচারটা মিলবে তো?

More Articles