দুর্নীতির অভিযোগে জর্জরিত, লালুপ্রসাদকে দেখে শিক্ষা নেবেন বাংলার নেতা-মন্ত্রীরা?

লালুপ্রসাদের মতো শক্তিশালী নেতার পরিণতি দেখেও কিন্তু হাল আমলের কোনও রাজনীতিকই কিছু শিখছেন না।

লালুপ্রসাদের পরিণতি দেখেও দেশের কোনও রাজনীতিকই কিছু শিখতে রাজি নন।

 

লালুপ্রসাদ যাদব রেলমন্ত্রী ছিলেন ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত৷ আজ থেকে প্রায় ১৩ বছর আগে রেলমন্ত্রিত্ব ছেড়েছেন। ভেবেছিলেন, রেলমন্ত্রী থাকাকালীন যা খুশি করি না কেন, মন্ত্রী না থাকলে আমাকে আর কেউ ধরতে পারবে না, ফাঁসাতেও পারবে না।

 

লেকিন কমলি তো নেহি ছোড়তা!

 

রেলে চাকরি-সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে দেশের প্রাক্তন রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদবের বিরুদ্ধে সিবিআই নতুনভাবে এফআইআর দায়ের করেছে। একইসঙ্গে প্রাক্তন রেলমন্ত্রী তথা আরজেডি সুপ্রিমোর স্ত্রী রাবড়ি দেবী এবং তাঁর মেয়ে মিসা ভারতীও অভিযুক্ত। সিবিআই সূত্রে খবর, বিহারের পাটনা এবং গোপালগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি হয়েছে শুক্রবার ভোররাত থেকে। তল্লাশি হয়েছে পাটনার ১০ সার্কুলার রোডে বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রাবড়ি দেবীর বাসভবনে। লালুর গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের ফুলওয়ারিয়াতেও হয়েছে সিবিআইয়ের তল্লাশি। মোট ১৭টি জায়গায় তল্লাশি চালায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। জানা গিয়েছে, ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত, যখন লালু রেলমন্ত্রী ছিলেন, সেই সময়ে রেলের চাকরির দুর্নীতি-সংক্রান্ত একাধিক মামলার তদন্তে নেমেছে সিবিআই‌। সেইসব মামলার তদন্তেই অভিযান চালানো হয়। সিবিআইয়ের এফআইআরে বলা হয়েছে, রেলমন্ত্রী থাকার সময় চাকরির বিনিময়ে জমি, টাকা ইত্যাদি নিয়েছিলেন লালু। সেই তদন্তই নতুন অভিযোগের ভিত্তিতে শুরু করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা।

 

আরও পড়ুন: দূরত্ব রাখছেন মমতাও? মুকুলের মতো বিস্মৃত হয়ে যাবেন পার্থ?

 

প্রসঙ্গত, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন লালুপ্রসাদ ঘটিয়েছিলেন পশুখাদ্য কেলেঙ্কারি। এই কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে সিবিআই পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতির হদিশ পায়। সব অভিযোগের বিচার শুরু হয়। এ-পর্যন্ত পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির সব মামলাতেই দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও আরজেডি প্রধান লালুপ্রসাদ যাদব। দীর্ঘ কারাবাস, মোটা জরিমানা- সব শাস্তিই ভোগ করেছেন লালু। সর্বশেষ ঘোষিত পঞ্চম মামলার রায়ে রাঁচির সিবিআইয়ের বিশেষ আদালত লালুপ্রসাদ যাদবকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও ৬০ লাখ টাকা জরিমানার সাজা দিয়েছে। পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির আরও কয়েকটি মামলা বিচারাধীন। সব পক্ষের আশঙ্কা, সেইসব মামলাতেও দোষী সাব্যস্ত হবেন লালু। ফের শুনতে হবে কারাবাস তথা জরিমানার সাজা‌‌। আর তার মধ্যেই রেলে চাকরি-সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ উঠে এসেছে দেশের প্রাক্তন রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদবের বিরুদ্ধে‌। আইনি মহলের অভিমত, এই মামলাতেও ফাঁসবেন লালু‌। অভিযোগসমূহ এতটাই তথ্যপ্রমাণসমৃদ্ধ যে, লালুর বাঁচা মুশকিল।

 

ওদিকে লালুর বাড়িতে সিবিআইয়ের অভিযানের কথা প্রকাশ্যে আসতেই পাটনায় রাবড়ির বাসভবনের বাইরে জড়ো হন আরজেডি সমর্থকরা। বিজেপি এবং কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার বিরুদ্ধে যথারীতি স্লোগান দেন তাঁরা। তোলা হয় প্রতিহিংসার রাজনীতির অভিযোগ। এই 'প্রতিহিংসার রাজনীতি'-র স্লোগান বহু ব্যবহারে এখন এতটাই ক্লিশে হয়ে পড়েছে যে, এই আওয়াজের কোনও ধার-ভার এখন আর নেই। বেশিরভাগ সময়ই দেখা গিয়েছে, কোনও ক্ষেত্রেই অন্যায়ভাবে মনগড়া অভিযোগের ভিত্তিতে কোনও রাজনীতিকের বিরুদ্ধেই সক্রিয় হয়নি কোনও তদন্তকারী সংস্থা। ফলে এদিনের আরজেডি-র স্লোগানও স্রেফ রুটিনমাফিক বলেই ধারণা রাজনৈতিক মহলের।

 

রেলমন্ত্রী বা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী পদে যখন লালুপ্রসাদ আসীন ছিলেন, সেই সময়ে তাঁর সমর্থক বা বিরোধীরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি বিহারের 'মসিহা' এবং তাঁর পরিবারের শেষ জীবনটা এতখানি করুণ হবে৷ এই পরিণতির জন্য অন্য কেউই দায়ী নন। ক্ষমতায় থাকার দিনগুলোতে সচেতনভাবেই লালু দুর্নীতির সঙ্গে ঘর করেছিলেন। এক বা দেড় দশক লেগেছে বটে, কিন্তু রেহাই পাননি তিনি। আরজেডি বা এই দলের জোটসঙ্গীরা সেদিন বা আজ যতই চিৎকার করুক যে, বিশেষ কোনও পক্ষের নির্দেশেই লালুর বিরুদ্ধে 'প্রতিহিংসামূলক' আচরণ করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা, বাস্তবে দেখা গিয়েছে সব অভিযোগ সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। আদালতে লালুপ্রসাদের আইনজীবীরা কোনও অভিযোগই মিথ্যা, অসার প্রমান করতে পারেনি। অথচ দেশের মানুষ দেখেছে, লালুর বিরুদ্ধে এই ধরনের গুরুতর সব অভিযোগ ওঠামাত্রই রে রে করে উঠেছিল একাধিক রাজনৈতিক দল। অনেকে বিশ্বাসই করতে চায়নি, বিহারের 'মসিহা' এই স্তরের দুর্নীতিবাজ হতে পারেন। ঠিক যেমন এখন যাঁদের নামে নানা ধরনের স্ক্যামের অভিযোগ উঠছে, সেইসব নাম দেখে তাঁদের অনুগামীরা বিশ্বাস করতেই রাজি নন, তাঁরা যাদের 'মহানায়ক' বা 'মহাসূর্য' ভাবেন, তাঁরা এতবড় চোর হতে পারেন। তাঁরা ভাবেন, এসবই ষড়যন্ত্র। অথচ এই পর্যন্ত যতখানি তথ্যপ্রমাণ তদন্তকারীদের হাতে গিয়েছে, তাতে প্রমাণিত হয়েছে, প্রতিটি অভিযোগই প্রাথমিকভাবে সঠিক। তদন্ত চলছে, হয়তো আগামী দিনে আরও জোরদারভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে অভিযোগের সত্যতা, যেমন হয়েছে লালুপ্রসাদের ক্ষেত্রে।

 

দুনিয়ায় এমন অপরাধী ক'জন আছে, যে অভিযোগ ওঠামাত্রই স্বীকার করে নেবেন নিজের অপরাধ? লালুপ্রসাদও করেননি। সমানে আইনি লড়াই, রাজনৈতিক লড়াই, চক্রান্তের অভিযোগ তুলেই গিয়েছেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি‌। জেল-জরিমানা, সবই তাঁর হয়েছে, হয়তো আগামী দিনে আরও শাস্তি অপেক্ষা করছে এক সময়ে গোটা দেশের মুখ হয়ে ওঠা লালুপ্রসাদ যাদবের জন্য।

 

লালুপ্রসাদের মতো শক্তিশালী নেতার পরিণতি দেখেও কিন্তু হাল আমলের কোনও রাজনীতিকই কিছু শিখছেন না। এখন লালুর সুরেই প্রতিবাদ করছেন, ষড়যন্ত্রের কথা বলছেন। কিছুদিন পর বলার আর কিছুই থাকবে না। অপেক্ষা করতে হবে আদালতের রায়ের। এই মুহূর্তে অভিযোগের পাহাড়ে ডুবে থাকা রাজ্যের দুই মন্ত্রী, পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং পরেশ অধিকারী বারবার আদালতের দরজায় কড়া নাড়লেও, তাঁদের বিরুদ্ধে থাকা তথ্যপ্রমাণ খতিয়ে দেখে বিচারপতিরা এই মন্ত্রীর পাশে দাঁড়াচ্ছেন কোথায়? আইন তো আদালতকে যা খুশি করার অনুমতি দেয়নি, তথ্য বা প্রমাণ পার্থ-পরেশের পক্ষে নেই বলেই বারবার খালি হাতেই ফিরছেন তাঁরা আইনি আঙিনা থেকে। আইন অনুমতি দিয়েছে বলেই হাই কোর্ট মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার নির্দেশ দিতে পেরেছে। নির্দেশ দিতে পেরেছে অঙ্কিতাকে এযাবৎ দেওয়া প্রায় ৪১ মাসের বেতন ফেরত দিতে হবে। দু’টি কিস্তিতে ওই টাকা ফেরাতে হবে অঙ্কিতাকে। আইন অনুমোদন দিয়েছে বলেই হাই কোর্ট খারিজ করেছে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের রক্ষাকবচের আবেদন। এর ফলে সিবিআই চাইলে পার্থকে হেফাজতে নিয়েও জেরা করতে পারবে।

 

ক্ষমতায় থাকলে অনেকেই ওই অস্থায়ী ক্ষমতার দম্ভে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন। লালুপ্রসাদ যাদব ক্ষমতায় থাকার সময়কালে এভাবেই হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়েছিলেন। তার মাশুল লালুকে দিতে হচ্ছে এক-দেড় দশক পর। ঘটনাপ্রবাহ বলছে, দেশ বা রাজ্যের আগামী রাজনৈতিক ইতিহাসে হয়তো সংযুক্ত হবেন লালু- পরবর্তীকালের অনেক অবিশ্বাস্য নাম, যাদের সঙ্গে ছায়ার মতো ঘুরছে 'দুর্নীতি' শব্দটি।

 

রাজনীতিকরা না কি সবসময়ই ঝুঁকি নিতে ভালবাসেন। লালুপ্রসাদও নিয়েছিলেন।

 

শেষরক্ষা হলো কোথায়?

 

More Articles