হাওড়ার টালিছাওয়া ঘর থেকে সোনা জেতা: অচিন্ত্য শিউলি মনে করাচ্ছেন গোবর গুহ, ভীম ভবানীদের

২০২২ সালের কমনওয়েলথ গেমস্-এ ইতিহাস গড়েছেন বাংলার ছেলে অচিন্ত্য। ভারোত্তোলনে ৭৩ কেজি বিভাগে সোনা এনেছেন। স্ন্যাচ ও ক্লিন অ্যান্ড জার্ক মিলিয়ে ৩১৩ কিলো ওজন তুলে রেকর্ড গড়েছেন তিনি।

তিনি যে পাহাড়প্রমাণ বাধা জয় করে বিজয়ী খেতাব অর্জন করেছেন, তা সোনা দিয়ে মাপা যায় না বইকি! তবু সোনায় ভারতের চোখ ফিরেছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে নানা নামীদামি ব্যক্তি ট্যুইট করে সম্মান জানাচ্ছেন। সত্যি বলতে কী, সম্মান তিনি ছিনিয়ে নিয়েছেন একরকম।

অচিন্ত্য শিউলি। এই হাওড়ার দেউলপুরের ছেলে। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে যে টালিছাওয়া ভাঙা ক্লান্ত ঘরগুলি চোখে পড়ে, তারই একটায় বাসা ছিল তাঁর। সেই টালিছাওয়া ঘরে থেকেই ২০২২ সালের কমনওয়েলথ গেমস-এ ইতিহাস গড়েছেন বাংলার ছেলে অচিন্ত্য। ভারোত্তোলনে ৭৩ কেজি বিভাগে সোনা এনেছেন। স্ন্যাচ ও ক্লিন অ্যান্ড জার্ক মিলিয়ে ৩১৩ কিলো ওজন তুলে রেকর্ড গড়েছেন তিনি।

অকর্মণ্য বলে বাঙালির পরিচয় আজকের নয়। ব্রিটিশ শাসন এদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বাঙালি জানতে পারল, তারা কাজে নাকি খুব একটা চৌখস না। মানে এমনটাই তাদের জানিয়ে দেওয়া হতো পদে পদে। ইংরেজদের 'পুরুষালি' ভাবমূর্তির পাশে বাঙালিকে 'না-পুরুষ' হিসেবে দাঁড় করানো ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের অন্যতম অবদান। মাথা পেতে মধ্যবিত্ত মেনে নিয়েছিল এই নিদান। কিন্তু সাধারণ মানুষ? মধ্যবিত্তর মধ্যেও বেশ কিছু ব্যতিক্রম ছিল। সাহেবপ্রেমী বাঙালি যৌথস্মৃতি থেকে তাঁদের ছেঁটে ফেলেছে দীর্ঘদিন। গোবর গুহ, বিষ্টু ঘোষ বা ভীম ভবানীর মতো চরিত্ররা কলকাতা দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। মনোহর আইচ থেকে গুণময় বাগচি, বাঙালি শরীরের কাছে পাত্তা পায়নি বিশ্ব। সেসব ইতিহাস কৌশলে চেপে দেওয়া হয়। তাতে উপনিবেশকে চলতি কিছু ধারণায় বেঁধে ফেলা সহজ হয় আর কী! ইতিহাসের সমস্ত ক্ষেত্রেই ঔপনিবেশিক শাসক নিজেকে দেখত পুরুষ হিসেবে, এবং উপনিবেশকে নারী হিসেবে। পিতৃতান্ত্রিক এই ভাবনার গলদ গোড়াতেই। কিন্তু মুশকিল হলো, দীর্ঘদিন ধরে মধ্যবিত্ত বাঙালি নিজেও তাই বিশ্বাস করে আসছে। একদিক থেকে এই স্টিরিওটাইপের মুখে জোর থাপ্পড় অচিন্ত্যরা।

আরও পড়ুন: জঙ্গলে কাঠ কাটা থেকে শুরু, ভারতকে সোনা জেতানো মীরাবাঈ চানুর যাত্রা কেমন ছিল

বাস্তব থেকে কিংবদন্তি হয়ে ওঠার পথটা কিন্তু খুব মসৃণ ছিল না। দাদা অলোকের হাত ধরেই ভারোত্তোলনের পথে আসা অচিন্ত্যর। তখন তাঁর বছরদশেক বয়েস। বছরখানেকের মাথায় হৃদরোগে মারা যান বাবা। তিনি ভ্যান চালাতেন। ২০১৩ সালে মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স মাত্র আটত্রিশ। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে পরিবারের। কীভাবে চালাবেন? জোগাড়যন্ত্র নেই, রোজগার নেই, সংসার চালানোই দায়। বাবাকে দাহ করার ক্ষমতা নেই। এর কাছ থেকে টাকাটা ওর কাছ থেকে পয়সাটা ধার করে কোনওরকমে দাহকার্য সম্পন্ন হলো। সেদিনগুলোর কথা ভোলেননি দুই ভাই।

তবে ছোট্ট অচিন্ত্যর মাথার ওপর জোড়া বটগাছ দাদা আর কোচ। অনেকটা শচীনের মতোই। শচীনের যেমন দাদা অজিত এবং গুরু রমাকান্ত আচরেকর ছিল, অচিন্ত্যর ছিলেন দাদা অলোক এবং কোচ অষ্টম দাস। অর্থনেতিক কোনও নিরাপত্তা নেই। রোজ খাবার জোটাই কপাল, তার আবার ভারোত্তোলনের ভারী ভারী খাদ্যতালিকা। এক ফুঁয়ে সেসব সরিয়ে রাখতে হতো। শরীরের আগে মনটা পাকিয়ে তুলতে হয়েছে দুই ভাইকে। দিনের শেষে এক প্লেট ঘুগনি আর ডিমসিদ্ধ পাওয়ার জন্য ধান বইতেন অচিন্ত্য। ভারোত্তোলন কিন্তু ছাড়েননি। দাঁতে দাঁত চেপে একা লড়াইটা চালিয়ে গিয়েছেন। প্রশাসনিক স্তরে কি রাজ্য কি কেন্দ্র— কোনও সাহায্য পাননি। অথচ একেই ভাগ্য বলে মেনে নিতে নারাজ দুই ভাই। অন্যের গাফিলতির দায় নিজে নেবেন কেন? নিজের সেরাটা দিয়ে ওই পরিস্থিতিতেও গড়ে নিচ্ছিলেন নিজেকে। সোনা পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য রাজনীতিকরা ট্যুইটে ভরিয়ে দিচ্ছেন আন্তর্জাল। হায় রে পোড়া পেট! সেও যদি ট্যুইটেই ভরে উঠত।

ভারতে প্রতিদিন শরীরচর্চা করেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। কিন্তু দুঃখের বিষয় ভারোত্তোলন বা শরীরচর্চা-জাতীয় স্পোর্টসের তেমন সরকারি পরিকাঠামো নেই। নেই সাধারণের জন্য মুশকিল আসানের উপায়। বহু খেলোয়াড় রাজ্য স্তরে, জাতীয় স্তরে পুরস্কার পেয়েও থাকেন ব্রাত্য। হতাশ হয়ে পড়েন। জীবনে রোজগার জোটে না তেমন। বড় বড় জিম বাদ দিলে, সাধারণ জিমে ট্রেনারের কাজ করে দিন শেষে ক'টা টাকাই বা জোটে? সরকারি চাকরির প্রতিশ্রুতি, প্রতিশ্রুতির প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি ভাঁওতা সহ্য করতে করতেই জীবন পার হয়ে যায়। এক ধরনের অবহেলা এই খেলোয়াড়দের জীবন ঘিরে জমতে থাকে বলয়ের মতো।

অচিন্ত্যর দিনবদলের শুরু সেনাবাহিনীর শিবিরে সুযোগ পেয়ে। চালচুলোহীন অতি সাধারণ কোচ অষ্টম দাস যখন ছেলেটিকে প্রথম দেখেন, তখন সে নিতান্তই শিশু। তবে ছেলেটির অদম্য ইচ্ছা দেখে তিনি খানিকটা আন্দাজ করেছিলেন যে, এই ছেলে একদিন বড় কিছু একটা করবেই। হাজার হোক, কম ছেলে তো বেরলো না তাঁর হাত দিয়ে। অষ্টম পারিশ্রমিক নেন না। ভালবাসেন, তাই বিনা পয়সায় ভারোত্তোলন শেখান। অচিন্ত্য ঠিকঠাক খেতে পেত না, জানতেন তিনি। অবাক হতেন দেখে ছেলেটা তারপরেও কখনও হাল ছাড়েনি। মা, দাদা, অচিন্ত্য তিনজনে জরির কাজ করে সংসার চালাতেন তখন। রোজগারের টাকায় ডিম জুটত। রোজ তাতেই আড়াই-তিন ঘণ্টা প্র্যাকটিস। ইয়ুথ ন্যাশনালে ৫০ কেজি বিভাগে ব্রোঞ্জ জিতলেন ইচ্ছাশক্তির জোরে। এরপর অচিন্ত্য-সহ ছ'জন ছাত্রকে নিয়ে পুনে গেলেন অষ্টম। যদি ছেলেগুলোর একটা ব্যবস্থা করা যায়। সেনাবাহিনীর ট্রায়াল চলছিল। সেখানে নির্বাচিত হলেন অচিন্ত্য। তখন ২০১৪-'১৫-র সিজন। সেই সুযোগের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন অচিন্ত্য।

বার্মিংহামে সোনা জয়ের পর উৎসবের আবহ অচিন্ত্যর গ্রাম দেউলপুরে। সাফল্যের দিনটিতে বারবার সেই অভাবের দিনগুলি মনে যাচ্ছে দাদার। কোচের চোখে জল। নিজের বাড়িতেই ভারোত্তোলনের কোচিং দেন অষ্টম। না আছে চাকরি, না আছে আর্থিক সংগতি। ছেলেমেয়েগুলোর মুখ চেয়ে কিছু নিতে পারেন না। সরকার পরিকাঠামো দেয়নি। অথচ কত ছেলে তার কাছে শিখে জাতীয় পুরস্কার পেল! কখনও চাষ করেন। কখনও কারখানায় খেপ খাটেন। রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে হিসেবেও কাজ করেছেন লকডাউনের সময়। মাটি কাটেন এই শিক্ষক। রাষ্ট্র অন্ধ। গাছের ছায়ায় প্র্যাকটিস করান। বৃষ্টি হলে প্র্যাকটিস বন্ধ। পুরনো হয়েছে লোহা, ওজন, সরঞ্জাম। অচিন্ত্যর ছিনিয়ে আনা সোনা কি আলো ফেলবে গোবর গুহ, ভীম ভবানী, বিষ্টু ঘোষেদের এই উত্তরসূরির বুকের নিভৃতে? ছাত্রের জয়ে স্বপ্নের ঘোর লাগে শিক্ষকের। যদি বাবুদের মতি ফেরে!

 

 

More Articles