ঠিক কী ঘটেছিল ২১ জুলাই? ফিরে দেখা শহিদ দিবসের নেপথ্যে থাকা রক্তাক্ত ইতিহাস

মমতা জানান, জয়ের উদযাপন তাঁরা ২১ জুলাই করবেন, শহিদ তর্পণের দিন। প্রতি বছরই শহিদ তর্পণ হয়ে এসেছে। তবে মাঝে করোনাকালে বছরদুয়েক ধর্মতলায় সমাবেশ হয়নি।

২১ জুলাই দিনটি তৃণমূল পালন করে আসছে দীর্ঘদিন। শহিদ দিবস হিসেবে প্রদেশ কংগ্রেসও এই দিনটি পালন করে থাকে। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আমাদের একটু অতীতের দিকে চোখ ফেরাতে হবে।

১৯৯৩ সাল। দেশ মহিলা প্রধানমন্ত্রী দেখেছে বটে, কিন্তু বাংলার রাজনীতিতে পুরুষ নেতাদেরই আধিক্য বেশি। অভিযোগ, জ্যোতি বসুর বাংলায় বিরোধীদের ওপর গুলি চলছে যখনতখন। সেই প্রসঙ্গে জ্যোতি বসু ‘নিরামিষ আন্দোলন আমিষ করা হলো’-জাতীয় মন্তব্য করে বিতর্ক আরও বাড়িয়েছেন। সেই পুরুষপ্রধান রাজনীতির পাশাপাশি এক বিরোধী নেত্রীর কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছিল। তখনও ক্ষমতায় আসেননি মমতা। তৃণমূলের গঠনই হয়নি। কিন্তু লড়াই চলছে। একা নন তিনি, সঙ্গে আরও কয়েকজন সতীর্থ। যাঁদের মধ্যে কয়েকজনের রক্তে রাঙা হয়েছিল মহাকরণের রাস্তা। সেই দিনটিই ২১ জুলাই। গত বছর থেকে সর্বভারতীয় স্তরে শহিদ দিবস হিসেবে যে দিনটি পালন করতে শুরু করেছে তৃণমূল, সেই দিনটি আন্দোলনের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।

সেসময় যুব কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন মমতা। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করে তুলেছিল বটে, কিন্তু দামাল লড়াকু নেত্রী হিসেবে বাংলা তাঁকে চিনেছিল সেই ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে ধীরে ধীরে বামফ্রন্ট সরকারের নানান রকমের চেহারা সামনে আসতে শুরু করেছে তখন। ঘটে চলেছে একের পর অত্যাচারের এক ঘটনা। ছাপ্পা ভোট পড়ছে প্রায় সমস্ত বুথেই। এর প্রত্যক্ষদর্শী, সাক্ষী কম নেই। যে যখন ক্ষমতায়, সেইই ছাপ্পা ভোট ব্যবহার করে। ক্ষমতার আসন টলে গেলে সেই ছাপ্পাই বিষের মতো বোধ হয়। ক্ষমতায় এসে তৃণমূল ছাপ্পা দেওয়াচ্ছে বলে অভিযোগ। সেসময় বামফ্রন্ট ছাপ্পা ভোট দেওয়াত বলে অভিযোগ ছিল। রাজ্যে তখন বিরোধীর ভূমিকায় কংগ্রেস। তারা এই ছাপ্পাকে ইস্যু করে কারচুপির অভিযোগ আনল সিপিএমের বিরুদ্ধে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করার দাবি উঠল। দাবি উঠল ভোটার আইডিতে ছবিও দিতে হবে। এই দাবিতে ১৪ জুলাই মহাকরণ অভিযানের ডাক দিলেন তৎকালীন যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সে-বছর ঠিক ওই সময়েই প্রাক্তন রাজ্যপাল নুরুল হাসান মারা গেলেন। তখন বাধ্য হয়ে কর্মসূচি পিছিয়ে দিতে হল। ঠিক হলো, ২১ জুলাই হবে সেই অভিযান।

আরও পড়ুন: জৈন হাওয়ালাকাণ্ডে মুক্ত নন ধনকড়, অভিযোগ খুঁচিয়ে তুলেছিলেন মমতাই…

ওই দিন সকাল ১০টা থেকে মহাকরণের দিকে যাওয়ার জন্য জমায়েত শুরু হয়। তার কিছু পরে রেড রোড ধরে নির্বিঘ্নেই মহাকরণে চলে যায় জ্যোতি বসুর কনভয়। মহাকরণ ঘিরে পাঁচটি এলাকা দিয়ে এগোতে শুরু করেন যুব কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকরা। দামাল নেত্রীর এক ডাকে এগিয়ে এসেছিলেন কয়েক হাজার যুব কংগ্রেস কর্মী। তাঁদের সঙ্গে রাস্তায় নামেন মমতা নিজেও। অনেকগুলি মিছিল এগিয়ে আসছিল। কোনওটিতে ছিলেন সৌগত রায়, কোনওটিতে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়; জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, মদন মিত্র, পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায়রাও ছড়িয়েছিটিয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। কিন্তু মহাকরণে পৌঁছনোর আগেই পাঁচ দিক থেকে ব্যারিকেড গড়ে তাদের আটকে দেয় পুলিশ। এতক্ষণ শান্তিপূর্ণভাবেই মিছিল এগোচ্ছিল। আটকে দেওয়ায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন যুব কর্মী-সমর্থকরা। ধুন্ধুমার শুরু হয়। বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বেঁধে যায় তাদের। পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাথর ছোড়া হতে থাকে। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়তে থাকে পুলিশ।

পরিস্থিতি দ্রুত হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। ব্রেবোর্ন রোডে ধাক্কধাক্কি হয়, কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন মমতা। তাঁর নিরাপত্তারক্ষী সার্ভিস রিভলভার উঁচিয়ে পুলিশের মোকাবিলায় এগিয়ে যান। মেয়ো রোড-রেড রোডের মোড়ে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। বোমা পড়তে শুরু করে। লাঠিচার্জের উত্তরে রেড রোডে একটি পুলিশ ভ্যানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। উত্তেজনার আগুন মধ্য কলকাতার সর্বত্র তখন। একটি লরিকে ঢাল করে তার আড়ালে এগোতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা। তাদের তাড়া খেয়ে পুলিশের পদস্থ অফিসাররা যেমন পারেন পালাতে শুরু করেন। পুলিশও আরও মারমুখী হয়ে ওঠে। হঠাৎ করেই গুলিবর্ষণ শুরু হয় বিক্ষোভকারীদের উপর। বিশেষত লরিটিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে থাকে পুলিশ। এতে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে বিক্ষোভকারীরা। পরিস্থিতি খানিকটা নিয়ন্ত্রণে আসে। তখন দেখা যায়, গুলিতে মারা গিয়েছেন ১৩ জন। বন্দনা দাস, মুরারী চক্রবর্তী, রতন মণ্ডল, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ রায়, অসীম দাস, কেশব বৈরাগী, শ্রীকান্ত শর্মা, দিলীপ দাস, রণজিৎ দাস, প্রদীপ দাস, মহম্মদ খালেক, ইনু— এই তেরো জনের মৃত্যু নিয়ে রাজ্যে তোলপাড় শুরু হয়। গুলি চালানোর নির্দেশ কে দিয়েছিল, তার জবাব পাওয়া যায়নি আজও। সেসময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কিন্তু ঠিক নন্দীগ্রামের মতোই এই ঘটনাতেও ক্লিনচিট দেয় তাঁকে সিবিআই। আর এই গুলিকাণ্ডের আরেক 'খলনায়ক', তৎকালীন আমলা মণীশ গুপ্ত তৃণমূলের হয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে ২০১১-তে পরাজিত করেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে, ইতিহাসের এমনই ফের। কিন্তু মানুষ দিনটিকে ভোলেনি। ভোলেনি, তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর উক্তি, ‘‘ওরা মহাকরণ দখল করতে আসছিল। পুলিশ গুলি চালিয়েছে।’’

কলকাতার বুকে এই নৃশংস ঘটনা দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়ায় ভীষণ ঝড় তুলেছিল। এর বছরপাঁচেকের মাথায় কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন মমতা। বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অন্যতম প্রধান মুখ তখন তিনি। তৈরি হয় তৃণমূল। তখন থেকেই ২১ জুলাই দিনটি পালন করে তৃণমূল। এমনকী, ২০১১ সালের ১৩ মে বাম আমলের একচেটিয়া প্রতিপত্তি শেষ করে নির্বাচন জিতল বিরোধী জোট, সেইদিনও কিন্তু কোনওরকম বিজয় উৎসব হয়নি তৃণমূলের। মমতা জানান, জয়ের উদযাপন তাঁরা ২১ জুলাই করবেন, শহিদ তর্পণের দিন। প্রতি বছরই শহিদ তর্পণ হয়ে এসেছে। তবে মাঝে করোনাকালে বছরদুয়েক ধর্মতলায় সমাবেশ হয়নি। এ-বছর আবার ধর্মতলায় বিশাল সমাবেশের আয়োজন করছে তৃণমূল।

 

 

More Articles