সন্ত্রাসে উসকানির অভিযোগে নিষিদ্ধ! কোন লক্ষ্যে চলত পিএফআই? নেপথ্যে কারা

PFI Ban: পিএফআই কারা, এদের ইতিহাসই বা কী? কেন নিষিদ্ধ এই সংগঠন?

শুধু ২০১২ সালেই ভারতে সন্ত্রাসী হামলায় ২৩১ জন নাগরিকের মৃত্যু হয়েছিল। এখনও মুম্বই হামলার স্মৃতি দগদগে। পাকিস্তানের মদতে জঙ্গি গোষ্ঠী ভারতের শান্তি বিঘ্নিত করছে বলে অভিযোগ উঠেছে বারবার। ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটা এখনও ভারতের ইতিহাসে হয়ে আছে কালো দিন। এইদিন কাশ্মীরের পুলওয়ামা কেঁপে উঠেছিল ভয়াবহ এক সন্ত্রাসবাদী হামলায়।

কিছুটা থিতিয়েছে সেই রক্তপাতের ইতিহাস। এই অবস্থায় সন্ত্রাস দমনে বড় পদক্ষেপ কেন্দ্রের। দেশজুড়ে এনআইএ অভিযানের পর মৌলবাদী সংগঠন ‘পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া’-কে (PFI) নিষিদ্ধ করল কেন্দ্রীয় সরকার। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে পিএফআই-এর পাশাপাশি আরও আটটি সংগঠনের ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। সংবাদ সংস্থা-সূত্রে খবর, ২৮ সেপ্টেম্বর ইউএপিএ আইনের অধীনে আগামী পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে পিএফআই (PFI) সংগঠনকে। শুধু পিএফআই-ই নয়, এর সঙ্গে যুক্ত একাধিক সংগঠন, যেমন সিএফআই, অল ইন্ডিয়া ইমাম কাউন্সিল, রিহ্যাব ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন, ন্যাশনাল উইমেন্স ফ্রন্টকেও বেআইনি কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত সংগঠন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সমস্ত সংগঠনকেই নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে কেন্দ্রের তরফে। বেআইনি কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসবাদে মদত দেওয়ার জন্যই এই সংগঠনগুলিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।

গত সপ্তাহে কর্নাটক-সহ দেশের অন্তত ১০টি রাজ্যে অভিযান চালায় জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনএআইএ ও এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। জঙ্গিদের অর্থ জোগানো-সহ একাধিক অভিযোগে মুসলিম মৌলবাদী সংগঠন ‘পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া’-র (পিএফএআই) ১০০ জন সদস্যকে গ্রেফতার করেন তদন্তকারীরা। সন্ত্রাসদমনে শুরু হওয়া অভিযান এখনও থামেনি বলেই খবর। বেশ কয়েকটি রাজ্যে পিএফআই-এর ঘাঁটিগুলিতে আরও তল্লাশি হবে বলে সূত্রের খবর।

আরও পড়ুন: কর্নাটক থেকে ইরান, হিজাব বিতর্কই মেলালো দুই দেশের মুসলিম নারীদের?

২০২০ সালে বেঙ্গালুরুর সাম্প্রদায়িক হিংসার নেপথ্যে পিএফআই-এর হাত রয়েছে বলে অভিযোগ। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রতিবাদে উত্তরপ্রদেশে হিংসায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। ২০২১ সালে অসমে একটি উচ্ছেদ অভিযানে পুলিশের বিরুদ্ধে দখলদারদের উসকে হামলা করানোয় হাত রয়েছে পিএফআই-এর বলে অভিযোগ।

পিএফআইকে কেন নিষিদ্ধ ঘোষণা করল কেন্দ্রীয় সরকার? যুক্তি হিসেবে কেন্দ্র বলেছে, বেআইনি কার্যকলাপের জন্য আগামী ৫ বছরের জন্য তাদের নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর ও ২৭ সেপ্টেম্বর দেশজুড়ে পিএফআইয়ের বিরুদ্ধে তল্লাশি অভিযান চালায় এনআইএ-ইডি। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা দেশে হিংসা ছড়াচ্ছে ও দেশবিরোধী কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

পিএফআইয়ের বাড়বাড়ন্তর জন্য কংগ্রেসকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বিজেপি গত কয়েক বছর ধরেই তোপ দেগে চলেছে। গেরুয়া শিবিরের অভিযোগ, পিএফআই-এর প্রতি কংগ্রেসের নরম মনোভাবেই এদের এত রমরমা। দেখা যাক পিএফআই কারা, এদের ইতিহাসই বা কী!

পিএফআই কারা, কী তাদের ভূমিকা
দক্ষিণ ভারতে জন্ম। ২০০১ সালে স্টুডেন্ট ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ ইন্ডিয়া বা সিমি-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর থেকেই জঙ্গি সংগঠনগুলি বিদেশি অর্থসাহায্যে এদেশে ছদ্মনামে সংগঠন তৈরি করার চাল চালতে থাকে। এর প্রায় ৬ বছর পর ২০০৭ সালে তিনটি মুসলিম সংগঠনকে এক ছাতার তলায় এনে গড়ে তোলা হয় পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া। কেরলের ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট, কর্নাটক ফোরাম ফর ডিগনিটি এবং তামিলনাড়ুর মানিথা নীতি পাসারাই মিলে গঠিত হয় পিএফআই। তার ৪ মাস পর ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেঙ্গালুরুতে এক সমাবেশে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে এই সংগঠন।

আত্মপ্রকাশের সময়ই তারা ঘোষণা করে, তাদের লড়াই সমাজের দলিত, সংখ্যালঘু এবং তফসিলি জাতির মানুষের জন্য। কন্নড় রাজনীতিতে কংগ্রেস, বিজেপি এবং জনতা দল(এস)-এর থেকে তারা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে চলতে শুরু করে। শুধু তাই নয়, এই তিন দলই পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষারোপ করতে থাকে পিএফআই-কে মদত দেওয়ার জন্য। এই বিতর্কের কেন্দ্রে ছিল মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক। তবে পিএফআই কিন্তু কোনও দিনই রাজনৈতিক দল হিসেবে দেখা দেয়নি। কোনও নির্বাচনেই প্রার্থী দেয়নি। দক্ষিণপন্থী সংগঠন, যেমন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং আরএসএস-এর মতোই এরাও প্রকাশ্যে সমাজসেবার কাজ করে এসেছে, অবশ্যই মুসলিম সমাজের জন্য। তবে ২০০৯ সালে তারা গড়ে তোলে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ ইন্ডিয়া নামে একটি রাজনৈতিক দল। যারা মুসলিম, তফসিলি জাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর গোষ্ঠীর দাবিদাওয়ার ইস্যু নিয়ে কাজ করে।

কীভাবে অপারেশন
এই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হয়েছিল বিভিন্ন রাজ্যর তরফে। পরে তদন্তকারী সংস্থার রিপোর্টের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২২ সেপ্টেম্বর এবং ২৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ), এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) পিএফআই-এর বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। পিএফআই-এর আগে কোঝিকোড়ে একটি মেগা ‘সেভ দ্য রিপাবলিক’ কনভেনশনের আয়োজন করেছিল। সেই কনভেনশনের পর আরএসএস-এর বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচারে নেমেছিল এই মুসলিম মৌলবাদী সংগঠন। প্রথম দফা অভিযানে, পিএফআই-এর অন্তর্গত ১০৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এদিকে, দ্বিতীয় দফা অভিযানে, পিএফআই-এর সঙ্গে জড়িত ২৪৭ জনকে গ্রেফতার অথবা আটক করা হয়েছে। এর আগে গত ২২ সেপ্টেম্বর কেরল, তামিলনাড়ু, কর্নাটক, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, অসম, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ, গোয়া, মহারাষ্ট্র, বাংলা, বিহার, মণিপুর-সহ বিভিন্ন এলাকায় তল্লাশি চলেছিল।

এনআইএ-র অ্যাকশন, তল্লাশি ইডি-র
সম্প্রতি দেশজুড়ে পিএফআই নেতা ও সদস্যদের বাড়ি ও অফিসে যৌথভাবে তল্লাশি চালায় জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ), এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) এবং রাজ্য পুলিশ। পিএফআই নেতা ও ক্যাডাররা সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগান, অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য শিবিরের আয়োজনের মতো কাজকর্মে যুক্ত আছে বলে যে 'লাগাতার তথ্য ও প্রমাণ' আসছিল, তার ভিত্তিতে পাঁচটি এফআইআর রুজু করেছে এনআইএ।

ওই এফআইআরগুলির ভিত্তিতে দিল্লি (১৯টি জায়গা), কেরল (১১টি জায়গা), কর্নাটক (আটটি জায়গা) অন্ধ্রপ্রদেশ (চারটি জায়গা), হায়দরাবাদ (পাঁচটি জায়গা), উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, অসম, বিহার, মণিপুর-সহ দেশের মোট ১৫টি রাজ্যের ৯৩টি জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে প্রচুর ক্যাডারকে গ্রেফতার করা হয়। ২১ সেপ্টেম্বর কলকাতার পার্ক সার্কাসের তিলজলা রোডে পিএফআই-এর দফতরেও তল্লাশি চালিয়েছিল এনআইএ। কেন্দ্রের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান যে এতেই থামছে না, তা জানানো হয়েছে। এতে রক্তপাতের ইতিহাস বন্ধ হয় কি না, এখন তাই দেখার।

More Articles