বিশ্বকল্পকাপ ড্রিম ১১: ঠাঁই নেই নেইমারের! কেমন হবে আমার বিশ্বকাপের সেরা দল?

FIFA World Cup Football: রুনি হবেন বক্স টু বক্স মিডফিল্ডার। তিনি দুর্দান্ত ফিনিশার, দুর্দান্ত পাসার, ভাল ডিফেন্ডার। পাগল ষাঁড়ের মতো প্রতিপক্ষকে তাড়া করতে পারেন।

এ বছর শীত যত ধুন্ধুমার ব্যাটিংই করুক না কেন, বিশ্বকাপ ফুটবলের উত্তাপের কাছে পাত্তাই পাবে না। আবারও ফুটবল জ্বরে আক্রান্ত আট থেকে আশি। স্কুল-কলেজ, অফিস-কাছারি, দোকান-বাজার, ট্রেন-বাস এবং অবশ্যই সোশ্যাল মিডিয়ায় বলাবলি, “কাল মেসির গোলটা দেখলি?” কিংবা, “ব্রাজিল তো মাঠে ফুল ফোটাচ্ছে রে, এবার হেক্সা না হয়ে যায় না।” মোটকথা মনুষ্য প্রজাতি এখন বিশ্বকাপ ফুটবলময়। আমিও বিজ্ঞানসম্মত হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্সই, তার উপর বাঙালি। তাই বিশ্বকাপ জ্বরে ভোগা থেকে বাদ পড়ি কী করে। জ্বরের প্রলাপ হিসেবে বাছতে এলাম পছন্দের সেরা একাদশ।

প্রথমেই বলে দিই, আমি তাঁদেরই দলে নেব যাঁদের খেলতে দেখেছি। ফলে পেলে, বেকেনবাওয়ার, জর্জ বেস্ট, লেভ ইয়াসিন, জোহান ক্রুয়েফ, মিশেল প্লাতিনি কেউ থাকবেন না। মারাদোনাকে ৯৪-এর বিশ্বকাপে দেখেছি, কিন্তু সেই মারাদোনা আমার একাদশে আসবেন না। থাকবেন না আমাদের চুনী গোস্বামী, শৈলেন মান্না, সুরজিত সেনগুপ্ত কিংবা ভারতের মারাদোনা কৃশানু দে।

এবার আসি ফর্মেশনের কথায়। আমার বরাবরের পছন্দ আক্রমণাত্মক ৪-৩-৩। মাঝমাঠের তিন জনের একজন খেলবেন কিছুটা পেছন থেকে, হোল্ডিং মিডফিল্ডারের ভূমিকা তাঁর। বাকি দু'জন আক্রমণে সাহায্য করবেন। ডিফেন্সে দু'জন সেন্টার ব্যাক বা স্টপার আর দুই কোণায় দুই ফুলব্যাক যাঁরা প্রয়োজনে উইং ব্যাকের কাজ করবেন। এবার খেলোয়াড় নির্বাচন।

গোলকিপার: ইতালির জিয়ানলুইজি বুঁফোকে ছাড়া কাউকে ভাবতে পারছি না। খানিকটা কাছাকাছি আসেন স্পেনের ইকের ক্যাসিয়াস। ক্লাব এবং আন্তর্জাতিক স্তরে দুজনেই তুমুল সফল। কিন্তু অবিশ্বাস্য রিফ্লেক্স, অদম্য আত্মবিশ্বাস এবং বরাভয় নেতৃত্বগুণ বুঁফোনকে সবার থেকে আলাদা করেছে। ইউটিউব খুললেই মিলবে তার প্রমাণ। আমার দলের অধিনায়ক তিনিই।

রাইট ব্যাক: দানি আলভেজ। ব্রাজিলের এই ডিফেন্ডারের যা স্কিল তাতে বহু ফরোয়ার্ড লজ্জা পাবেন। ড্রিবল করতে পারেন, অনবদ্য পাসিং ক্ষমতা এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ৯০ মিনিট মাঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অক্লান্তভাবে দৌড়তে পারেন।

লেফট ব্যাক: এক্ষেত্রে দ্বিধায় ছিলাম পাওলো মালদিনি এবং মার্সেলোর মধ্যে। মালদিনি কিংবদন্তি, রক্ষণাত্মক দিকে তিনি এগিয়ে আবার মার্সেলো আধুনিক ফুলব্যাক। বাঁ পায়ে চোখধাঁধানো ড্রিবলিং আছে, পাসিং এবং ওভারল্যাপিং নিয়ে আক্রমণাত্মক দিকে এগিয়ে। সঙ্গে ডিফেন্সটাও করতে পারেন। তাই ব্রাজিলীয় মার্সেলোকেই রাখলাম।

রাইট সেন্টার ব্যাক: চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল। অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের কাছে ১ গোলে হারছে রিয়াল মাদ্রিদ। ৯০ মিনিট পর্যন্ত গোল করতে পারেননি ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, করিম বেঞ্জেমা এবং গ্যারেথ বেলের বিখ্যাত বিবিসি ত্রিফলা। অতিরিক্ত সময়ে কর্নার পেল রিয়াল। সবার উপরে লাফিয়ে অব্যর্থ হেডে গোল করলেন সার্জিও র‍্যামোস। এরকম বহুবার দলের ত্রাতা হয়ে উঠেছেন। ফুটবল মহলে 'গুন্ডা' হিসেবে তকমা পেয়েছেন। মেসি হোক বা সালাহ, কড়া ট্যাকল করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না স্প্যানিশ ডিফেন্ডার। আধুনিক ফুটবলের সেরা স্টপার র‍্যামোস বিশ্ব ফুটবলের সব কিছু জিতেছেন। তিনি থাকছেনই।

লেফট সেন্টার ব্যাক: ফুটবলের ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত একজন ডিফেন্ডারই ব্যালন ডোর পুরস্কার জিতেছেন। তিনি ইটালির ফাভিও কানাভারো। উচ্চতা সামান্য কম, কিন্তু দৃঢ়চেতা কানাভারোর কাছে 'খাটো' হয়েছেন তাবড় তাবড় স্ট্রাইকার। র‍্যামোসের সঙ্গে আমার দলে জুটি বাঁধবেন তিনিই।

হোল্ডিং মিডফিল্ডার: এই পজিশনে খেলবেন আর এক ইটালিয়ান, আন্দ্রে পির্লো। তাঁকে বলা হতো 'দ্য অর্কেস্ট্রেটর'। মাঝমাঠ থেকে গোটা খেলা পরিচালনা করতেন তিনি। বল ধরে রাখতে পারেন, প্রয়োজনে ছাড়তে পারেন। নিখুঁত পাসে খুঁজে নিতে পারেন ফরোয়ার্ডের পা কিংবা মাথা। এই পোজিশনে লুকা মড্রিচ এবং স্টিভেন জেরার্ডের নামও মাথায় এসেছিল। কিন্তু বিশ্বকাপ জিতেছেন পির্লো। তিনিই আমার দলে।

অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার: যদি মহাকাশ থেকে কোনও বল এসে তাঁর পায়ে পড়ে, তুলোর মতো স্পর্শে তা এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেবেন তিনি। কামানের গোলাকেও নিখুঁতভাবে রিসিভ করতে পারবেন। তিনি আর কেউ নন, জিনেদিন জিদান। আমি পেলে-মারাদোনাকে সেরা সময়ে দেখিনি। কোনও আক্ষেপ নেই, কারণ আমি জিদানকে দেখেছি। একার কাঁধে দেশকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করেছেন জিদান। একাই একটা তারকাখচিত ব্রাজিলকে পায়ের জাদুতে সম্মোহিত করেছেন। শুধু কি দেশ, ক্লাবের হয়েও কী না করেছেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে তাঁর বা পায়ের ভলিতে গোল হয়তো এলিয়েনরাও রিপ্লে চালিয়ে দেখে। এই সেরা এগারো নির্বাচনের শুরুতে তাঁর নামটাই মাথায় এসেছিল।

মিডফিল্ডার: এবার যাঁকে দলে নিচ্ছি তিনি আদতে স্ট্রাইকার। কিন্তু মাঝমাঠেও অত্যন্ত দক্ষ, পারেন ডিফেন্স করতেও। আমার দলে তাঁর কোনও 'ডেসিগনেটেড' পজিশন নেই। তিনি স্রেফ খেলবেন। হ্যাঁ, এই প্রথম একজনকে নিতে আবেগ কাজ করছে, কিন্তু সেই আবেগের মুখটাও ফুটবলীয়। তিনি ওয়েন রুনি। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড এবং ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ গোলদাতা। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা। কিন্তু এই পরিসংখ্যান রুনিকে ঠিক মতো চেনায় না। আমার দেখা সবথেকে নিঃস্বার্থ ফুটবলার ওয়েন রুনি। নিজের রেকর্ডের কথা না ভেবে যিনি দলের কথা ভাবেন। গোলস্কোরিং পোজিশনে দাঁড়িয়েও যিনি তাঁর থেকেও সুবিধাজনক জায়গায় দাঁড়ানো প্লেয়ারকে পাস দিয়ে দেন। কোটি কোটি টাকার অফার পেয়েও স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের কথায় ক্ষয়িষ্ণু ম্যান ইউনাইটেডে থেকে যান। ইব্রাহিমোভিচ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ম্যান ইউতে হয়তো নাম কিনেছেন রোনাল্ডো কিন্তু তার আসল কৃতিত্ব রুনির। ওল্ড ট্রাফোর্ডে আসার পর প্র‍্যাকটিস করতে পুরনো রদ্দি গাড়ি নিয়ে আসতেন কার্লোস তেভেজ। তাঁর হাতে নিজের অডি গাড়ির চাবি তুলে দেন রুনি। সব অর্থেই তিনি পারফেক্ট টিমম্যান।

এ তো গেল আবেগমথিত যুক্তি। এই দলে কেন রুনি সে কথায় আসি। রুনি হবেন বক্স টু বক্স মিডফিল্ডার। তিনি দুর্দান্ত ফিনিশার, দুর্দান্ত পাসার, ভাল ডিফেন্ডার। পাগল ষাঁড়ের মতো প্রতিপক্ষকে তাড়া করতে পারেন। কর্নার নিতে পারেন, দারুণ ফ্রি-কিকও নিতে পারেন। পির্লোকে যেমন নিচে নেমে সাহায্য করতে পারবেন, জিদানও আক্রমণে সঙ্গী পাবেন। খাটনি করতে তাঁর জুড়ি নেই। এই দলের ইঞ্জিন আসলে তিনিই।

লেফট অ্যাটাকিং ফরোয়ার্ড: ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। প্লিজ কেউ তর্ক করবেন না। ব্রাজিল সমর্থকরা হয়তো রোনাল্ডিনহোর নাম করতে পারেন কিন্তু রোনাল্ডোর মতো এত বছর ধরে ধারাবাহিক কেউ নয়। ইচ্ছাশক্তি একটা মানুষকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে পারে, তার সেরা উদাহরণ সিআর সেভেন। তাঁকে নিয়ে বেশি কিছু বলার প্রয়োজন নেই। রেকর্ডই যথেষ্ট।

রাইট অ্যাটাকিং ফরোয়ার্ড: যাঁর খেলা দেখার জন্য রাত জাগা যায়, যাঁর খেলা ঠিক খেলা নয় আসলে ম্যাজিক। লিওনেল মেসি। যেদিন তিনি খেলা ছাড়বেন ফুটবলের একটা ঘরানার মৃত্যু হবে। যাঁর খেলাটাই আবেগ, যুক্তির প্রয়োজন পড়ে না। জাদুবিদ্যায় কে আর যুক্তি খোঁজে! যে ফুটবল বোঝে সেই মেসির প্রেমিক। সে ব্রাজিলের সমর্থক হোক কী পর্তুগালের। আমার বিচারে সর্বকালের সেরা মেসিই।

সেন্টার ফরোয়ার্ড: তাঁকে ডাকা হয় ফেনোমেনন নামে। কমপ্লিট স্ট্রাইকার বলতে যা বোঝায় রোনাল্ডো নাজারিও ঠিক তাই। বাঙালিরা বোঝার সুবিধার জন্য বলে ‘বড় রোনাল্ডো’। ড্রিবলিং, পজিশনিং এবং ফিনিশিং সব ক্ষেত্রেই সেরা। তখন এসি মিলানে খেলেন তিনি। শরীর ভারী হয়ে পড়েছে। তা নিয়ে কোচ গাঁইগুঁই করাতে রোনাল্ডোর সটান প্রশ্ন, “আপনি কী চান? আমি দৌড়ব না কি গোল করব? যদি গোল চান তো আমায় নামান।” অনিচ্ছা সত্ত্বেও রোনাল্ডোকে নামান কোচ, জোড়া গোল করে ম্যাচ জিতিয়ে পার্টি করতে চলে যান ব্রাজিলীয় বিস্ময়।

এই হল আমার সেরা একাদশ। নাহ, কোনও বাঙালি বা ভারতীয় ফুটবলারকে রাখতে পারিনি। সুনীল ছেত্রীকে ভালবাসি, ভক্ত আইএম বিজয়নের। তবু ফুটবলীয় যুক্তিতেই দলে রাখতে পারলাম না। আরও কত সেরা এবং পছন্দের প্লেয়ারই তো বাদ পড়লেন। ডেনিস বার্গক্যাম্প, আন্দ্রে ইনিয়েস্তা, মাইকেল আওয়েন, ডেভিড বেকহ্যাম, রয় কিন, প্যাট্রিক ভিয়েরা... নামের তালিকা দীর্ঘ হতেই থাকবে।

More Articles