ছিলেন কমেডিয়ান, হচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী, পাঞ্জাবে ঝাড়ু ঝড় আর ভগবন্ত ভেলকি....
পালাবদল পাঞ্জাবে। কেজরিওয়ালের ঝাড়ু ঝড়ে এবার পাঞ্জাবও হাতছাড়া হল কংগ্রেসের। গত ৭০ বছর ধরে পালা করে পাঞ্জাবের রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল শিরোমণি অকালি দল এবং কংগ্রেসের হাতেই। কিন্তু এবারে সব দলকে পিছনে ফেলে পাঞ্জাবের বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হলেন কেজরিওয়াল তথা রাজ্যের ভাবি মুখ্যমন্ত্রীর মুখ ভগবন্ত সিংহ মান। ১১৭ টির মধ্যে ৯২ টি আসনে জিতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আম আদমি পার্টির ( আপ) সরকার গঠন করতে চলেছেন ভগবন্ত সিংহ মান।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আগেই জানিয়েছিলেন এবারের পাঞ্জাব নির্বাচনে বিজেপির জেতার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।তাঁদের মতে নির্বাচনে কংগ্রেসকে জোর টক্কর দিতে চলেছে আপ। ভোট ফেরত সমীক্ষাতেও ধরা পড়েছে একই ছবি। ইন্ডিয়া টুডে সহ একাধিক সমীক্ষা রিপোর্ট বলেছে পাঞ্জাবে ক্ষমতায় আসতে চলেছে কেজরিওয়ালের দল। ভোট গণনা শুরু হতেই এই ধারণা বাস্তবে রূপান্তরিত হয়েছে।পাঞ্জাব নির্বাচনে আম আদমি পার্টির মুখ্যমন্ত্রী পদের মুখ ছিলেন ভগবন্ত সিংহ মান। ধুরি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিলেন মান।এদিন ৭৮ হাজারেরও বেশি ভোটে জিতে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি নিজের নামে করলেন মান।
কে ভগবন্ত সিংহ মান ?
মান ১৭৯৩ সালে পাঞ্জাবের এক জাঠ শিখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। রাজনীতিতে যোগ দেবার আগে কৌতুক শিল্পী হিসেবে পরিচিত মুখ ছিলেন মান। পাঞ্জাবি ভাষায় একের পর এক জনপ্রিয় কমেডি শো করেছেন মান। একসময় পাঞ্জাবের হাটে মাঠে বাজারে কান পাতলেই শোনা যেত মানের কমেডি। নিজের ভাষায় কৌতুকের মাধ্যমে নানা বিষয় পৌঁছে দিত সাধারণ মানুষের কাছে। এছাড়া পাঞ্জাবি ভাষায় একাধিক সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন মান। ২০১১ সালে পিপলস পার্টি অফ পাঞ্জাবে যোগদান করেন তিনি। ২০১২ সালে প্রথম লেহরা কেন্দ্র থেকে নির্বাচনে দাঁড়ান মান। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে আম আদমি পার্টিতে যোগ দান করেন তিনি।সেবছর নির্বাচনে দাঁড়িয়েই প্রতিপক্ষ আকালি দলের প্রতিনিধিকে ২ লক্ষেরও বেশী ভোটে হারান।
২০১৭ সালে পাঞ্জাব বিধানসভা নির্বাচনে ২০ টি আসনেই থেমে যায় আপের দৌড়।সেবার ভোটে হেরে গেলেও পাঞ্জাবের মানুষের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতাও রয়েছে যথেষ্ট তাই দলও মানের ওপরেই ভরসা রেখেছেন এবারের নির্বাচনে।
মানের মদ্যপান বিতর্ক
২০১৪ সালের মে মাসে নির্বাচনে জিতে আপের সাংসদ হওয়ার পরেই তুমুল বিতর্কের মুখে পড়েন মান।২০১৬ সালে আপ থেকে বহিষ্কৃত সাংসদ হরিন্দর সিংহ খালসা তাঁর ৪৯৫ নং সিটটি পরিবর্তনের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেন স্পিকারকে। তাঁর অভিযোগ ছিল, মানের মুখ থেকে মদের গন্ধ আসে, তাই তিনি তাঁর পাশের আসনে বসতে মোটেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। যদিও মান এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। এর আগেও এই একই অভিযোগ তুলেছিলেন তাঁর দলের নেতার যোগেন্দ্র যাদব। মদ্যপ মানের কারণে বেশ কিছু সময় জাতীয় স্তরে অস্বতিতে পড়েছে আপ। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দর সিং তাঁকে সর্বসমক্ষেই মাদকাসক্ত বলেছেন।২০১৮ সালে ভাতিন্ডায় নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে মঞ্চে ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারেননি মান। দর্শকের উদ্দেশ্যে চুম্বন ছুঁড়ে দিয়ে সেই মঞ্চেই পড়ে যান ভগবন্ত মান।২০১৯ সালে প্রকাশ্য সভায় তিনি শপথ করেন পার্টির ভাবমূর্তি রক্ষার্থে তিনি মদ্যপান ছেড়ে দেবেন। কয়েকদিন আগেও নির্বাচনী প্রচারে মুখ্যমন্ত্রী চান্নি দাবি করেন যে মোটেও কথা রাখেননি মান।
মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে মানের নির্বাচন ও জয়
দলের তরফে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে ঠিক করা হলেও তাঁর ভাবমূর্তির কারণেই নাকি ঘোষণা করা হয়নি মানের নাম।যদিও শেষসময়ে মান নিজের ভাবমূর্তি অনেকখানি উন্নত করে সক্ষম হয়েছিলেন।বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, মান পাঞ্জাবের দুর্নীতিগ্রস্ত যেকোনো নেতার তুলানায় ঢের ভালো। তবে রাজনৈতিক মহলে কান পাতলে শোনা যায়, ভগবন্ত মান নাকি দলকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী না করা হলে তিনি দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবেন। এমনটা হলে নির্বাচনের আগে বড়সড় ক্ষতির মুখে পড়বে দল।নির্বাচনের প্রাক্কলে বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার রিপোর্ট বলছিল এবারে পাঞ্জাব নির্বাচনে আপের জেতার সম্ভাবনা রয়েছে প্রবল। তাঁদের জয় নিশ্চিত করতেই দল চায়নি নতুন করে কোনো বিতর্ক তৈরি হোক সেই সময়। এছাড়া পাঞ্জাবে আম আদমি পার্টির প্রধান পদে ছিলেন মান। শুধুমাত্র রাজনীতিবিদ হিসেবে নয় অভিনেতা ও কৌতুক শিল্পী হিসেবে মানের যে জনপ্রিয়তা রয়েছে তাকেই দলের তরফে কাজে লাগানো হয় তুরুপের তাস হিসাবে। শুধু তাই নয় তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বিচারের জন্য দলের তরফে ঘোষণা করা হয় টেলিফোনিক পোলের মাধ্যমেই বেছে নেওয়া হবে দলের মুখ্যমন্ত্রীর মুখ।এরপরই ১৮ জানুয়ারি টেলিফোনিক পোলে ২১ লক্ষ প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয় ভগবন্ত সিংহ মানের নাম। মানের নাম ঘোষণার সময় কেজরিওয়াল বলেছেন যে স্বাধীনতার পর এই প্রথম মানুষের নির্বাচিত প্রার্থীকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিলেন কোনো দল। আপের এই পদক্ষেপে অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে যায় পাঞ্জাব কংগ্রেস কর্তৃপক্ষ। ফলস্বরূপ বিশাল সংখ্যক ভোটে জিতলেন মান।
এছাড়াও পাঁচ বছর অন্তর পাঞ্জাবের সরকার বদল হলেও কংগ্রেস ও অকালি দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ,অপশাসনের অভিযোগ উঠেছে বারবার। এমনকি পাঞ্জাবের সাধারণ মানুষের দাবি কংগ্রেস ও অকালি দল আদতে একই মুদ্রার এপিঠ- ওপিঠ। এছাড়া কৃষি বিল ও কৃষক আন্দোলনের কারণে আগে থেকেই বিজেপির ওপর ক্ষিপ্ত পাঞ্জাববাসী। মূলত সেই কারণেই আম আদমি পার্টির মুখ ভগবন্ত মানকে বিকল্প হিসেবে বেঁছে নিয়েছেন পাঞ্জাবের সাধারণ মানুষ। কেজরিওয়ালের ‘দিল্লী মডেল’ মানের জয় নিশ্চিত করেছে বলেই মত একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। নির্বাচনে জিতেই মান ঘোষণা করেছেন তিনি রাজ ভবনের বদলে ভগত সিংহের জন্মস্থানে শপথ গ্রহণ করবেন।