বিরাটের গ্ল্যামারের থেকে এগিয়ে সচিনের ক্রিকেট দায়বদ্ধতা, সর্বকালের সেরা 'ক্রিকেট ঈশ্বর' সচিন

Inscript Debate: এখন রান করার সুবিধা আগের থেকে অনেকটাই বেশি। যেহেতু চার, ছক্কা রানের পাহাড় দর্শক টানে, ব্যবসা হয়, মার্কেটিং হয় তাই যাতে রান বেশি হয়, ম্যানেজমেন্ট সেদিকে লক্ষ্য রাখে

গল্পের শুরু ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সোনালি দিনে, ২০১১ সালের ২ এপ্রিল, বিশ্বকাপের ফাইনাল। সামনে শ্রীলঙ্কার ২৭৪ রানের লক্ষ্য, বীরেন্দ্র শেহবাগ প্রথম ওভারেই ফিরে গিয়েছেন, ক্রিজে তখন ‘ক্রিকেট ঈশ্বর’ সচিন তেন্ডুলকর থিতু হওয়ার চেষ্টা করছেন, সারা ভারত জানে মাস্টার ব্লাস্টার যতক্ষণ আছে কোনও ভয় নেই। ঠিক তখনই মালিঙ্গার বিষাক্ত পেসে আউটসাইড এজে লেগে সাঙ্গাকারার হাতে নিজের উইকেট দিয়ে ফিরে যান লিটল মাস্টার। মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে তখন সূচ পতনের শব্দও যেন বিকটভাবে কানে আসবে। নিজের জীবনের শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচে হতাশ হয়ে, হতাশ করে ফিরে যাচ্ছেন ক্রিকেটের ঈশ্বর। ব্যাট হাতে মাঠে নামলেন এক যুবক, আধুনিক স্টাইলে ছাঁটা চুল দাড়ি, হাতে ট্যাটু। দেশের মানুষ তখন সচিনকে হারিয়ে আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে, সচিনের জায়গায় কে ব্যাট করতে এলেন তা নিয়ে কারও উৎসাহই নেই। কে জানত, সচিনের জায়গায় ব্যাট করতে আসা ছেলেটাই একদিন সচিনের সিংহাসনের দাবিদার হয়ে উঠবে! বিশ্বকাপ জিতে সচিনকে ঘাড়ে করে গোটা স্টেডিয়াম ঘোরাচ্ছিলেন সেই তরুণ। কে জানত, সচিনকেই শুধু নয়, নিজের কাঁধে সচিনের উত্তরাধিকার তুলে নেবেন এই তরুণ!

এই তরুণ কোহলির তখনও বিরাট হয়ে ওঠা হয়নি, তখন সবে পথচলা শুরু। এরপরের ইতিহাস সবার জানা। একের পর এক মাইলস্টোন, একের পর এক রেকর্ড নিজের নামে করতে থেকেছেন বিরাট। কোহলি থেকে নিমেষে হয়ে গিয়েছেন কিং কোহলি। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে চলতে থাকে তাঁর স্বমহিমায় ব্যাটিং শাসন। লোকজন বলতে থাকে, ভারতীয় ক্রিকেট সচিনের যোগ্য উত্তরসূরি পেয়েছে। কেউ কেউ আবার তাঁকে সচিনের চেয়েও এগিয়ে রাখতে চেয়েছেন। পরিসংখ্যানও কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেই কথাই বলে।

তবে, সত্যিই কি বিরাট কোহলি সচিনের থেকে এগিয়ে? কোহলিই কি তবে ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা ব্যাটার? এখানেই চলে আসে ব্যক্তিগত মতামত ও যুক্তি। এক্ষেত্রে যুক্তির লড়াইয়ে কথা বলতে গেলে নির্দ্বিধায় বলতেই হয়, বিরাট নন, সচিনই ভারতের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান।

তবে শুধু বললে তো চলবে না, যুক্তি চাই! প্রথমত, খেলার ধরন। সেই সময় দু’ ধরনের ক্রিকেট হতো, টেস্ট আর সীমিত ওভারের ক্রিকেট ম্যাচ। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ৬০ ওভার থেকে তখন সবে ৫০ ওভার চালু হয়েছে। উইকেট বাঁচিয়ে রাখাই ব্যাটসম্যানদের মূল উদ্দেশ্য, তাই খেলার ধরন ছিল রক্ষণাত্মক। ৬০ ওভার থেকে ৫০-এ এলেও খেলার চিন্তাধারা প্রায় একই থেকে গিয়েছিল। রান করা জরুরি ছিলই কিন্তু ক্রিজে টিকে থাকাই ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট আসায় ব্যাটসম্যানরা আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতে পছন্দ করেন, যে যত কম বলে যত বেশি রান করবেন তাঁর কৃতিত্ব তত বেশি। স্ট্রাইক রেট একজন ব্যাটসম্যানের পরিসংখ্যানে দারুণ প্রভাব ফেলে, তাই সেই সময়ের ব্যক্তিগত ৪০ রান আর আজকের দিনের ব্যক্তিগত ৪০ রানের মধ্যে বিস্তর ফারাক। পাওয়ার প্লে বলে কিছু ছিলই না।

দ্বিতীয়ত, এখন রান করার সুবিধা আগের থেকে অনেকটাই বেশি। যেহেতু চার, ছক্কা রানের পাহাড় দর্শক টানে, ব্যবসা হয়, মার্কেটিং হয় তাই যাতে রান বেশি হয়, ম্যানেজমেন্ট সেদিকে লক্ষ্য রাখে। বাউন্ডারিগুলো আগের তুলনায় অনেক ছোট, ব্যাটসম্যান গ্যাপে ঠেলতে পারলেই বাউন্ডারি, আর মিস হিট হলেও বল চলে যাচ্ছে বাউন্ডারির বাইরে। আগে এমন ছিল না, আগে দৌড়ে তিন রান, চার রান নেওয়া খুব স্বাভাবিক এবং ঘন ঘন ছিল। ফলে খুব সহজেই ব্যাটসম্যানরা ক্লান্ত হয়ে পড়তেন, খুব সহজেই বাউন্ডারির হদিস পেতেন না। তাছাড়াও এখন হালকা ব্যাট, হালকা প্যাড, নিরাপত্তা অনেক বেশি!

তৃতীয়ত, প্রযুক্তির প্রভাব! সচিনের সময় ডিআরএস বা রিভিউ সিস্টেম ছিল না। সবাই জানেন, সচিনকে কতবার আম্পায়ার ভুল আউট দিয়েছেন, ব্যাটসম্যানের চাইলেও কিছু করার থাকত না চুপচাপ বেরিয়ে যাওয়া ছাড়া। ভেবে দেখুন, সচিন যদি ডিআরএস ব্যবহার করতে পারতেন তাহলে আরও কত হাজার রান করতে পারতেন নিজের আর দেশের হয়ে।

চতুর্থত, প্রাধান্য। যদি ব্যক্তিগত জীবনে নজর দিই কিছু ছোট ছোট বিষয় খুঁজে পাওয়া যাবে। ‘Sachin A billion Dreams’ তথ্যচিত্রে সচিনের স্ত্রী অঞ্জলি তেন্ডুলকার বলেছিলেন, “আমরা মেনে নিয়েছিলাম যে সচিনের কাছে ক্রিকেট আগে, পরিবার পরে।” যারা সচিনের খেলা দেখেছেন বা সচিন সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন তারা বুঝেছেন সচিন আর ব্যাটিংয়ের মাঝে কিছু নেই। সচিন আর কিছু বুঝতেন না, যেমন রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর শিল্প, তাঁর লেখার মাঝে আর কিছু নেই। এখানেই একজন গ্রেট বা গ্রেটেস্ট হয়। কিন্তু বিরাটের ক্ষেত্রে মাঝে রয়েছে নানা কিছু। বিরাটের পোস্টারবয় ইমেজ, গ্ল্যামার, ফ্ল্যামবয়েন্সি, সোশ্যাল মিডিয়া, বিজ্ঞাপনের অস্তিত্ব অনেকটাই বেশি, বিরাট পরিবারকেও যথেষ্ট সময় দেন, যা ফ্যামিলিম্যান হিসেবেও বিরাটকে সচিনের চেয়ে এগিয়ে দেবে। কিন্তু ক্রিকেটের প্রতি দায়বদ্ধতায় কিছুটা হলেও পিছনে ফেলবে সচিনের থেকে।

পঞ্চমত, বিরাট গত তিন বছর ধরে ফর্মের বাইরে। শুধু সেঞ্চুরি যে আসেনি তা নয়, কোনও ম্যাচ জেতানো ইনিংস বা বড় রানের ইনিংসও বিরাটের ব্যাট থেকে খুব একটা আসেনি। যা বিরাটের মতো একজন ধারাবাহিক ব্যাটারের কাছ থেকে মেনে নিতে অসুবিধাই হচ্ছিল মানুষের। অফস্টাম্পের বাইরের বল কভার ড্রাইভ মারতে গিয়ে বারবার কিপার বা স্লিপ ফিল্ডারের হাতে জমা দিয়ে ফিরে যেতে হচ্ছিল, কিন্তু সচিনের সেই ঐতিহাসিক ইনিংসের কথা আমরা সবাই জানি। জানি তাঁর সংযমের কথা, কভার ড্রাইভ মারতে গিয়ে আউট হচ্ছিলেন বলে একটা সিডনি টেস্টের গোটা ম্যাচে কোনও রকম কভার ড্রাইভ মারার চেষ্টা না করেই ডবল সেঞ্চুরি করেছিলেন সচিন। এই সংযমের অভাব রয়েছে বিরাটের মধ্যে।

সচিন আর বিরাট দুজনেই ভারতীয় ক্রিকেট তথা বিশ্ব ক্রিকেটের অহংকার, তাঁদের পরিসংখ্যান, তাঁদের ক্রিকেটের প্রতি দায়বদ্ধতা মানুষের কাছে অনুপ্রেরণা। তবে কে সেরা বাছতে হলে সচিন তেন্ডুলকর গ্রেটেস্ট অব অল টাইম, আর বিরাট কোহলি মডার্ন ডে গ্রেটেস্ট।

More Articles