এখনও দগদগে ২৬/১১ হামলার ক্ষত, এই সন্ত্রাসীর শাস্তিতে কি সুবিচার মিলবে আক্রান্তদের?

২০০৮ সাল। আরব সাগরের বুকে নৌকো নিয়ে ভেসেছে জেলেরা। এরই মধ্যে একটি নৌকো একটু দূরে চলে এসেছিল। নতুন কিছু নয়। এক জায়গায় ভিড় করে মাছ ধরা হয় না। তাছাড়া মাছের খোঁজ পাওয়াটাও দরকার। একটা-দুটো মাছ ধরার তো আর ব্যাপার নয়, প্রয়োজন মাছের ঝাঁক। সেই কারণে সমুদ্রে বেশ খানিকটা ঘোরাঘুরি করতে হয়। নভেম্বরের দারুণ আবহাওয়ায় সেদিনও ঝাঁকের খোঁজে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল জেলেরা। আচমকা আক্রমণের জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। থাকলেও বা কী! সশস্ত্র আক্রমণকারীদের ঠেকানোর ক্ষমতা তাদের ছিল না। পাকিস্তানের পতাকাবাহী একটা কার্গো শিপে করে করাচি থেকে তারা আরব সাগরে এতটা পথ পাড়ি দিয়েছিল। জেলে নৌকাটা পেয়ে তাদের বেশ সুবিধেই হল। লাশগুলো জলে ভাসিয়ে আবার মুম্বইয়ের দিকে এগোতে থাকল নৌকাটি। কারও কোনও সন্দেহের উপায় নেই। তীরের কাছকাছি নৌকোা ছেড়ে কয়েকটি ডিঙ্গি এগিয়ে চলল বধওয়ার পার্ক এবং সাসুন ডকের দিকে। এদিক থেকে ইন্ডিয়া মনুমেন্টের রাস্তাটা কাছে। এরপর দু’টি দলে ভাগ হয়ে গেল লোকগুলো। লক্ষ অনেকগুলো। মুম্বইয়ের দক্ষিণে ছত্রপতি শিবাজী রেলওয়ে স্টেশন, বিখ্যাত লেওপোল্ড কাফে, দু’টি হাসপাতাল ও একটি থিয়েটারে হলে প্রাথমিক হামলা। ২৬ নভেম্বর রাত সাড়ে ন’টার কাছকাছি আচমকা স্বয়ংক্রিয় বন্দুক ও হ্যান্ড গ্রেনেড নিয়ে আক্রমণ শুরু হল। এবং তা চলে প্রায় কয়েক ঘণ্টা। ধীরে ধীরে খবর আসতে থাকে, এরই ফাঁকে আরও তিনটি জায়গায় সাধারণ মানুষকে আটকে রাখা হয়েছে। ‘দ্য নরিম্যান হাউজ’, ‘ওবেরয় ট্রিডেন্ট’ এবং ‘তাজ মহল প্যালেস’—এই তিনটি স্থানে ঘাঁটি গেঁড়েছে আতঙ্কবাদীরা।

দশটি মাত্র লোক। চারটি দিন। খুন হয়েছিলেন ১৭৪ জন নিরাপরাধ মানুষ। ৩০০-রও বেশি আহত। এই ঘটনা সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা বিশ্বে। চারদিনের লড়াইয়ে ১০ জনের মধ্যে ন’জন মারা গিয়েছিল। কাসভকে গ্রেফতার করা হয়। গোটা আক্রমণের দায় নিয়েছিল ‘মুজাহিদিন হায়দ্রাবাদ ডেকান’ নামে একটি গোষ্ঠী, একটি ই-মেলের মাধ্যমে। কিন্তু সেই ই-মেল ট্রেস করতে গিয়ে পাকিস্তানের এক কম্পিউটারের হদিশ পাওয়া গেল। তদন্তকারীরা মোটামুটি তখন বুঝে গিয়েছেন, ওই নামে আদৌ কোনও গোষ্ঠী নেই। তবে কি আল-কায়দা? তাই ভাবা হচ্ছিল বটে, কিন্তু আজমল আমির কাসভের অ্যারেস্টে ব্যাপারটা অন্যদিকে ঘুরল। কাসভ পাকিস্তানের পাঞ্জাব অঞ্চলের বাসিন্দা। তার কাছ থেকেই জানা গেল, এই দশজন ‘লশকর-এ-তাইবা’-র ক্যাম্পে দীর্ঘদিন গেরিলা পদ্ধতিতে লড়াই করেছে। আরেকটি সংগঠন ‘জামাত-উদ-দাওয়া’-র শীর্ষ কার্যালয়ে বেশ কিছু সময় কাটিয়েছে। কার্যালয়টি মুরিদকে শহরে। সেখান থেকেই তারা পাঞ্জাব হয়ে করাচি আসে। এরপরে জলপথে মুম্বই। এই তথ্য সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করা হতে থাকে পাকিস্তানের ওপর। প্রথমে পাকিস্তান ভারতকে সাহায্য করতে রাজি হলেও পরে কোনও অজ্ঞাত কারণে পিছিয়ে যায়। তখন সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সিকিউরিটি কাউন্সিলের কাছে আবেদন জানায় ভারত। ‘লশকর-এ-তাইবা’ ২০০২ সাল থেকেই ব্যান করেছিল পাকিস্তান। ‘জামাত-উদ-দুয়া’ তারই শাখা প্রমাণিত হলে ২০০৮ সালের ১১ ডিসেম্বর সরকারিভাবে সেটিকেও আতঙ্কবাদী সংগঠন বলে ঘোষণা করা হয়। যদিও প্রাথমিকভাবে কিছু ধরপাকড় হলেও তা বেশিদিন চালায়নি পাকিস্তান সরকার।

তখন থেকেই হাফিজ সাইদের নাম উড়ছে বাতাসে। ‘লশকর-এ-তাইবা’-র প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে সাইদ অন্যতম। ‘জামাত-উদ-দুয়া’-র প্রধান। ২০০৮-এর সেই হামলার ছক পুরোটাই ছিল এই হাফিজ সাইদের। বহুবার জেলে গিয়েছে, ছাড়াও পেয়েছে। গৃহবন্দি থেকেছে, অথচ গোটা দেশে ঘুরে বেড়াতে দেখা গিয়েছে তাকে। একের পর এক উসকানিমূলক প্রচার, বক্তব্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তার। ২০১৯ সালে ট্রাম্পের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার একটা মরিয়া চেষ্টা করেন ইমরান খান। তাঁর আমেরিকা যাওয়ার ঠিক  আগেই ২০১৯ সালে গ্রেফতার হয় সাইদ। গুজরানওয়ালা থেকে লাহোর যাওয়ার পথে পাঞ্জাবের কাউন্টার টেররিস্ট ডিপার্টমেন্ট আটক করে তাকে। ট্রাম্প টুইট করে জানান, দশ বছর নিরবচ্ছিন্ন তদন্তের পরে সাইদ ধরা পড়েছে। মধুরেণ সমাপয়েৎ। অথচ, আমেরিকারই ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটি জানাচ্ছে, ২০০১ সাল থেকেই অন্তত আটবার আটক করেও ছাড়া হয়েছে সাইদকে। ২০১৭ সালেও ১১ মাসের জন্য জেলে ছিল সাইদ। পাঞ্জাবের জুডিশিয়াল রিভিউ বোর্ড স্বয়ং আর জেলে রাখতে চায়নি তাকে। ফলত. ফের ছাড়া পায় সাইদ। যাই হোক, একে একে ট্রাম্প ক্ষমতা হারালেন, ইমরানও তাঁকে অনুসরণ করলেন।

ইতিমধ্যে ২০২০ সালে হাফিজ সাইদের ১৫ বছরের কারাদণ্ড হল। তখন হাফিজের বয়স ৭০। তার মধ্যেই টালমাটাল অবস্থা পাকিস্তানের। ইমরান ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার পর এবার আবার হাফিজের জেল হল বিচারে। মেয়াদ ৩২ বছর। হাফিজের বয়স এই মুহূর্তে ৭১।

পিটিআই রিপোর্ট বলছে, অ্যান্টি-টেররিজম কোর্টের বিচারপতি এজাজ আহমেদ ভুত্তর পাঞ্জাব পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক নথিবদ্ধ দু’টি এফআইআর– ২১/২০১৯ এবং ৯৯/২০১৯-এর ভিত্তিতে ৩২ বছরের কারাদণ্ড দেন হাফিজ সাইদকে। ২১/২০১৯ এবং ৯৯/২০১৯–তে যথাক্রমে সাড়ে পনেরো বছর ও সাড়ে ষোলো বছরের সাজা দেওয়া হয়। হাফিজের সমস্ত সম্পত্তি আটক করেছে কোর্ট। এছাড়াও তিন লক্ষ চল্লিশ হাজার টাকার জরিমানা ঘোষণা করেছে কোর্ট। প্রসঙ্গত, লাহোরের কোট লাখপত জেল থেকে তাকে বিচারালয়ে আনা হয়। সেখানেই ২০১৯ থেকে বন্দি ছিল সাইদ। এবার তার বিচার সম্পূর্ণ হল।

কিন্তু নিহত ১৭৪ জন? আহত আরও তিনশো জন? তাঁদের ট্রমা? দুই দেশের রেষারেষির মাঝে প্রতিদিন যে অসংখ্য সাধারণ মানুষ পিষে যাচ্ছে– তাদের দুর্দশার দায়িভার নেবে কে? আতঙ্কের দেশে আতঙ্কবাদীর নতুন করে ভূমিকা কতটুকু? উত্তর নেই। ঘুঁটি রয়েছে। আর দাবার কিছু চাল– এইমাত্র।

More Articles