কংগ্রেসের ঘোর কলি! কপিল সিবালের দলত্যাগ যে বার্তা দিল

২০২৪-কে সামনে রেখে বিরোধীরা যখন ঘুঁটি সাজাতে ব্যস্ত, তখন কংগ্রেসের এ কী হাল! রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বারবার বলছেন, এক্ষেত্রে কংগ্রেসকে বড় ভূমিকা নিতে হবে। লড়াই তো পরের কথা।

সুনীল জাখর, হার্দিক প্যাটেল, কপিল সিবাল...

এরপর কে? কংগ্রেসের ভাঙা তরী মেরামতের সম্ভাবনা ক্রমশই ম্লান হয়ে আসছে। হাত শিবিরে এখন ঘরে-বাইরে কালো মেঘ। কংগ্রেসের যেন এখন এই অবস্থা- 'আমার ভাঙ্গা তরী ছেড়া পাল/চলবে আর কত কাল...‌।'

শতাব্দীপ্রাচীন দলের এ কী অবস্থা! হার্দিকের ধাক্কার রেশ কাটেনি, তার মধ্যেই কংগ্রেস ছাড়লেন প্রবীণ নেতা কপিল সিবাল। তিনি সমাজবাদী পার্টির হয়ে রাজ্যসভায় মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। মনোনয়ন পেশের সময় তাঁর পাশে ছিলেন এসপি প্রধান অখিলেশ যাদব। তাঁর পদত্যাগে কংগ্রেস কতটা ধাক্কা খেল, সেই প্রসঙ্গে পরে আলোচনা হচ্ছে, তার আগে বলা দরকার, রাজস্থানের উদয়পুরে তিনদিনব্যাপী ‘নব সংকল্প চিন্তন শিবির’ চলাকালীনই দল ছাড়েন পাঞ্জাবের প্রাক্তন প্রদেশ সভাপতি সুনীল জাখর। এরপর কংগ্রসের পালে ঝটকা দিয়ে দল ছাড়েন হার্দিক প্যাটেল। এবার কপিল সিবাল। অনেকদিন ধরেই বিদ্রোহের সুর শোনা গেছে সচিন পাইলটের গলায়। রাহুলের পর নিজেদের গড় উত্তরপ্রদেশে ব্যর্থ প্রিয়াঙ্কা ম্যাজিক। ফলে আসরে নামেন সোনিয়া স্বয়ং। তাতেও সে গুড়ে বালি! প্রবীণ, নবীন কাউকেই ধরে রাখতে পারছে না হাত।

আরও পড়ুন: সব চোখ ২০২৪-এ, এখন থেকেই জোটের আশায় জল ঢালছে কংগ্রেস?

সিবাল-কংগ্রস বিরোধ
পেশায় আইনজীবী কপিল কংগ্রেসি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কংগ্রেস তাঁকে আবার রাজ্যসভায় পাঠাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। মূলত বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর নেতা কপিলের দাবি, গত ১৬ মে তিনি কংগ্রেস ছেড়েছেন। মনমোহন জমানায় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্ব সামলেছেন। রাজ্যসভায় মোদি সরকারের দিকে তীক্ষ্ণ আক্রমণ শানানোর ব্যাপারে প্রথম সারিতে ছিলেন তিনি। কিন্তু সম্প্রতি কংগ্রেসের বর্তমান নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর মতের অমিল হয়। কংগ্রেসের পরিচালন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। সেই সময় থেকেই গান্ধীদের সঙ্গে তাঁর দূরত্বের শুরু। সম্প্রতি জয়পুরে চিন্তন শিবির শেষে বিক্ষুব্ধ শিবিরের (জি২৩ নামে পরিচিত) দুই নেতা আনন্দ শর্মা ও গুলাম নবি আজাদকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও, কংগ্রেসে কপিল ‘উপেক্ষিত’-ই থেকে যান বলে মনে করেছিলেন পর্যবেক্ষকরা। তিন দিনের চিন্তন শিবির শেষ হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তিনি কংগ্রেস ছাড়েন।

সিবালের হাত ছেড়ে সাইকেলে সওয়ার হওয়া নিয়ে ময়নাতদন্ত শুরু হয়েছে। প্রবীণ এই রাজনীতিবিদের এই সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে বিশ্লেষকদের মন্তব্য, "চব্বিশের ভোটে বিজেপি-বিরোধী লড়াইয়ে কংগ্রেস পিছিয়ে পড়ছে, সেটা বুঝতে পারছেন সিবালের মতো নেতা। উত্তরপ্রদেশে যেহেতু সমাজবাদী পার্টি ভালো ফল করেছে, তাই সাধারণ নির্বাচনে লড়াইয়ের মতো জায়গায় থাকবেন তিনি। দক্ষ রাজনীতিবিদের মতো এই সিদ্ধান্ত।"

নেতৃত্বের প্রশ্নে বিরোধ
নেতৃত্বের প্রশ্নে বারবার প্রবীণ এই নেতার সঙ্গে দলের বিরোধ সামনে এসেছে। সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, গান্ধীদের সরে যাওয়ার সময় এসেছে। এবার নেতৃত্বদানে অন্য কাউকে সুযোগ দেওয়া উচিত। একের পর এক রাজ্যে হার নিয়ে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে ব্রেন স্টর্মিং সেশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেই সিদ্ধান্তকে কটাক্ষ করেছেন কপিল সিবাল। তিনি বলেছেন, এত বছর পরেও দলের পতনের কারণ সম্পর্কে না জানলে নেতৃত্ব 'কোকিলের দেশে বাস করছে' বলেও কটাক্ষ করেন তিনি।

রাহুল-প্রশ্নে আপত্তি
ওয়ার্কিং কমিটির একটা অংশ রাহুল গান্ধীকে কংগ্রেস সভাপতি পদে ফেরানোর কথা বলেছে। যা নিয়ে কপিল সিবাল বলেছেন, যাঁরা এই পক্ষের সমর্থক, তাঁরা মনে করছেন কংগ্রেস নির্দিষ্ট কাউকে ছাড়া এগোতে পারবে না। রাহুল গান্ধী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কংগ্রেস সভাপতি না হলেও তিনি সব সিদ্ধান্তই নিয়ে থাকেন। যেমন চরণজিৎ সিং চান্নিকে তিনি পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসিয়েছিলেন।

বিদ্রোহী পাইলট
বারবার বিদ্রোহের সুর শোনা গেছে রাজস্থানের প্রাক্তন উপ-মুখ্যমন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেতা সচিন পাইলটের গলায়। ঘটনা চরমে ওঠে ২০২০ সালে। রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলটের বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহ ঘোষণা করে ১৮ জন বিধায়ককে নিয়ে রিসর্টে গিয়ে থেকেছিলেন বেশ কয়েকদিন। রাজস্থানের সরকারের পতনের আশঙ্কা দেখা গিয়েছিল সেই সময়। তবে শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস হাই কমান্ডের হস্তক্ষেপে দলে 'ফিরে' আসেন সচিন। তবে খুব বেশিদিন শান্তি বজায় থাকেনি হাত শিবিরে।

সেই সময় রাতারাতি সরকার পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হওয়ায় তাঁকে দিল্লিতে ডাকেন কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, খুব শিগগিরই সচিনের দাবি-দাওয়া নিয়ে বিবেচনা করা হবে। সচিন-ঘনিষ্ঠরা পদ পাবেন। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। ক্ষুব্ধ সচিন পাইলট পরে বলেন, "প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি দল। দুঃখের বিষয়, যেসব কর্মীরা সর্বস্ব দিয়ে দলের জন্য কাজ করেছেন তাঁদের কথাই অশ্রুত থেকে যাচ্ছে।" কংগ্রেসের তরফে এই সময়ে সচিনকে বলা হয়েছে, আরেকটু ধৈর্য ধরতে। এই টালমাটাল সময়ে আরেকটু আস্থা রাখতে। যোগ্য মর্যাদাই তিনি পাবেন, বলা হয়েছে দলের তরফে। সচিনের সঙ্গে কংগ্রেসের দূরত্ব মিটেও না মেটার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। সচিন-গেহলটের যুদ্ধে মধ্যস্থতার কাজ করছিলেন আহমেদ প্যাটেল। তাঁর মৃত্যুতে প্রকৃতপক্ষে একটি শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে রাজস্থান সরকারে বেশ কয়েকটি শূন্য পদ থাকলেও জায়গা হয়নি পাইলট অনুগামীদের।

২০২৩ সালে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রাজস্থানে। এই আবহে ফের বিদ্রোহের আঁচ পাওয়া যাচ্ছে কংগ্রেসের অন্দরে। দূরত্ব বাড়ছে অশোক গেহলট-সচিন পাইলটের মধ্যে। হঠাৎই সচিন-ঘনিষ্ঠ বিধায়ক হেমরাম চৌধুরী বিধায়ক পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপরই আরও জোরালো হয় অন্তর্দ্বন্দ্ব। পরে পাইলটের মান ভাঙাতে ও মরু রাজ্যে দুর্গ সামলাতে আসরে নামেন পরপর রাহুল ও সোনিয়া। মুখের কথায় চিঁড়ে ভিজেছে কি? সময়ই এর উত্তর দেবে।

কংগ্রেসের ভাঙা তরী
সদ্যই মিটেছে পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা ভোট। পাঞ্জাবে কংগ্রেসকে ক্লিন বোল্ড করেছে আপ। উত্তরপ্রদেশে পরিবারের শক্ত ভিতে দাঁত ফোটাতে পারল না কংগ্রেস। কাজে এল না প্রিয়াঙ্কা ম্যাজিক। এই অবস্থায় কংগ্রেসের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা যখন প্রায় নেই, তখন আসরে নামেন খোদ সোনিয়া। তাতেও শিবির রক্ষা করতে পারছেন না তিনি। হার্দিকের মতো প্রভাবশালী নেতা সঙ্গ ত্যাগ করেছেন। পতিদারদের মন পেতে যাই-ই করুন না কেন, শোকের আবহে আরও মুষড়ে পড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ালেন কপিল। সামনে গুজরাতের ভোট, তারপরে আগামী বছর রাজস্থানে। সেখানে পাইলট অন্য কোনও বিমানে সওয়ার হবেন কি না, তা নিয়েও কংগ্রেসের চিন্তার কারণ আছে। ২০২৪-কে সামনে রেখে বিরোধীরা যখন ঘুঁটি সাজাতে ব্যস্ত, তখন কংগ্রেসের এ কী হাল! রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বারবার বলছেন, এক্ষেত্রে কংগ্রেসকে বড় ভূমিকা নিতে হবে। লড়াই তো পরের কথা। কংগ্রেস তো ঘর সামলাতেই পারছে না।

কংগ্রেসের এখন ভেন্টিলেশন প্রাপ্তির দশা! কোন চিকিৎসায় কাজ দেবে, মাথা চুলকেও রেমিডি খুঁজে পাচ্ছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

More Articles