উদয়ের পথে অভিষেক, মমতা জমানা অস্তাচলে? প্রশ্ন ভাসছে হাওয়ায়
মমতার তৃণমূল কি ক্রমে ঝুঁকে পড়ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দিকে? তৃণমূলে আসতে চলছে বিরাট পরিবর্তন? যদি এমনটা হয়, তাহলে পরিবর্তনের ঢেউয়ে তৃণমূল হয়ে উঠতে পারে নতুন দল।
প্রতিদিন চুরি যায় মূল্যবোধের সোনা,
আমাদের স্বপ্ন, আমাদের চেতনা
কিছুটা মূল্য পেয়ে ভাবি, বুঝি শোধ-বোধ,
ন্যায়-নীতি ত্যাগ করে, মানুষ আপস করে।...
একটা প্রজন্ম সমস্বরে চেঁচিয়ে বলতেই পারে- চোর চোর চোর...। কারণ চুরি গেছে তাদের স্বপ্ন। পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা নয়। সন্তানের চাকরির আশায় সর্বস্ব খুইয়ে নিঃস্ব হয়েছে পরিবারের পর পরিবার। আজকে তারা সোল্লাসে উদ্বাহু নৃত্য করবে এই ভেবে যে, যা গেছে তা ফিরিয়ে দেবে সরকার? সোনার পাথরবাটির মতো কল্পনা হবে না তো?
এই বিতর্কে না গিয়েও কিছু প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। রাজ্য তোলপাড় করে তুলেছে ইডি। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী গ্রেফতার। তাঁর ঘনিষ্ঠর বাড়ি থেকে টাকার পাহাড় উদ্ধার। এরপর ক্রাইসিস ম্যানেজ করতে আসরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি সাংবাদিক বৈঠক করে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দল থেকে অপসারণের কথা ঘোষণা করেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন। সেই সাংবাদিক বৈঠকে উপস্থিত থেকেও কার্যত নীরব শ্রোতার ভূমিকা পালন করেন ফিরহাদ হাকিম, অরূপ বিশ্বাস, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যরা। এখানেই রাজনৈতিক মহল বেশ কিছু প্রশ্ন তুলছে।
আরও পড়ুন: তৃণমূল মানেই কি আর্থিক কেলেঙ্কারি? এক দশকে যা দেখলাম আমরা
১. দিদি কি ক্রমেই একা হচ্ছেন?
২. রাশ কি চলে যাচ্ছে অভিষেকের হাতে?
৩. মুকুল রায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়রা মমতার হাত ধরে যে স্বপ্ন বুনেছিলেন, তা কি অস্তমিত?
৪. এই দুর্নীতির দায় কেন নিচ্ছেন না মমতা?
৫. অভিষেকের হাত ধরে নতুন যুগ আসছে তৃণমূলে?
একা হয়ে পড়ছেন দিদি! পাশ থেকে এক এক করে সরে যাচ্ছেন পুরনো দিনের সঙ্গীরা। মুকুল রায় সরেছিলেন (ফিরলেও আর সেই ফর্মে নেই)। তারপর অস্তাচলে পার্থ চট্টোপাধ্যায়। এখন মমতার পুরনো দিনের সঙ্গীদের তালিকায় রয়েছেন ববি হাকিম ও নিভু নিভু সুব্রত বক্সী। অর্থাৎ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুষ্ঠি ক্রমেই আলগা হচ্ছে, সেখানেই অভিষেক ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছেন?
মুকুল রায় তৃণমূলের জন্মলগ্নের কান্ডারি। তৃণমূলে থাকতে একা হাতে সংগঠন সামলেছেন। এক সময় ছিলেন দলের 'সেকেন্ড ইন কমান্ড’। বিজেপিতে গেলেও তা স্থায়ী হয়নি, ২০২১-এর নির্বাচনের ফলাফলের পর অচিরেই ফিরে আসেন মমতার শিবিরে। কিন্তু এখন আর তাঁকে আগের মতো সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না। ১৯৯৮ সালে দলের আত্মপ্রকাশের সময় লোগো তৈরি হয়েছিল যাঁর হাতে, ২১ বছর পর এই নতুন লোগোর নেপথ্যেও সেই দলনেত্রীর মস্তিষ্ক। তবে এই কাজে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কাছের কয়েকজন। তার মধ্যে যে মুকুল রায়ও ছিলেন, এ আর কী এমন আশ্চর্যের! অর্থাৎ, দলটাকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন মমতার এই ছায়াসঙ্গী। সেই স্বপ্নে গড়া দলে বোধহয় এবার নতুন অধ্যায় সূচিত হতে চলেছে। নতুন অধ্যায় ভালো না খারাপ, তা সময়ই বলবে। তবে একটা কথা পরিষ্কার যে, তৃণমূলে পরিবর্তন আসতে চলেছে।
১৯৯৮ সালে বাংলায় তৃণমূলের উত্থান শুরু হয়। তখন মমতার বিশ্বস্ত সৈনিক ছিলেন মূলত ৩ জন। মুকুল রায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও সুব্রত বক্সী। তিনজনকেই চোখ বুজে ভরসা করতেন মমতা। মুকুল বিজেপি থেকে ফেরার পরেও নিষ্ক্রিয় তৃণমূলে। মমতার বিশ্বস্ত সেই টিমে ক্রমেই ভাঙন হতে শুরু করেছে।
তৃণমূলের মহাসচিব থাকাকালীন অবস্থায় পার্থ চট্টোপাধ্যায় ফেঁসেছেন বড় দুর্নীতিতে (যদিও প্রমাণের অপেক্ষা)। তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর বাড়ি ও ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া গিয়েছে কোটি কোটি টাকা, সোনার গয়না, বিদেশি মুদ্রা। এর সঙ্গে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাম জড়িয়ে গিয়েছে। তিনি এই দায় ঝেড়ে ফেলতে পারছেন না। তৃণমূল ঘাড় থেকে দায় নামাতে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে অপসারণ করেছে। তৃণমূল সরকারের মন্ত্রিসভা থেকেও অপসারিত তিনি। এখন প্রশ্ন হলো, ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলতে শোনা গেছে যে, তিনিই সব কেন্দ্রের প্রার্থী। অর্থাৎ, তিনিই লড়াইয়ের মুখ। তাঁকে সামনে রেখে যে লড়াই হয়েছে, মানুষ তাতে আস্থা রেখে দিদির দলকে জিতিয়েছে। তাহলে এখন এই দুর্নীতির দায় কেন নেবেন না মমতা- বিরোধীরা এই প্রশ্নকে আশ্রয় করে ক্রমশ বাড়াচ্ছে প্রতিবাদের পারদ। তাঁর পদত্যাগ দাবি করছে। ক্রাইসিস ম্যানেজের ভার অভিষেকের হাতে তুলে দেওয়া নিয়েও নানা মহলে শুরু হয়েছে গুঞ্জন।
তৃণমূলের অন্দরে ভিন্ন সমীকরণ তৈরির ইঙ্গিত। মমতার পুরনো সৈনিকরা বিভিন্ন কারণে সাইডলাইনে চলে যাওয়ায় ক্ষমতার বিন্যাসে অভিষেককে অনেকটাই প্রভাবশালী মনে হচ্ছে। দলের 'নম্বর টু’ পার্থ চট্টোপাধ্যায় শিক্ষক নিয়োগ মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে অভিষেককে আরও দায়িত্বশীল মনে হচ্ছে। বেশ কতগুলি ধাপ পেরিয়ে মমতার তৃণমূলে অভিষেক আদতে হয়ে উঠেছেন 'নম্বর টু’। এখন প্রশ্ন, মমতাই তাঁকে জায়গা করে দিচ্ছেন, না কি তিনি জায়গা করে নিচ্ছেন মমতাকে সরিয়ে?
শুধু আজ রাজ্যের এই ডামাডোলের সময় নয়, তিনি অনেক আগে থেকেই উদয়ের পথে। ২০২১-এর বিরাট সাফল্য এসেছে তৃণমূলে। বলাই বাহুল্য, এই কৃতিত্ব মমতার একা নয়, অভিষেকও সাফল্যের অন্যতম কারিগর। তাই নির্বাচনের পরেই দেখা গিয়েছে, অভিষেককে দেওয়া হয়েছে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব। আর এখন তাঁকে দেখা যাচ্ছে রাজ্যের নানা সমস্যায় নিজেকে সামনের সারিতে রাখতে। দল ছাপিয়ে সরকারের ক্রাইসিসও সামলাচ্ছেন। সরকারি বিষয়েও পদক্ষেপ করছেন অভিষেক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দল ও সরকারের সর্বেসর্ব্বা। কিন্তু অভিষেক যেভাবে এসএলএসটি প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বললেন, তাঁদের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলেন, শুধু প্রতিশ্রুতি না দিয়ে তাঁদের চাকরির কথা বললেন, তাতে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করছে, অভিষেক সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছেন। মমতার অঙ্গুলিহেলন ছাড়া কি তিনি এই কাজ করতে পারতেন?
মমতার তৃণমূল কি ক্রমে ঝুঁকে পড়ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দিকে? তৃণমূলে আসতে চলছে বিরাট পরিবর্তন? যদি এমনটা হয়, তাহলে পরিবর্তনের ঢেউয়ে মমতার তৃণমূল হয়ে উঠতে পারে নতুন দল। আশার সঙ্গে কিন্তু জমাট বাঁধছে একরাশ আশঙ্কার মেঘ। কেন?
তৃণমূলে এই বিরাট পরিবর্তনের আবহে বাংলায় বিরোধী দলগুলি মাথাচাড়া দেওয়ার সুযোগ পাবে কি না, এটাই দেখার। বিজেপি ফের ঘুরে দাঁড়ায় না কি, কিংবা সিপিএম ফিরে আসতে পারে কি না- তা সময়ই বলবে। মমতা আড়ালে চলে গেলে কংগ্রেসের পুনর্জন্ম হয় কি না, এই নিয়েও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা টেবিলে থাপ্পড় মেরে আলোচনায় হাওয়া গরম করে তুলছেন।
তবে একটা কথা শেষে বলাই যায়, আগামীর উদয়- লাভ না ক্ষতি- তার তুল্যমূল্য বিচার হবে সময়ের দাঁড়িপাল্লায়। এখন শুধু দেখে যাওয়া, ভবিষ্যতের চাকা কোন দিকে ঘোরে।