তৃণমূল মানেই কি আর্থিক কেলেঙ্কারি? এক দশকে যা দেখলাম আমরা
তৃণমূল জমানার প্রায় শুরুর দিক থেকেই একের পর এক আর্থিক কেলেঙ্কারিতে নাম জড়িয়েছে শাসক দল তৃণমূলের। সারদা, নারদা থেকে টেট কেলেঙ্কারিতে নাম জড়িয়েছে একের একের পর তৃণমূলের হেভিওয়েট নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রীদের।
এসএসসি দুর্নীতি নিয়ে তোলপাড় বঙ্গের রাজ্য রাজনীতি। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকার অভিযোগে কেন্দ্রীয় সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট গ্রেফতার করেছে পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ও বর্তমান শিল্পমন্ত্রী তৃণমূল নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। তৃণমূল জমানার প্রায় শুরুর দিক থেকেই একের পর এক আর্থিক কেলেঙ্কারিতে নাম জড়িয়েছে শাসক দল তৃণমূলের। সারদা, নারদা থেকে টেট কেলেঙ্কারিতে নাম জড়িয়েছে একের একের পর তৃণমূলের হেভিওয়েট নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রীদের। এক নজরে ফিরে দেখা যাক তৃণমূল আমলে হওয়া দুর্নীতিগুলির ইতিহাস।
সারদা কেলেঙ্কারি
বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকাকালীন চিটফান্ডের ব্যবসা শুরু করেন সারদার মালিক সুদীপ্ত সেন। ২০১২ সালে ক্ষমতায় আসার অব্যবহিত পরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে। সেই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রাজ্য সরকারের নির্ধারণ করে দেওয়া নির্দিষ্ট আটটি সংবাদপত্র ছাড়া অন্য কোনও সংবাদপত্র রাখতে পারবে না রাজ্যের সরকারি ও সরকার-পোষিত গ্রন্থাগারগুলি। যে ক'টি সংবাদপত্রকে মনোনীত করা হয়েছিল, তার মধ্যে বেশ কয়েকটি কাগজের মালিক ছিল সারদা গোষ্ঠী। ২০০৯ সাল থেকেই সারদার আর্থিক কর্মকাণ্ডে নজর দেয় সেবি। ২০১১ সালে সদ্য নির্বাচিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে জানানো হয় চিটফান্ডের মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে অর্থ আদায় করছে সারদা। সরকার যাতে অবিলম্বে সারদায় সাধারণ মানুষের আর্থিক বিনিয়োগে স্থগিতাদেশ জারি করে। সেবি-র সতর্কবাণীতে সেদিন কর্ণপাত করেনি সরকার। রমরমিয়ে চলতে থাকে সারদার ব্যবসা। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি এক কোটি টাকায় কেনেন সারদার মালিক সুদীপ্ত সেন। ‘সারদা’ গোষ্ঠীকে ব্র্যান্ড হিসেবে তুলে ধরতে সাহায্য করে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস সরকার। সারদার ব্র্যান্ড আম্বাসাডর করা হয় তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায়কে। মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হন তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ মিঠুন চক্রবর্তী। সারদা মিডিয়া গোষ্ঠীর সিইও করা হয় কুণাল ঘোষকে। তিনি প্রত্যেক মাসে প্রায় ১৬ লক্ষ টাকা বেতন পেতেন। আরেক তৃণমূলের হেভিওয়েট নেতা মদন মিত্র পরিবহণ মন্ত্রী থাকাকালীন সারদার কর্মী ইউনিয়নের মাথা ছিলেন। এসব ছাড়াও কলকাতা পুলিশকে অত্যাধুনিক বাইক, রাজ্যের মাওবাদী-উপদ্রুত অঞ্চলে অ্যাম্বুল্যান্স ও বাইক প্রদান করে সারদা গোষ্ঠী। ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল সিবিআই-কে ব্ল্যাকমেলিং-এর অভিযোগ জানিয়ে চিঠি লেখেন স্বয়ং সারদার মালিক সুদীপ্ত সেন। তাতে তিনি দাবি করেন বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতাকে তিনি মোটা অঙ্কের আর্থিক সহায়তা করেছেন।তদন্ত শুরু করে সিবিআই। সারদা কেলেঙ্কারিতে গ্রেপ্তার হন তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সৃঞ্জয় বোস, পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র ও তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ। পরবর্তীকালে সারদা কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িয়ে থাকার অভিযোগে প্রেপ্তার হন তৃণমূল সাংসদ তাপস পাল, মুকুল রায়। জেরার সম্মুখীন হন তৃণমূল যুব কংগ্রেসের তৎকালীন প্রধান শঙ্কুদেব পন্ডা, রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি রজত মজুমদার।
আরও পড়ুন: শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতিই নীতি! এক দশকে ধ্বংস হল সরকারি চাকরির স্বপ্ন
নারদা কেলেঙ্কারি
২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগেই নারদা স্টিং অপারেশনের ভিডিও ফাঁস হতেই উত্তাল হয় বঙ্গ-রাজনীতি। সাংবাদিক ম্যাথু স্যামুয়েলের স্টিং অপারেশনের ভিডিওতে দেখা যায় একাধিক তৃণমূল নেতা ও মন্ত্রী মোটা অঙ্কের ঘুষ নিচ্ছেন। নারদা স্টিং অপারেশনে ঘুষ নিতে দেখা গিয়েছিল প্রাক্তন তৃণমূল হেভিওয়েট নেতা মুকুল রায়, তৎকালীন সরকারের পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সাংসদ সুলতান আহমেদ, সৌগত রায়, শুভেন্দু অধিকারী, কাকলি ঘোষ দস্তিদার, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, তৎকালীন কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়, মদন মিত্র এবং বর্তমান পুর ও নগরন্নোয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে। নারদার ফুটেজ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলেও ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল জয়লাভ করে তৃণমূল। ২০২১ সালের ১৭ মার্চ নারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় কলকাতা হাই কোর্ট। কলকাতা হাই কোর্টের রায়ে স্থগিতাদেশ দাবি করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে রাজ্য সরকার। রাজ্য সরকাররের আবেদন নাকচ করে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ বহাল রাখে শীর্ষ আদালত। ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে ফের জয়লাভ করে তৃণমূল। সরকার গঠনের পরে পরেই তৃণমূলের তিন হেভিওয়েট নেতা ও রাজ্যের দুই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত মুখোপাধ্যায় ও মদন মিত্রকে। গ্রেফতারির প্রতিবাদে নিজাম প্যালেসে সিবিআইয়ের দফতরের সামনে ধরনায় বসেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
টেট দুর্নীতি
২০১৪ সালের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে নাম জড়ায় শাসক দল তৃণমূলের। টেট দুর্নীতিতে বেআইনি নিয়োগ ও অর্থের বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ২০১৪ সালের টেটে ২৭৩ জনকে বাড়তি এক নম্বর দেওয়া নিয়ে হাই কোর্টে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চে ভর্ৎসনার মুখে পড়ে রাজ্য সরকার। টেট মামলার তদন্তর ভার দেওয়া হয় সিবিআইকে। এছাড়াও ২০১৪ সালের নিয়োগ হওয়া ২৬৯ জনকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার নির্দেশ দেয় কলকাতা হাই কোর্ট। এমনকী, টেট দুর্নীতির ক্ষেত্রে নিয়োগের জন্য তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অনুমতিতে যে প্যানেল তৈরি হয়েছিল, তাও বেআইনি বলে ঘোষণা করে কলকাতা হাই কোর্ট। দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার অপরাধে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি ও সচিবকে অপসারিত করার নির্দেশ দেয় কোর্ট। সিবিআই তদন্তভার গ্রহণ করলে ম্যারাথন জেরা করা হয় পর্ষদ সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যকে।
স্কুল সার্ভিস কমিশন দুর্নীতি
এসএসসি দুর্নীতি নিয়ে ফের আরেকবার অভিযোগের তির ওঠে তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে। কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে এসএসসির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিভিন্ন কর্তা ব্যাক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার সুপারিশ করে আদালত নির্ধারিত বাগ কমিটি। কমিটির আশি পাতার সুপারিশে এসএসসি কেলেঙ্কারিতে জড়িত হিসেবে এসএসসি-র প্রাক্তন উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিংহ, এসএসসি-র প্রোগ্রামিং অফিসার সমরজিৎ আচার্য, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায় ও চেয়ারম্যান সৌমিত্র সরকারের নাম উল্লেখ করা হয়। রিপোর্টের একেবারে শেষের দিকে এসএসসি দুর্নীতিতে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখ করা হয়। এরপরই সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত। বেআইনিভাবে চাকরি পাওয়ার জন্য চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয় মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীকে। এরপরই এসএসসি দুর্নীতিতে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে পৃথক তদন্ত শুরু করে ইডি। সেই তদন্তে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে প্রায় ২০ কোটি টাকা উদ্ধার করে ইডি। গ্রেফতার করা হয় অর্পিতা মুখোপাধ্যায়কে। সিবিআই জেরার মুখোমুখি হন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও। দুর্নীতিতে সহযোগিতা করার অভিযোগে ২৩ জুলাই পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করে সিবিআই।