বিনোদনের রাজনীতি || শুধু ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ নয়, প্রোপাগান্ডা ছবিতে উপচে পড়ছে বলিউড

যা ছিল কুয়াশায় মোড়া, এখন তা গনগনে আগুন হয়ে জ্বলছে। বিগত কয়েক বছরে হিন্দি ভাষায় তৈরি প্রপাগান্ডা ছবির হিসেব কষতে গিয়ে এ ছাড়া কোনও বাক্যবন্ধই উপযুক্ত মনে হল না। গত কয়েক স্থানে-অস্থানে প্রোপাগান্ডা কথাটির উল্লেখ মিলেছে, সোজা বাংলায় যার অর্থ হল প্রচারমূলক কীর্তি। অর্থাৎ ছোটবেলায় রাস্তার পাশের দেওয়ালে, চলতি-ফিরতি পুস্তিকায় যেমন রাজনৈতিক দলের কাজের ফিরিস্তি লেখা থাকত, এখন তা রূপোলি পর্দার মোড়কে মুড়ে ঢেলে দেওয়া দর্শকের পাতে (Propaganda Movies)। গাঁটের কড়ি খরচ করে টিকিট কিনে, পপকর্ন-কোল্ডড্রিঙ্ক সহযোগে তা চেটেপুটে নিচ্ছেন দর্শক। এমনই শাহি আয়োজন যে দু’দণ্ড ইতিহাস ঘেঁটে সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের গরজও নেই।

হিন্দি ভাষায় (Bollywood Movies) প্রচারধর্মী ছবি কি আগে হয়নি। আলবাত হয়েছে। ‘মাদার ইন্ডিয়া’ থেকে ‘বর্ডার’, ‘এলওসি কার্গিল’ থেকে ‘গদর: এক প্রেম কথা’, ‘হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ থা, হ্যায় অউর হমেশা রহেগা’ শুনে হলভর্তি দর্শক আগেও হাততালি দিয়েছেন। কিন্তু ইদানীি যে সব ছবি ঘিরে তোলপাড় হচ্ছে গোটা দেশ, তাতে দেশ ও দশের প্রতি দায়বদ্ধতার থেকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের গুণগানই চোখে পড়ছে। অতিমারি, মূল্যবৃদ্ধির চোখরাঙানির মধ্যেও ২০০ কোটি পার করে ফেলা ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ (The Kashmir Files) নিয়ে যখন দিকে দিকে চর্চা, দেখে নেওয়া যাক বিগত কয়েক বছরের রাজনৈতিক প্রচারমূলক ছবিগুলি।

দ্য কাশ্মীর ফাইলস: শুরুতেই উল্লেখ রয়েছে। বাস্তব এবং কল্পনার রূপোলি রেখার ফারাক যে তিনি মানেন না, তা ঢের আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী। ছবিতে তাই বাস্তব এবং কল্পনার মধ্যে কোনও সীমারেখাই টানেননি তিনি। বরং অর্ধসত্যের মধ্যে গুলে দেওয়া হয়েছে অপপ্রচার, ঘৃণা, বিদ্বেষের নির্যাস। এমনকি কাশ্মীরের জটিল, বিতর্কিত ইতিহাসকেও তিনি হিন্দু-মুসলিম সমান্তরালে নামিয়ে এনেছেন। তাই মুসলিমদের হাতে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের খুন হওয়া, গৃহত্যাগী হওয়াকে দেখালেও, উপত্যকার বিচ্ছিন্নতাকামী উগ্রপন্থী শক্তির হাতে দ্বিগুণ সংখ্যক মুসলিম বাসিন্দাদের প্রাণহানির উল্লেখ নেই।

খোদ নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহের মুখে ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’-এর কথা উঠে এসেছে। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের দুর্দশার জন্য সরাসরি কংগ্রেসকে দায়ী করেছেন তাঁরা। কিন্তু কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপত্যকা থেকে প্রস্থানের সময় কেন্দ্রে বিজেপি সমর্থিত সরকার এবং জম্মু-কাশ্মীরে বিজেপি-র রাজ্যপালের ভূমিকার কোনও উল্লেখ নেই। একই ভাবে ২০১৪ সালে নির্বাচনী ইস্তেহারে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপত্যকায় ফেরানোর প্রতিশ্রুতি উল্লেখ থাকলেও, আজও যে তা অপূর্ণ থেকে গিয়েছে, তা নিয়ে আলোচনার অবকাশই নেই। আর তাই এই ছবিকে হাতিয়ার করেই বিজেপি ২০২৪-এর লড়াইয়ের সলতে পাকানো শুরু করে দিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। যদিও রাখঢাক করেননি বিবেকও। সাফ জানিয়েছেন, তাঁর নিজের অ্যাজেন্ডা আছে। কাজের মধ্যে তা প্রতিফলিত হওয়াটা স্বাভাবিক বলেই হয়ত বোঝাতে চেয়েছেন পরিচালক।

দ্য অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার: দ্বিতীয় দফায় দিল্লির মসনতে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। তার আগে মুক্তি পায় ‘দ্য অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আত্মজীবনীর উপর নির্ভর করে তৈরি, যা লিখেছিলেন তাঁরই প্রাক্তন মিডিয়া উপদেষ্টা সঞ্জয় বারু। ছবিতে মুখ্য চরিত্রে ছিলেন অনুপম খের (ঘোষিত ভাবেই নরেন্দ্র মোদির সমর্থক) এবং প্রকাশ্যে রাজনৈতিক মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকা অক্ষয় খান্না। শাসকদলের রাজনৈতিক অভিসন্ধি পূর্ণ করতেই ছবিটির নির্মাণ বলে শুরু থেকেই অভিযোগ ওঠে। মিতভাষী এবং মৃদুভাষী মনমোহনকে অনুকরণের নামে অনুপম রীতিমতো তাঁকে উপহাসের পাত্র করেছেন বলেও অভিযোগ সামনে আসে। গান্ধী পরিবারের হাতের পুতুল হিসেবে তাঁকে দেখানো হয়, যা বিজেপি-র কাছে কংগ্রেসকে আক্রমণের মূল হাতিয়ার। ছবির নির্মাতা বিজয় গুট্টে বিজেপি নেতা রত্নাকর গুট্টের ছেলে। জিএসটি জালিয়াতিকাণ্ডে গ্রেফতারও হন। নাম ভূমিকায় থাকা অনুপম খেরের স্ত্রী কিরণ খের বিজেপি-র সাংসদ।

ঠাকরে: ২০১৯ সালের ২৫ জানুয়ারি, বাল ঠাকরের ৯৩তম জন্মবার্ষিকীর উদযাপনের ঠিক পরেই মুক্তি পায় ছবিটি। নাম ভূমিকায় ছিলেন নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি। আর সেই বছরই নভেম্বর আসে নভেম্বর  মাসে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন উদ্ধব ঠাকরে। ছবিতে হিন্দুত্ববাদী নেতার পরিবর্তে বাল ঠাকরেকে মহারাষ্ট্রবাদী বিপ্লবী, সমাজকর্মী এবং যোদ্ধা হিসেবে দেখানো হয়। এমনকি দক্ষিণ ভারতীয়দের নিয়ে বাল ঠাকরের বিতর্কিত মন্তব্যকেও উল্টে দেওয়া হয়। ছবিতে নওয়াজউদ্দিন নজর কাড়লেও, গোড়া থেকেই ছবিটির অভিসন্ধি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ছবিতে বাল ঠাকরের ভাইপো রাজ ঠাকরে ভয়েস ওভারও দেন। আবার ছবির প্রযোজকও ছিলেন তিনি।

দ্য তাসখন্ত ফাইলস: ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’-এর আগে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু নিয়ে ছবিটি তৈরি করেন বিবেক অগ্নিহোত্রী। বিদেশ-বিভুঁইয়ে শাস্ত্রীর মৃত্যু এবং তার পিছনের ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে খাড়া করেন তিনি। মিঠুন চক্রবর্তী এবং নাসিরুদ্দিন শাহ ছবিতে অভিনয় করেন। কিন্তু শাস্ত্রীর পরিবারের তরফেই আইনি নোটিস ধরানো হয় পরিচালককে। বিশেষ একটি দলের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে ছবিটি তৈরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। বক্সঅফিসে সাফল্যের মুখও দেখেনি ছবিটি।

উরি: কম বাজেটের ছবিতে সে ভাবে হালে পানি পাচ্ছিলেন না অভিনেতা ভিকি কৌশল। কিন্তু ২০১৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘উরি’ তাঁর কেরিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ২০১৬ সালে উরি-তে ভারতীয় সেনার শিবিরে জঙ্গি হামলার প্রতিশোধ নিতে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালানোর আখ্যান তুলে ধরা হয় ছবিতে। ছবির সংলাপ ‘হাউ ইজ দ্য জোশ’ মুখে মুখে ফেরে বিজেপি-র নির্বাচনী প্রচারে। শুধু তাই নয়, ছবির বিশেষ কিছু সংলাপ যেমন, ‘ইয়ে নয়া হিন্দুস্তান হ্যায়, ইয়ে ঘর মে ঘুসেগা ভি, অউর মারেগা ভি’, ‘ওয়ক্ত আ গয়া হ্যায়, খুন কা বদলা খুন সে লেনে কা’-র মাধ্যমে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারে অবস্থানকেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে, নির্বাচনী প্রচারে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রসঙ্গ তুলে ওই একই সুরে প্রচার করতে দেখা যায় বিজেপি নেতাদের।

পিএম মোদি: বাবা সুরেশ ওবেরয় বিজেপি-র সদস্য। ২০১৪ সালে বিজেপি-র হয়ে প্রচারে দেখা যায় ছেলে বিবেক ওবেরয়কে। নরেন্দ্র মোদির শপথগ্রহণেও আমন্ত্রিত ছিলেন। ২০১৯-এর ২৩ মে বিপুল ভোটে জয়ী হয় বিজেপি।  দ্বিতীয় বারের জন্য মসনদে বসার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন মোদি। আর তার পর দিনই দেশ জুড়ে মুক্তি পায় উমঙ্গ কুমার পরিচালিত ‘পিএম নরেন্দ্র মোদি’। ২০০২ সালের গুজরাত দাঙ্গায় মোদিকে ক্লিনচিট দেওয়ার অভিযোগ ওঠে পরিচালকের বিরুদ্ধে। তবে ছবিটি সাফল্য পায়নি। বিবেকের অভিনয়ও তীব্র সমালোচিত হয়।

কম্যান্ডো ২: ২০১৬-র নভেম্বরে আচমকাই নোটবন্দির ঘোষণা করে কেন্দ্র। ২০১৭-র ৩ মার্চ মুক্তি পায় ‘কম্যান্ডো ২’। নিজের পেশায় দক্ষ, খালিহাতে শত্রুকে কুপোকাত করার ক্ষমতা রাখা কম্যান্ডোর চরিত্রে ছিলেন বিদ্যুৎ জামওয়াল, দেশের প্রধানমন্ত্রীর কালোটাকা নির্মূলের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার ভার যার কাঁধে পড়ে। ছবিটি মু্ক্তির আগে নরেন্দ্র মোদিকে দেখাতে চেয়েছিলেন পরিচালক দেবেন ভোজানি। এমনকি মোদির নোটবন্দি ভাষণ শুনেই ছবির গল্প মাথায় আসে বলে জানান তিনি।

ইন্দু সরকার: ইন্দিরা গাঁধীর আমলের জরুরি অবস্থার প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে ছবিতে। ছবিতে ইন্দিরা এবং তাঁর ছেলে সঞ্জয় গাঁধীকে খলনায়ক হিসেবে তুলে ধরা হয় বলে অভিযোগ। ছবিতে যদিও ইন্দিরা এবং সঞ্জয়ের নামের উল্লেখ ছিল না, কিন্তু দুইয়ে দুইয়ে চার করে নিতে অসুবিধা হয়নি কারও। শোনা যায়, সেই সময় বিজেপি-তে যোগদানের কথা চলছিল পরিচালক মধুর ভান্ডারকরের। বিজেপি-র হেভিওয়েট নেতারা ছবিতে টাকাও ঢেলেছিলেন বলে সামেন আসে। যদিও তা স্বীকার করেননি মধুর।

অ্যান ইনসিগনিফিকেন্ট ম্যান: প্রথম দফায় দেড় মাসের মাথায় মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ায় বিদ্রূপের মুখে পড়তে হয়েছিল অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে। দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পরই মুক্তি পায় ‘অ্যান ইনসিগনিফিকেন্ট ম্যান’। পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি নয়, তথ্যচিত্রের আদলে তৈরি কেজরিওয়াল আখ্যান। সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে কী ভাবে দিল্লির মসনদে তিনি আসীন হলেন, তা-ই তুলে ধরা হয়। ছবিটি সমালোচকদের প্রশংসাও পায়, আবার ব্যবসায়িক ভাবে সফলও হয়।

প্রকাশ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে সওয়াল করা থেকে, নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ‘অরাজনৈতিক সাক্ষাৎকার’, বার বার সরকারের ‘পোস্টার বয়’ তকমা গায়ের সঙ্গে সেঁটে গিয়েছে অক্ষয় কুমারের। বেছে বেছে ‘টয়লেট: এক প্রেম কথা’, ‘মিশন মঙ্গল’, ‘বেল বটম’-এর মতো ছবিতে অভিনয়ের জন্যও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে তাঁকে। তবে সমালোচকদের একাংশের মতে, অক্ষয়ের ছবিতে বর্তমান সরকারের গুণগান করা হলেও, তাতে চতুরতা থাকে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, রাখঢাক বলে আর কিছু থাকছে না। বরং বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার মিশেলকে ধ্রুব সত্য বলে চালানোর প্রচলন শুরু হয়েছে, যার প্রমাণ ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’।

More Articles