উচ্চকিত গডসেপুজোর এই উপত্যকা আমাদের ভারতবর্ষ নয়

গান্ধীকে গালাগালি করা বর্তমানের খুব জনপ্রিয় ট্রেন্ড। মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় আকছার তা করে থাকেন। অথচ কয়েক দশক আগেও এই প্রকাশ্য ঘৃণা ছড়ানোর রেওয়াজ খুব একটা চোখে পড়ত না। খুব সুচারুভাবে দ্রুত সমাজ-সংস্কার থেকে স্বাধীন ভারত গঠনে গান্ধীর ভূমিকা, গুরুত্ব ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয় আজকে ‘দেশভক্ত’ বলে যারা সগর্বে নিজেদের জাহির করে, তাদের চোখে গান্ধী এতটাই ঘৃণ্য যে প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটা একটি রাজনৈতিক হত্যা হয়ে ওঠে অত্যন্ত 'প্রয়োজনীয়'। আখ্যান নির্মাণের এমনই বহর, তাতে গডসের মতো খুনীকেও মহিমান্বিত করে এই নতুন ‘দেশে’র ‘মহৎ প্রাণে’ পরিণত করে।

৩০শে জানুয়ারি ১৯৪৮। গান্ধীকে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে গডসে। হাজারো প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের মাঝে সেখানেই গ্রেফতার করা হয় তাকে। একদম পরিকল্পনা মাফিক ছকে ফেলা খুন। কোর্টে নিজের অপরাধ স্বীকারও করে নিয়েছিল গডসে। এমনকি সে এও বলেছিল, “আইনি পথে একে (গান্ধীকে) রাস্তায় আনা সম্ভব ছিল না। তাই গুলি করেছিলাম।” এই মতাদর্শে সেদিন যদি বিশ্বাস করতেন আজকের মত হাজার হাজার মানুষ, গডসেও খুন হতেন রাস্তায়। তবে সেদিন মানুষ তুলনামূলক ভাবে সহিষ্ণু, নিজেদের প্রচুর ত্যাগের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনা গণতন্ত্রের প্রতি তাঁরা ছিলেন আস্থাশীল। হিয়ারিঙ্গের দ্বিতীয়দিনে গডসে নিজেও স্বীকার করেছিল যে, জাতির জনকের খুনীর সঙ্গে এতখানি ভদ্রতা সে আশা করেনি।

এরপরে শুরু হয় সেই ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্র। সমগ্র বিচারব্যবস্থাকেই নিজের ঘৃণার প্রচারমাধ্যম হিসেবে কাজে লাগিয়েছিল গডসে। ১৯৪৮ সালের ৮ নভেম্বর তাকে নিজের পক্ষে সওয়ালের অনুমতি দেওয়া হয়। অনুমতি পেয়ে হাতে লেখা ৯২ পাতার একটি বক্তব্য রাখে নাথুরাম। পাঞ্জাব হাইকোর্টে তিনজন জজের বেঞ্চের মধ্যে কেবলমাত্র একজন মাত্র এই বক্তব্যের সরকারি লিপিবদ্ধকরণের বিপক্ষে বলেছিলেন। জাস্টিস খোসলা। কারণ খুনের অপরাধ মাফ হয় না। তবু বাকি দুজন জজের আগ্রহে তাকে বলতে দেওয়া হয় এবং বারংবার গান্ধীহত্যাকে ‘আদর্শ’ দিয়ে প্রয়োজন বলে ঘোষণা করে সেই খুনি। জজ আত্ম চরণ যে গডসে ঘন্টা নয়েক ধরে বলতে দিলেন, বিশেষজ্ঞরা এতেই মনে করে থাকেন সে সময়, গান্ধীর খুনিদের আদর্শগত প্রভাব বিচারকদের ওপরেও নেহাত কম ছিল না।

বিচার চলাকালীন একবারও গডসের দিকে তাকাননি সাভারকর। কিন্তু গডসের বয়ানের বহু ‘ফাইনাল টাচ’ যে তারই অবদান তা সন্দেহ করার অবকাশ থাকে, যখন আমরা জানি এর আগেও এমন কাজ করেছেন সাভারকর মদনলাল ধিংড়া সম্বন্ধে। বস্তুত এ বিষয়ে গডসে মিথ্যা বলেছিল বলেই মনে করে থাকেন বিশেষজ্ঞরা, যেমন মিথ্যার বয়ানের সাহায্যে গডসে অস্বীকার করে গান্ধীর খুনের পিছনে আর এস এসের গভীর ষড়যন্ত্রটিও। মারাঠি পত্রিকা পাইঞ্জনে বক্তব্যটি ছাপা হয়। এই বয়ানটিকে প্রথম্বই করে বের করবেন গোপাল গডসে। সেই বই প্রথমে ব্যান হলেও পরে ব্যান উঠিয়ে নেয় হাইকোর্ট ১৯৮৯ সালে। আবারও রমরমিয়ে বাড়ে বিক্রি। আজকের এই ঘৃণার ঝড়ের জন্য সেদিনের এই মৃদু বাতাসটি অনেকাংশে দায়ী। দায়ী মিথ্যায় ও সাভারকরে ভেজান খুনির বয়ানটিও।

বর্তমানে বইটির যে সব কপি ‘জনপ্রিয়’ হোয়াটস্‌অ্যাপ ইউনিভার্সিটির মাধ্যমে, তার বেশির ভাগই আই এস বি এন নম্বর ও প্রকাশকের নাম ঠিকানা ছাড়া। এই বইগুলিকে আরো ক্ষতিকর ও দাঙ্গাকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন আশোক কুমার পাণ্ডে। এই শিকড় ছাঁটা মিথ ঘৃণা ছড়ানোর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে দেখা গিয়েছে বারবার। বর্তমানে ট্যুইটার এমন একটি মাধ্যম। ফাইভজিরও দোরগোড়ায় আমরা। এই ট্যুইটারে তথ্য পালটা বিকৃত তথ্যের লড়াইকে ফিফথ্‌ জেনারেশন ওয়ারফেয়ার বা যুদ্ধপদ্ধতি বলা হয়ে থাকে। অদূর অতীতেও বারবার ট্যুইটারকে হেটস্পিচ ও চরমপন্থী মতাদর্শের প্রচারে ব্যবহার করা হয়েছে সম্পূর্ণ ভাবে। দেখতে সেই ছিন্নমূল বইগুলির সঙ্গে এর মিলও রয়েছে। ট্যুইটারেও সম্পূর্ণ বেনামে পরিচয় ফাঁসের সম্ভাবনা ছাড়াই মানুষকে উত্যক্ত করা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে আরো একধাপ এগিয়ে সরাসরি নির্দিষ্ট মানুষ বা জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে ধর্ষণের হুমকি থেকে খুনের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া যায়। এর বিরুদ্ধে তেমন ব্যবস্থাও কিছু নেওয়া যায় না।

হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ডিং-এর যুগে বোঝাই যায় কিছু নির্দিষ্ট বিষয়কে জনপ্রিয় করার পিছনে বড় বড় গোষ্ঠীর দিনরাত এক করা পরিশ্রম থাকে। তেমনই একটি ঘটনা পরিলক্ষিত হল গত ৩০শে জানুয়ারিতে। গান্ধীর মৃত্যুদিনে গডসেকৃত খুন এবং গডসেপন্থীদের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে গান্ধীর শ্রদ্ধার্ঘ্যে একটি ট্যুইট করে কংগ্রেস। সেখানে ‘গান্ধীফরেভার’ নামে একটি হ্যাশট্যাগ দেওয়া হয় ও তাকে ট্রেণ্ড করাবার চেষ্টা হয় দলের তরফ থেকে। গান্ধীর মৃত্যুদিনে সেইটিই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু দেখা যায়, তার কিছুক্ষণ পরেই ‘নাথুরাম গডসে জিন্দাবাদ’ নামের একটি হ্যাশট্যাগ ভেসে ওসে ট্যুইটারে এবং খুব পরিকল্পিত ভাবে তাকে ট্রেণ্ড করান হতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হিন্দিভাষাতেও দেখা যায় হ্যাশট্যাগটি। বোঝাই যায় কাদের উদ্দেশ্য করে এই ঘটনা ঘটান হয়। কেউ কেউ গডসে যে বন্দুকটি দিয়ে গান্ধীকে হত্যা করেছিলেন সেটির ছবি ট্যুইটারে দিয়ে সেটির নিলাম করার কথা বলেন। কারণ সেটি নাকি ‘মহার্ঘ্য’। কেউ কেউ গান্ধীকে হিটলারের সঙ্গেও তুলনা করেছেন। আরএসএস দীর্ঘদিন হিটলারকে তাদের নায়ক ভেবে এসেছে।  ট্যুইটটিতে দেখা যাচ্ছে একটি চিঠি, যাতে নাকি গান্ধী হিটলারকে ‘বন্ধু’ বলে সম্বোধন করছেন। ট্যুইটের বক্তব্য দুজনেই মানুষ খুন করেছেন, একজন অস্ত্রের মাধ্যমে, অপরে নীরব থেকে। আদতে গান্ধী কিন্তু চিঠি লিখে হিটলারের কড়া আওমালোচনা করেছিলেন ও মানুষ খুন বন্ধ করতে বলেছিলেন। এমনও দাবি করা হয়েছে আম্বেদকর নাকি মুসলিমবিদ্বেষী ছিলেন। মজার ব্যাপার ‘হিন্দুত্ব’ বা ‘হিন্দু রাজ’ মোটেই পছন্দ করতেন না আম্বেদকর।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এইসব ট্যুইট ইত্যাদি নিরীহ, উপর দিকে থুতু ফেলা। কিন্তু আদতে তা নয়। দীর্ঘদিনের মিথ্যাজপ, ঘৃণার আগুনে ঝলসে পুড়িয়ে বিকৃত করা হচ্ছে ইতিহাস। কেটে ফেলা শিকড়। শিকড় কাটা তথ্যকে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে জোর বাতাসে। নতুন বিকৃত ঘৃণার দৃষ্টিভঙ্গী জুড়ে দেওয়া হছে তাতে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতাকে অস্বীকার করে কিছু ঘৃণার ক্ষেত্র নির্মিত হচ্ছে। এ বড়ই ভয়ঙ্কর ব্যাপার। গান্ধীর মতো ব্যক্তিত্বর খুনকে জায়েজ বলা হচ্ছে, পোস্ট করা হচ্ছে ভারতের বিকৃত ম্যাপ। কারণ, দেশভাগের জন্যে নাকি দায়ী গান্ধীই, গান্ধী খুন না হলে ভারতের ঐ বিকৃত রূপ হত বলে দাবি করা হচ্ছে। ইতিহাস বদলে দিলে মিথ্যায় সত্যির খাদ মিশিয়ে যে উন্মাদনা গড়ে তোলা সম্ভব–সে কথা হাড়ে মজ্জায় বুঝে গিয়েছে দাঙ্গাকারীর দল।

তথ্যঋণ–

 

D’Souza, R., 2022. Glorifying Nathuram Godse | Madras Courier. 

Pandey, A.K., n.d. Gandhi assassination: Why Nathuram Godse was allowed to read his hate-filled accusations in court [WWW Document]. Scroll.in.

More Articles