‘গিরগিটি’র বিরুদ্ধে ভাইঝির জন্য ভোটপ্রার্থনা নাসিরের, সায়রা কি অক্সিজেন জোগাতে পারবেন লাল শিবিরকে!

রাস্তার মোড়ে মোড়ে চাঁদা সংগ্রহের দিন ফুরিয়েছে। কর্পোরেট অনুদানেই এখন চলে বেশির ভাগ দল। সেই নিরিখে ব্যবসা সচেতন রাজনীতিতে এখনও লম্বা রাস্তা পেরোতে হবে বাম শিবিরকে। কলকাতার অন্যতম অভিজাত এলাকা বালিগঞ্জ (Ballygunje By Election) থেকেই বোধহয় সেই পথে পা রাখল লাল শিবির (CPM)। তরুণ কমরেড বা চাল চিবনো ভঙ্গিতে আদর্শের বুলি কপচানো হেভিওয়েট নেতা নন, উপনির্বাচনে সেখানে তাদের তুরুপের তাস সায়রা শাহ হালিম (Saira Shah Halim)। আর কর্পোরেট সংস্কৃতি হোক বা রাজনীতিতে গ্ল্যামারের মিশেল, সায়রার হাত ধরেই নতুনত্বের স্বাদ পেল বামেরা।

সিপিএম নেতা ফুয়াদ হালিমের স্ত্রী সায়রা। সেই ফুয়াদ হালিম, যিনি করোনা কালে ৫০ টাকায় ডায়লিসিস পরিষেবা চালু করে অসংখ্য মানুষের পরিত্রাতা হয়ে উঠেছিলেন। বিধানসভা নির্বাচনেই ফুয়াদকে বালিগঞ্জে দাঁড়ি করিয়ে দিয়েছিলেন সিপিএম নেতৃত্ব। কিন্তু সমাজসেবার সুখ্যাতি কাজে আসেনি ফুয়াদের। ৪০ হাজার ভোট পেয়ে তৃণমূল থেকে বিজয়ী সুব্রত মুখোপাধ্যায় তো বটেই, বিজেপি-র লোকনাথ চট্টোপাধ্যায়ের প্রাপ্ত পাঁচ হাজার ভোটও ছুঁতে পারেননি ফুয়াদ। উপনির্বাচনে এ বার তাঁর স্ত্রী সায়রার ঘাড়েই গুরুদায়িত্ব সঁপেছে সিপিএম।

সায়রার বাবা জমিরুদ্দিন শাহ ভারতীয় সেনার লেফটেন্যান্ট জেনারেল ছিলে। পরবর্তী কালে সৌদি আরবে ভারতীয় কূটনীতিক হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। কলকাতা-সহ দেশের বিবিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরেই কেটেছে সায়রার। উটির লরেন্স স্কুল থেকে সোজা রিয়াধের পড়াশোনা তাঁর। রাজস্থানের আজমেরে কেটেছে কলেজ জীবন। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন। কলকাতা-সহ দেশের বিভিন্ন শহরে নামীদামি বহুজাতিক সংস্থার প্রশাসনিক বিভাগ সামলেছেন। উচ্চ বেতনের সেই চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে পদার্পণ করলেন। এর আগে, স্বামীর হয়ে প্রচারও করেছেন।

সায়রার আগমনে তাই বালিগঞ্জ নিয়ে একটু হলে উজ্জীবিত বোধ করছে সিপিএম। কারণ নিজেকে সর্বহারা শ্রেণির উদ্ধারকারিণী হিসেবে তুলে ধরার কোনও দায়বদ্ধতা নেই তাঁর। বরং পারিবারিক ঐতিহ্য, উচ্চশিক্ষার দৌলতে বালিগঞ্জের অভিজাত মহলের মধ্যমণি হয়ে ওঠা এবং একই সঙ্গে কর্পোরেট অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ওস্তাগর লেনের অলিগলি মেপে নেওয়া—দুই কাজই সমান্তরাল ভাবে চালিয়ে যেতে পারেন তিনি। প্রার্থী হওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত দুই ক্ষেত্রে ভারসাম্য রেখেই চলছেন সায়রা। ৬০ নম্বর ওয়ার্ডে টাইম কলের লাইনেও ঢুকে পড়েছেন অবলীলায়। আবার ব্যক্তিগত সম্পর্ক জাহির না করেই প্রখ্যাত তারকা-শিল্পীকে দিয়ে যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করেছেন বালিগঞ্জের অভিজাত মহলের সঙ্গে।

সায়রার কাকা নাসিরুদ্দন শাহ (Naseeruddin Shah) এবং কাকিমা রত্না পাঠক শাহ (Ratna Pathak Shah) সরাসরি ভাইঝির জন্য ভোটপ্রার্থনা করেছেন। আর তা করতে গিয়ে কোনও রাখঢাক করেননি নাসির। বরং ঠোঁটকাটা তকমাকে সার্থক করে তাঁর সাফ বার্তা, তিনি কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য নন। কিন্তু বালিগঞ্জবাসীর সামনে দু’টি রাস্তা খোলা, হয় সংবেদনশীল, সহমর্মী এবং দায়িত্ববোধসম্পন্ন কাউকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে বেছে নিতে হবে তাঁদের। নয়ত রঙ বদলানো, সুযোগসন্ধানী কাউকে বেছে নেবেন, ধারাবাহিক ভাবে বিদ্বেষ ছড়ানোর নজির রয়েছে যাঁর। রত্নারও সাফ বক্তব্য, অতীতে খুঁড়ে লাভ নেই, ভবিষ্যতের জন্য সায়রা ছাড়া উপায় নেই।

বাংলা নাট্য সমাজের গুটিকয়েক মুখ ছাড়া, হালফিলে বামেদের জন্য এ ভাবে তদ্বির করতে দেখা যায়নি কাউকেই। তাতেই আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছেন সায়রা, যা বাকি দুই প্রতিদ্বন্দ্বী, তৃণমূলের  (TMC)বাবুল সুপ্রিয় (Babul Supriyo) এবং বিজেপি-র (BJP) কেয়া ঘোষের (Keya Ghosh) থেকে দৌড়ে এগিয়ে দিয়েছে অনেকটাই। কারণ নাম না করলেও, নাসির কার রঙ বদলানোর কথা বলেছেন, তা বুঝতে বাকি নেই কারও। তাই গেরুয়া শিবিরে থাকাকালীন একাধিকবার সীমারেখা অতিক্রম করলেও, প্রকাশ্যে নাসিরের প্রতি সম্ভ্রম বজায় রাখতে হয়েছে বাবুলকেও। ভাইঝির জন্য এগিয়ে আসা নাসিরকে তিনিও সম্মান করেন বলে কথা সারতে হয়েছে। নাসির অনেক বড় মাপের অভিনেতা। তিনি কারও হয়ে সুপারিশ করতে পারেন বলে প্রতিক্রিয়া দিতে হয়েছে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকেও। 

আরও পড়ুন-চিনের শত্রুতা নাকি পরপর ভুল সিদ্ধান্ত, কেন দেউলিয়া শ্রীলঙ্কা

টুইটারে নাসির এবং রত্নার ভিডিও দু’টি শেয়ার করলেও, সায়রা যদি পারিবারিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেননি একটি বারের জন্যও। প্রচার নির্ভর পেশায় পদার্পণ করলে, ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে জাহির করতে দেখা যায়নি তাঁকে। বরং গেরুয়া থেকে রং বদলে তৃণমূলী হয়ে যাওয়া বাবুল আদৌ বিশ্বাসের উপযুক্ত কি না, সেই প্রশ্নই তুলে ধরেছেন বার বার। আবার ‘নোট ভোট টু বিজেপি’ মন্ত্রে কেয়াকে নিয়ে গেরুয়া শিবিরের প্রত্যাশায় জল ঢেলে দিতে চেয়েছেন। যে কারণে ঝিমুনি কাটিয়ে অক্সিজেন পেতে শুরু করেছে লাল শিবিরও। সোশ্যাল মিডিয়া পেজে দলের অ্যাকাউন্টের টাইমলাইনই তার সাক্ষী।

স্বভাবতই সায়রাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা বেড়েছে তৃণমূলেরও। কারণ বিধানসভা নির্বাচনে শহর কলকাতায় কার্যত খাতাই খুলতে পারেনি বিজেপি। সেই সময় তাদের হয়ে মাঠে নেমে গোল করতে পারেননি বাবুলও। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে অশান্তি বাঁধানো হোক বা বছর সাতেক আগে ধর্মতলার সভা থেকে শ্রুতিকটু সুরে লাগাতার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘দিদি...দিদি’ সম্বোধন করে গেরুয়া সমর্থকদের হাস্যরসের জোগান দেওয়া, তিলোত্তমার সঙ্গে বাবুলের সম্পর্ক কোনও দিনই মসৃণ ছিল না। বিধানসভা নির্বাচনে হারের পরও মমতাকে যা নয়, তাই বলে আক্রমণ করেছিলেন তিনি। এ হেন বাবুলকে প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের জেতা আসন বালিগঞ্জে প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত তাদেরই হুল ফোটাতে পারে বলেও কানাঘুষো চলছে দলের অন্দরে।

বিজেপি-র তরফেও তেমন আসার আলো দেখা যাচ্ছে না। কারণ আসানসোল লোকসভা এবং বালিগঞ্জ বিধানসভা, দুই উপনির্বাচনে মহিলা প্রার্থী নামিয়ে চমক দিলেও, নির্বাচনী রাজনীতিতে কেয়া এখনও অনভ্যস্ত। উল্টে গেরুয়া শিবিরের অস্বস্তি রয়েছে তাঁর স্বামী অনির্বাণকে নিয়েও। কারণ পেশায় চিকিৎসক অনির্বাণ অতি সম্প্রতিই মমতা সরকারের  স্বাস্থ্যসাথী কার্ড প্রকল্পের ভূয়সী প্রশংসা করেন। স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের দৌলতে বাঘের থাবা খেয়েও সুন্দরবনের এক ব্যক্তি কী ভাবে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসতে পেরেছেন, সেশ্যাল মিডিয়াতেই তা নিয়ে ফলাও করে লেখেন তিনি।

তাতেই সায়রা অনেকটা সুবিধাজনক জায়গায় রয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। তবে প্রচারপর্বে আশা জাগিয়েও ভোটের ময়দানে গোল খেয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার নজির রয়েছে লাল শিবিরের। সায়রা তার ব্যাতিক্রম হবেন কি না, তা ফলাফল প্রকাশ হলেই বোঝা যাবে। কিন্তু উপনির্বাচনে তাঁর অন্তর্ভুক্তি যে দলের কাছ ইউএসপি হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে কথা অনস্বীকার্য। কারণ সিপিএম-এর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে কটাক্ষ করে গেলেও, সায়রার বিরুদ্ধে এখনও কোনও অভিযোগই খাড়া করতে পারেনি তৃণমূল এবং বিজেপি।

More Articles