৫০ পার, নানা মাঠে সৌরভের দাদাগিরি চলছে চলবে

সিনেমার গল্পের মতো জীবনের হাফ সেঞ্চুরি করলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।

দাদা। মহারাজ। প্রিন্স অফ ক্যালকাটা। ব্যাটিং ক্রিজের নিরাপত্তা থেকে স্টেপ আউট করে বেড়িয়ে এসে বল বাউন্ডারি পার করা লোকটার অনেক নাম। লর্ডসের ব্যালকনিতে হাওয়ায় জার্সি ঘোরানো ক্যাপ্টেন থেকে দল থেকে বাদ পড়া খেলোয়াড় কখনও মানুষের চোখে হিরো আবার কখনও ভিলেন। এই চড়াই উৎরাই, হেরে গিয়েও বারবার ফিরে আসা নিয়েই তার জীবন। তাই হয়তো তার আত্মজীবনীর নাম "এ সেঞ্চুরি ইস নট এনাফ" । সিনেমার গল্পের মতো সেই জীবনের হাফ সেঞ্চুরি করলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।

১৯৭২ সালের ৮ই জুলাই চন্ডীদাস গঙ্গোপাধ্যায় এবং নিরুপা গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোটো ছেলে সৌরভের জন্ম হয়। ১৯৯০-৯১ সালের রঞ্জি ট্রফিতে ভালো খেলার দরুন ১৯৯২ সালে অস্ট্রেলিয়ায় ত্রিদেশীয় সিরিজে সৌরভের একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়। ১৯৯৬ সালে সৌরভের টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে। ২০০০ সালে ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ত্ব লাভ। ২০০১ সালের ভারত অস্ট্রেলিয়া সিরিজ। ২০০২ সালের লর্ডসের ফাইনাল। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতা। ২০০৫ সালে দল থেকে বাদ পড়া। ২০০৬ সালে আবার দলে ফিরে আসা। ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর। ২০০৮-২০১০ সাল অবধি আইপিএলে কলকাতার দলের অংশ ছিলেন। ২০১১ থেকে ২০১২ অবধি পুণের দলের অংশ ছিলেন । ২০১৫ সালে প্রথমে বাংলার ক্রিকেট সংস্থা এবং ২০১৯ সাল থেকে ভারতের ক্রিকেট সংস্থার প্রধান হিসাবে কাজ করছেন। বাবার ফুলে ফেঁপে ওঠা ব্যবসার কারণে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো ছোটো ছেলের ডাক নাম হয়েছিল মহারাজ। শচীন তেন্ডুলকরের প্রিয় দাদি থেকে সবার কাছে দাদা নামে পরিচিত হওয়া। জিওফ্র বয়কটের দেওয়া নাম প্রিন্স অফ ক্যালকাটা। বাংলা তথা ভারতের বহু মানুষ সৌরভের সম্পর্কে এই সমস্ত তথ্য জানেন।

সৌরভের যাত্রা শুধু কতগুলো তারিখ আর ম্যাচ থেকে বোঝা যায় না কারণ এই মানুষটির যাত্রাপথে রয়েছে হার না মানার গল্প । বাংলার রঞ্জি দলে নিজের দাদার পরিবর্তে সুযোগ পাওয়ার কারণে আনন্দ সংকোচে বদলে যাওয়া অথবা ১৯৯২ সালের অভিশপ্ত ত্রিদেশীয় সিরিজে ভালো খেলতে না পারার কারণে দল থেকে বাদ পড়ার সঙ্গে মিডিয়ার এক অংশের তাকে অহংকারী বলে দাগিয়ে দেওয়া। ১৯৯৬ সালে তার দ্বিতীয় সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন মানুষের ঘোরতর আপত্তি এবং ইংল্যান্ডে নিয়ে গিয়েও দলে সুযোগ না দেওয়া গল্পগুলো হয়তো আড়ালে থেকে যায়। লর্ডসের মাঠে স্যাতস্যাতে আবহাওয়ায় ইংল্যান্ডের বোলারদের সামলে এক ভারতীয় খেলোয়াড়ের টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেকেই সেঞ্চুরির গল্প সবাই মনে রাখে।

২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ার ভারত সফরের শুরুতে হরভজন সিংকে ভারতীয় দলে সুযোগের বদলে সৌরভের অধিনায়কত্ত্ব নিয়ে নির্বাচকদের প্রশ্ন থেকে প্রথম টেস্ট ম্যাচের হারের পর দর্শক থেকে মিডিয়ার ভারতীয় দলকে তুলোধোনার খবর হয়তো বেশিরভাগ মানুষ ভুলে গিয়েছে। কলকাতা টেস্টে ভারতীয় দলের অধিনায়ককে অস্ট্রেলিয়া দলের এক ফাস্ট বোলারের দ্বারা ব্যক্তিগত আক্রমণ থেকে টেস্ট ম্যাচ শেষের আগেই অস্ট্রেলিয়া দলের আনন্দ উদযাপনের প্রস্তুতির বেশীরভাগ তথ্য হয় মানুষ জানে না নাহলে ভুলে গিয়েছে । মানুষের মনে জ্বলজ্বল করছে কলকাতা টেস্টে হারের মুখ থেকে ফিরিয়ে এসে জয় ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া একটা দল।২০০২ সালে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে মাঠের মধ্যে ফ্লিনটফের জার্সি হাওয়ায় ঘোরানোর জবাব লর্ডসের ব্যালকনিতে দেখার কথা আমাদের মনে থাকবে। সেই ২০০২ সালেই চ্যাম্পিয়ন ট্রফিতে যুগ্ম বিজয়ী হওয়া থেকে আশায় বুক বেঁধে ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে যাওয়া মনে থাকলেও বেটিং কেলেঙ্কারিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া একটা দলকে যেই মানুষটা গড়ে তুললো বিশ্বকাপের ফাইনালে হারের পর তার অবদান সবাই কিছুদিনের জন্য ভুলে গিয়েছিল। সৌরভ পুল মারতে পারে না তাই সে ফাস্ট বোলারকে ভয় পায়। এই কথাটা শুনে কিছু মানুষ দাঁত চেপে হাসলেও পাকিস্তানের ফাস্ট বোলার শোয়েব আখতার বলেছিলেন সৌরভ কোনোদিন ফাস্ট বোলারদের ভয় পান নি। এই ঘটনা এবং তার পরের সাক্ষাৎকার হয়তো মানুষ মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি।

আরও পড়ুন-ফুলেফেঁপে উঠছে বিসিসিআই, ভারতীয় ক্রিকেটের কতটা উন্নতি হচ্ছে?

২০০৫ সালে সৌরভ দল থেকে বাদ পড়ার পর থেকে ২০০৬ সালে ফিরে আসা এবং ২০১১ সালে আইপিএলে কলকাতার দল থেকে সৌরভের বাদ পড়ার পরে কিছু সময়ের জন্য বাংলার পরিস্থিতি প্রায় একই রকম ছিল। যদিও প্রথম ক্ষেত্রে সৌরভ দলে ফিরছিলেন দেখে সমর্থকরা খুশী হয়েছিলেন কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কিছুদিনের বিরোধিতার পরে বেশিরভাগ সমর্থক আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন কারণ দ্বিতীয় ক্ষেত্রে দল সংখ্যার বিচারে চলছিল। সংখ্যার বিচারে সেই দল পরে বিজয়ী হয়। তাও যদি সৌরভ এক আধটা ওয়ার্ল্ড কাপ আনতে পারতেন তাহলে হয়তো তাকে নিয়ে সেই সময়ে ভাবা হতো কিন্তু শুধু শূন্য থেকে দল তৈরির কোনও আলাদা নাম্বার নেই তাই সৌরভের আলাদা গুরুত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

২০১৫ সালে প্রথমে বাংলার ক্রিকেট সংস্থা এবং ২০১৯ সাল থেকে ভারতের ক্রিকেট সংস্থার প্রধান হিসাবে কাজ করার সময়ে তিনি যেমন প্রশংসিত হয়েছেন তেমনই মানুষের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছেন। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটারদের জন্য নানারকম সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করেছেন বলে মানুষ তার জয়গান গেয়েছে। দলের জনপ্রিয় ক্রিকেটারের পাশে না দাঁড়ানোর কারণে তিনি সহজেই মানুষের অপছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন।

ছোটবেলায় ফুটবল খেলা পছন্দ করা সৌরভের গঙ্গোপাধ্যায়ের আজ একাধিক পরিচয়। ক্রিকেটার, ক্রিকেট সংস্থার প্রশাসক, রিয়েলিটি শোয়ের উপস্থাপক।হয়তো ফিনিক্সের মতো বারবার ফিরে আসার কারণে চায়ের আড্ডা থেকে রাজনীতি সব ক্ষেত্রেই বাঙালির এই আইকন হাফ সেঞ্চুরি পার করে আজও সমান জনপ্রিয়।

More Articles