সেই তো আবার কাছে এলে... মমতা-শুভেন্দু সাক্ষাৎ নেহাত সৌজন্য? বাড়ছে জল্পনা

Subhendu Adhikari-Mamata Banerjee: হঠাৎ মমতা-শুভেন্দু সাক্ষাৎ যে জল্পনা বাড়িয়ে দিল না, একথাও বলা যায় না।

দিনে ভাই, রাতে রাজনৈতিক কাঁটা! বর্তমানের এই রাজনৈতিক বঙ্গে তৃণমূল এবং বিজেপি থুড়ি মমতা এবং শুভেন্দু সম্পর্ক নিয়ে এমন জল্পনায় তীব্র হয়েছে আরও। একদা 'প্রিয় কাছের মানুষ', সবুজ দলের অন্যতম হোতা নিমেষেই হয়ে গিয়েছেন শত্রু! অপ্রিয় এবং রাজনৈতিক বিপদ!

অনেকেই বলেন, বর্তমানের বিরোধ এবং বিজেপি-অস্বস্তি বোধে মমতার কঠিন কাঁটা হয়েছেন একমাত্র শুভেন্দু অধিকারী। দিলীপ ঘোষ ছাড়িয়ে সুকান্ত মজুমদারের গেরুয়া-রাজত্বেও বারবার শুভেন্দু নিয়েই চিন্তিত হয়েছে তৃণমূল। যেখানে 'বেগম থেকে কয়লা ভাইপো', বেশ কিছুদিন আগেও নিজের লোক থাকা শুভেন্দু-বাণীর বোমায় বিপর্যস্ত হয়েছে কালীঘাটের সবুজ গৃহ! গেরুয়া-অধিকারীর চাপে নড়েছে তপসিয়ার তৃণমূল ভবন। নড়বড়ে বঙ্গ বিজেপি-কে অক্সিজেন দিয়ে মমতা, বিশেষত তাঁর ভাইপো অভিষেককে রাজনৈতিক নিধনে সচেষ্ট হয়েছেন কাঁথির বিতর্কিত সম্রাট।

কিন্তু রাজনীতি বড় বালাই। কে যে কখন কার হবেন, একথা বলা বড় দায়! প্রত্যেক মুহূর্তে বঙ্গোপসাগরের তীরের বালি যে আরব সাগরের পাড়ে উড়ে পড়বে না, এ-কথা বলতে পারেন না কেউ-ই। আজ তিনি আমার, কাল তিনি অন্যের, এ-জিনিস হতে বারে বারবার। ২০১৪ সালের পর থেকে বাংলার রাজনৈতিক মঞ্চে এই নাটকের উত্থান ঘটেছে প্রায় রোজ। পরিবর্তিত সত্তা আর রাজনীতির গিরগিটি আবহে বারবার উঠে এসেছে বহু কিছু।

'ঠগবাজি' আর 'বেইমানি'-র অভিযোগ-মোড়কে দলবদলের ঝড় উঠেছে এই রাজ্যে। বাংলা দলবদলেও পথ দেখিয়েছে ফের। কিন্তু শুভেন্দু আর মমতা! অভিষেক বনাম শুভেন্দু আবহে মমতা বনাম শুভেন্দু এপিসোডও বারবার দেখেছে এই রাজ্য। বারবার দুই নেতার বিভেদ আর ব্যক্তিগত আক্রমণের সীমা অতিক্রম করেছে পলিটিক্যাল রেললাইন।

'দিদি-ভাই' সাক্ষাৎ
তবে আজ? রাজ্য বিধানসভায় হঠাৎ শোরগোল। বহুদিনের অসৌজন্য অভিযোগ থাকলেও আকস্মিকভাবে রাজ্যের বিরোধী দলনেতাকে, অর্থাৎ মমতার (Mamata Banerjee) পুরনো দিনের প্রিয় ভাই শুভেন্দু অধিকারীকে (Suvendu Adhikari) ডেকে পাঠালেন তিনি। খেতে বললেন চা! আর কথা? মাত্র ৩-৪ মিনিটের ওই সৌজন্য সাক্ষাৎ নিয়ে শুভেন্দু বলছেন, সাক্ষাৎ হয়েছে; একাধিক দাবিও নাকি জানিয়েছেন তিনি। সঙ্গে তাঁর দলেরই দুই বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পল এবং মনোজ টিগ্গাও ছিলেন। কী জানালেন শুভেন্দু? তিনি বলছেন, ২০১৬ সালে বিরোধীদের বিধানসভায় ১৫টি কমিটির দায়িত্ব দেওয়া হলেও এখন মাত্র ৯টি কমিটির দায়িত্ব ছাড়া হয়েছে, এই মর্মে মমতার কাছে মৌখিক অভিযোগও করেছেন শুভেন্দু। বলেছেন, পাবলিক অ্যাকাউন্ট কমিটি-র চেয়ারম্যান পদ বিরোধীদের ছাড়তে। রাজ্যের প্রশাসনিক বৈঠকে বিরোধী জনপ্রতিনিধিদের না ডাকা নিয়েও অভিযোগ জানিয়েছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর, কেন্দ্রীয় প্রকল্পে টাকা বন্ধের অভিযোগের আসল কারণ শুনিয়ে এসেছেন শুভেন্দু। প্রকল্পের নামবদলের খোঁচাও দিয়ে এসেছেন। আর চা? সেটা পান করার সময় পাননি তিনি। এসব শুভেন্দু নিজেই জানিয়েছেন যদিও।

আর মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ''ডেকেছিলাম। সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছে।'' এদিকে ঠিক এই সাক্ষাতের পরেই বিধানসভায় দাঁড়িয়ে শুভেন্দু অধিকারীর সংবিধান-বক্তব্যের পরেই মমতা বলেছেন, "ভাই বলে স্নেহ করতাম। তিনিই এখন গণতন্ত্রের কথা বলছেন।" মুখ্যমন্ত্রীর আরও সংযোগ, "যখন দল তৈরি হয় আপনারা ছিলেন না, আপনার বাবা আমাদের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছিলেন।''

প্রসঙ্গত, ১৯৯৮-এর তৃণমূলে অধিকারী পরিবারের কেউ সামিল হননি। বরং ওই সময়ের লোকসভা নির্বাচনে কাঁথি আসনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে কংগ্রেস প্রার্থী হন শুভেন্দু অধিকারীর বাবা শিশির অধিকারী।

সাক্ষাৎ প্রশ্ন!
সাক্ষাৎ-সৌজন্য আর মমতার এই ভাই-মন্তব্য প্রশ্ন তুলছে ফের। স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক মহলেও শুরু হয়েছে রাজনৈতিক জল্পনা। কী এমন হলো, যেখানে দাঁড়িয়ে দিদির ভাই হিসেবে ফের ওঠে আসছেন বিজেপি নেতা শুভেন্দু। এখানেই সুযোগ ছাড়েনি বামেরা। সিপিআইএম-এর দাবি, "সেটিং চলছে। আসলে বিজেপি আর তৃণমূল এক। সেই সেটিং যে কী, আজকের এই ঘটনায় স্পষ্ট।" আবার পাল্টা যুক্তি দিচ্ছে তৃণমূল-বিজেপি। প্রত্যেকেই রাজনীতিতে সৌজন্যের কথা বলে বিধানসভার ইতিহাস মনে করিয়ে দিচ্ছেন।

তবে সবটাই এত স্পষ্ট? এতটাই কি জল্পনাহীন এই সাক্ষাৎ এবং মন্তব্য! গতকাল পর্যন্ত যে শুভেন্দুর পাঁচ মিনিটের জনসভা-বক্তব্যের চার মিনিট জুড়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ চলেছে। যেখানে লক্ষ্য হয়েছেন শুধুই অভিষেক আর মমতা। যে তৃণমূল সব ছেড়ে লক্ষ্য বানিয়েছে শুভেন্দু অধিকারীকে। মাত্র দু'বছর আগেও যিনি 'তাদের লোক' ছিলেন! সেই তিনিই বক্তব্য-তিরে আক্রান্ত হয়েছেন বারবার। শেষে কিনা সেই শুভেন্দুই!

ঘরে ফেরার ডাক?
অনেকেই এই ঘটনা পরম্পরায় তুলে আনছেন মুকুল-প্রসঙ্গ। যাঁর রায়ে একদা তৃনমূলের অনেককিছু চালিত হলেও একটা সময়ে সেই রায় পৌঁছয় গেরুয়া-শিবিরে। কিন্তু ২০২১ এর নির্বাচনের পরেই সেই মুকুল পৌঁছে যান পুরনো ঘরে। মমতা আর অভিষেকের কৌশলে মুকুল ফেরেন ঘরে। তিনি কাদের বিধায়ক, কোন দলের লোক! এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও বাংলার চাণক্য মুকুলের নিষ্ক্রিয়তা এবং সক্রিয়তায় ভর করে তৃণমূল যে ফের লাভবান হয়েছে, একথা অস্বীকার করেন না অনেকেই!

তাহলে কি ফের মুকুলের পথেই হাঁটতে চলেছেন শুভেন্দু? শুনতে এই মুহূর্তে অস্বাভাবিক বা অবিশ্বাস্য হলেও অনেকেরই দাবি, বঙ্গের রাজনীতি তো বটেই দেশের রাজনীতিতে অস্বাভাবিক নয় কিছুই! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার একাধিক রসদে যে কয়েক জনের ভূমিকা অন্যতম ছিল, তার মধ্যে শুভেন্দু অগ্রগণ্য। সেই শুভেন্দুর অভিষেক-অসন্তোষে দল বদলে, একটা সময়ের নিজনেত্রী মমতার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত তোপ দাগা, খুব একটা স্বস্তি দেয়নি তৃণমূলকে। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে যে সবুজ বাড়ির দরজায় গেরুয়ার শুভেন্দুকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও হতে পারে এই সম্ভাবনা থাকছেই! আবার ২০২১ -এর সেই শীতের ডিসেম্বরের উত্তেজনা আজও খানিকটা পোড়ানোর চেষ্টা করছে শুভেন্দু-আগুন। তা-ও আটকে দেওয়ার কৌশল শুরু হতে পারে আবার। আর সেই কৌশলের প্রথম ধাপ কি এই সৌজন্য-সাক্ষাৎ?

সৌজন্য সাক্ষাতে লক্ষ্মী!
রাজনৈতিক মহলে একাংশ বলছেন; অমিত শাহের হাতধরে বঙ্গের মাটিতে শুভেন্দু অধিকারীর দলবদল নাড়িয়ে দিয়েছিল তৃণমূলকে। মোদী আবহে একাধিক জল্পনার মধ্যেই জার্সিবদল করেন শুভেন্দু। অভিষেক নিয়ে কুণাল ঘোষ থেকে সৌগত রায়। একাধিক নেতার মধ্যস্থতা তেমনভাবে কাজেই দেয়নি সে-দিন। আর সেই থেকেই একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। 'ভাইপো-ভাইপো' আর 'মমতার কোম্পানি' চিৎকারে চাপে ফেলেছেন শুভেন্দু। এমনকি নন্দীগ্রামে 'প্রিয় দিদি'র বিপক্ষে প্রার্থী হয়েছেন 'ভাই' শুভেন্দু। দিদির পা ভেঙেছে, খানিকটা দায় নিয়েই বাংলাজুড়তে খেলতে হয়েছে ভাইকে। জিতেছেন দিদি। তবে ভাইয়ের আসন, নন্দীগ্রাম ফিরিয়ে দিয়েছে বোনকে।

আর সেই নন্দীগ্রাম-হারের কাঁটা আরও বিদ্ধ করেছে মমতাকে। চাপে ফেলেছে তৃণমূলকে। যা বেড়েছে উত্তরোত্তর। হিন্দু-মুসলমান, জাতপাত আর একাধিক অভিযোগে বিদ্ধ হওয়া গেরুয়া-পন্থীদের ছাড়িয়ে পুরনো বন্ধু শুভেন্দুতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে সব। শুভেন্দু অধিকারীর একের পর এক বাক্যবাণে ছাড় পাননি অভিষেকের (Abhishek Banerjee) স্ত্রী রুজিরা (Rujira Narula) থেকে শুরু করে অভিষেকও। সেখানে দাঁড়িয়ে বঙ্গ বিজেপি-র বিধ্বস্ত অবস্থার মধ্যেও শুভেন্দু-বিপদ রক্ষা করতে মাঠে নেমেছে তৃণমূল। অভিষেকের পাল্টা অলআউট আক্রমণের মধ্যেই তুলনায় মমতা থেকেছেন নিরব। অন্তত শুভেন্দু অধিকারীর বিষয়ে বিরাট গুরুত্ব দিতে চাননি মমতা।

এই কম গুরুত্ব দেওয়াও খুব একটা সুখকর হয়নি তৃণমূলের পক্ষে। একের পর এক ইস্যুতে প্রাক্তন বনাম বর্তমানের লড়াই প্রকট হয়েছে বারবার। শুভেন্দু, প্রকল্পের নামে সরব হয়েছেন বারবার।

রাজনৈতিক মহলের একাংশের আরও দাবি, গোষ্ঠী কোন্দলের প্রভাব। নেতাদের মধ্যে হট্টগোলের চাপে থাকে বঙ্গের বিজেপি-কে স্বস্তি দিয়ে মমতা এবং তাঁর ভাইপো অভিষেককে 'টার্গেট' করেছেন শুভেন্দু। কেন্দ্রীয় প্রকল্প, একাধিক পরিসংখ্যান তুলে ধরে সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন এই নেতা। যা বেশ চাপে ফেলেছে তৃণমূলকে।

দাবি, একাধিক জনসভা এবং জায়গায় জায়গায় 'বিনাযুদ্ধে নাহি দিব' মনোভাবে শুভেন্দু কঠিন করেছেন আক্রমণের মাত্রা। তৃণমূল ছেড়ে মমতা অভিষেক বিদ্ধ হয়েছেন বারবার। যাকে ইন্ধন জুগিয়েছে শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতি। টাকা উদ্ধার। পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অনাবৃত দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে অনুব্রত মণ্ডলের গ্রেফতারি। বারবার ফাঁপরে পড়েছে তৃণমূল। এখানেই সুযোগ পেয়েছেন তৃণমুলের একদা 'বঞ্চিত' শুভেন্দু। নিজের গায়ের একাধিক কলোর অভিযোগ সামলেই তৃণমূলকে নাস্তানাবুদ করেছেন শুভেন্দু।

বলা হচ্ছে, এই বিপদ আরও বেড়েছে সম্প্রতি। কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা। কেন্দ্রীয় প্রকল্পের বকেয়া। রাজকোষের ঘাটতির মধ্যেই মমতার অভিযোগে জল ঢালতে একটার পর একটা চিঠি কেন্দ্রকে পাঠিয়েছেন শুভেন্দু। মমতার রাজ্যের নানা দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে, সরব হয়েছেন শুভেন্দু। যেখানে উঠে এসেছে রাজ্যের ঋণ-বিপদও! প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্যের ঘাটতির অর্থনীতিতে দাঁড়িয়েও মেলা-উৎসব আর ক্লাবকে অনুদান, লক্ষ্মীর ভান্ডার নিয়েও। প্রশ্ন তুলেছেন এই বিজেপি নেতা।

আর এখানেই একের পর রাজনৈতিক সমস্যা বেড়েছে তৃনমূলের। জড়িয়েছে অভিষেকের নাম। শুভেন্দুর অভিযোগে ছাড় পাননি তাঁর 'দিদি' মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। ঠিক এই অবস্থায় দাঁড়িয়েই শুভেন্দুকে কব্জায় নেওয়ার চেষ্টা হতে পরে মমতার তরফে? এমন প্রশ্নও করছেন কেউ কেউ। অন্যদিকে বারবার সিবিআই চাপ, কেন্দ্রীয় সংস্থা আর দুর্নীতির প্রকোপ-বিধ্বস্ত হলেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর (Narendra Modi) সঙ্গে দেখা করেন মমতা। এই অভিযোগেও সরব হন সিপিআইএম নেতারা। অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী সৌজন্যের অভ্যন্তরেই উঠে আসে এই অভিযোগ বা দাবিও। অন্যদিকে মমতার বক্তব্যের মধ্যে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে, বিজেপি-র বিপক্ষে বলায় নরম-গরমের তারতম্যেও চাপ এবং ছাড়ের প্রভাব থাকে বলে দাবি করেন কেউ কেউ। সেই দাবিতেই উঠে আসে ওই সেটিং তত্ত্বও।

কী ঠিক, কী ভুল, এই প্রশ্নের দাবানলের মধ্যেও রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, শুভেন্দু রাজ্যের বিরোধী দলনেতা এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। সাংবিধানিক দায়িত্বের মধ্যে এই সাক্ষাৎ খুব একটা বিরল হওয়া উচিত নয়। তবে এই রাজ্যের যা রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাতে হঠাৎ এই সাক্ষাৎ যে জল্পনা বাড়িয়ে দিল না, একথাও বলা যায় না।

More Articles