বিতর্কিত বাইশ গজ! শেষের পরেও যে কারণে আলোচিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ

T20 World Cup: কখনও শাকিবের বিতর্কিত এলবিডব্লু, আবার কখনও কোহলির ‘ভুয়া’ ফিল্ডিং, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ যেন বিতর্কেরও বিশ্বকাপ।

এ-বছর অস্ট্রেলিয়ায় আয়োজিত হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০২২ নিঃসন্দেহে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসের নিকৃষ্টতম সংস্করণ। একেই বর্ষাকালে অস্ট্রেলিয়ার টুর্নামেন্ট হওয়ায় বহু ম্যাচ ওয়াশআউট হয়েছে। উপরন্তু একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আম্পায়াররা। এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আম্পায়ারিংয়ের মান নিয়ে চর্চা হচ্ছে সর্বত্র। একাধিক বিতর্কিত সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন আম্পায়াররা। এই বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলির ফলে ম্যাচের ফলাফল নিঃসন্দেহে প্রভাবিত হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আম্পায়ারদের সিদ্ধান্তগুলি এতটাই ছেলেমানুষের মতো, যা আন্তর্জাতিক স্তরে মানা যায় না। যেহেতু সিদ্ধান্তগুলি টুর্নামেন্টের ফলাফলের ওপর প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব ফেলেছে, তাই দর্শকদের মতে আইসিসি-র উচিত এইসব আম্পায়ারের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করার। আম্পায়ার যদি কোনও খেলোয়াড়কে ভুলবশত আউট দেন বা কোনও খেলোয়াড়কে অতিরিক্ত রান বা অন্যান্য সুবিধে দেন, তখন বিতর্কের ঝড় ওঠে সব জায়গায়। একইভাবে কোনও আম্পায়ার যদি কোনও বৈধ ডেলিভারিকে ওয়াইড বা নো বল বলে দেন, তাহলে তা বিতর্কের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। এবারের বিশ্বকাপে এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা দেখা গিয়েছে। কখনও শাকিবের বিতর্কিত এলবিডব্লু, আবার কখনও কোহলির ‘ভুয়া’ ফিল্ডিং, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ যেন বিতর্কেরও বিশ্বকাপ। আসুন সেগুলি নিয়ে আলোচনা করা যাক।

ভারত বনাম পাকিস্তান (২৩ অক্টোবর)
একটি নয়, দু'টি নয়, তিন-তিনটি সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়েছে সব মহলে। এই ম্যাচের সেকেন্ড ইনিংসে কার্যত মহাকাব্য রচনা করে ফেলেছিলেন বিরাট কোহলি। যেভাবে হারতে থাকা ম্যাচ তিনি ভারতকে জেতালেন, তা অতুলনীয়। তবে এই ইনিংসের শেষের তিনটি বলে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যায়, যা বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। সেই মুহূর্তে গৃহীত সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক ছিল, তা দেখে নেওয়া যাক। জিততে হলে তখন ভারতের দরকার ছিল ১৩ রান। হাতে মাত্র ৩ বল। বল করছেন পাকিস্তানের মহম্মদ নওয়াজ। ব্যাট হাতে কোহলি। পরিস্থিতির হিসেবে ওভারের প্রথম ৩টি বল ভালই করেছেন নওয়াজ। কী হয়, কী হয় আবহে কোহলিকে লক্ষ করে একটি উঁচু ফুলটস করেন নওয়াজ।

কোহলি সোজা তা উড়িয়ে দেন স্কোয়ার লেগের ওপর দিয়ে। বলের উচ্চতা ছিল কোমরের ওপরে, এই দাবি করে আম্পায়ারের দিকে কিছু ইঙ্গিত করেন কোহলি। বিরাট কোহলির দাবি মেনে বলটিকে নো বল বলে ঘোষণা করেন আম্পায়ার। যদিও লেগ আম্পায়ার মারে ইরাসমাস নো বল দেননি। এই সিদ্ধান্তে হতচকিত হয়ে যান বাবর আজমরা। ক্রিকেট আইনের বইয়ের ৪১ ধারার ৭-এর ১ উপধারা অনুযায়ী, যে কোনও বল যদি পিচে না পড়ে সোজা ব্যাটারের কাছে গিয়ে পৌঁছয় এবং ব্যাটার যদি পপিং ক্রিজের মধ্যে থাকেন, তা হলে তা অন্যায়। এতে ব্যাটার শারীরিকভাবে আহত হতে পারেন। তাই এরকম বলকে আম্পায়ার সঙ্গে সঙ্গে নো বল ডাকবেন। মজার বিষয় হচ্ছে, কোহলি ক্রিজের বাইরেও ছিলেন না, ভেতরেও ছিলেন না। তিনি ছিলেন লাইনের ওপর। ‘অন দ্য লাইন’ থাকলে কী হবে, তা বলা নেই। অতএব, যথার্থভাবেই ফ্রি হিট পেল ভারত।

এই ফ্রি হিটে তৈরি হলো আরও একটি বিতর্ক। ফ্রি হিটের প্রথম বলটি ওয়াইড করে বসেন নওয়াজ। ফলত বলটি আরেকবার করতে হয় তাকে। দ্বিতীয়বার সেই বলটি খেলতে গিয়ে বোল্ড হয়ে যান কোহলি। বল উইকেটে লেগে চলে যায় থার্ড ম্যান চত্বরে। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে তিন রান নিয়ে নেন বিরাট কোহলি। তৎক্ষণাৎ এর বিরোধিতা শুরু করে পাকিস্তান দল। তাদের দাবি, বল উইকেটে লাগার পর ডেড হয়ে গেলে ব্যাটার কিভাবে দৌড়ে রান নিতে পারে। আবার নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করেন আম্পায়াররা। দৌড়ে নেওয়া ৩ রানকে বাই হিসেবে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। নিয়ম বলছে, ব্যাটার বল খেলার আগে, হাওয়ার কারণে বা অন্য কোনও ফিল্ডারের হাত লেগে উইকেট থেকে বেল পড়ে গেলে বল ডেড ঘোষিত হবে। সুতরাং, বল খেলার পরে যেহেতু বেল পড়েছে তাই ফ্রি হিটে স্টাম্পে বল লাগার পরেও দৌড়ে রান নেওয়া সম্পূর্ণ আইনি।

তবে এই ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে আরও একটি বিতর্ক হয়েছিল। অক্ষর প‍্যাটেলের রান আউট নিয়ে। শাদাব খানের বলে এক রান নিতে চান অক্ষর। কিন্তু উল্টোদিকে থাকা কোহলি তাঁকে ফেরত পাঠান। তবে মিড উইকেট থেকে ততক্ষনে বল চলে এসেছে পাকিস্তানি উইকেটরক্ষক মহম্মদ রিজওয়ান-এর হাতে। কিন্তু উইকেট ভাঙা সত্ত্বেও তার মুখে দেখা যাচ্ছিল বিরক্তির ছাপ! রান আউট করার পরেও কোনও উচ্ছ্বাস নেই। এরপর রিপ্লে-তে খোলসা হলো ব্যাপারটা। দেখা গেল, রিজওয়ান ঠিকমতো বলটি ধরতে পারেননি। তার বদলে বল এসে তাঁর গ্লাভসে লাগে এবং সেখান থেকে ছিটকে গিয়ে স্ট্যাম্প ভেঙে দেয়। একই সঙ্গে রিজওয়ানের হাতও উইকেট ভেঙে দেয়। এবার বল যদি রিজওয়ানের গ্লাভসে লেগে উইকেট ভাঙত বা গ্লাভসে থাকা অবস্থায় রিজওয়ান উইকেট ভাঙতেন, তাহলে কোনও বিতর্ক হতো না। কিন্তু এক্ষেত্রে আগে গ্লাভস লেগে উইকেট ভেঙেছে তারপরে বল এসে লেগেছে। সেক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী রান আউটটি বৈধ নয়।

ভারত বনাম বাংলাদেশ (২ নভেম্বর)
বাংলাদেশ ইনিংসের সপ্তম ওভারে অভিযোগের তির কোহলির দিকে। অক্ষরের বলে রান নিতে যান লিটন। কোহলি দাঁড়িয়েছিলেন পয়েন্টে। অর্শদীপ বল ছুড়ে ফেরত পাঠানোর সময় কোহলিও বল কুড়িয়ে ছুড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করেন। এই ধরনের ঘটনাকে বলা হয় ফেক ফিল্ডিং। ৩০ গজ বৃত্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে এহেন কিছু করলে, বা ব্যাটারকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করলে আম্পায়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটিং টিমকে পাঁচ রান দিয়ে দেন। তবে কোহলির এই ফেক ফিল্ডিং আম্পায়ার মারে ইরাসমাস এবং ক্রিস ব্রাউনের নজর এড়িয়ে যায়। তৃতীয় আম্পায়ার বা বাংলাদেশ টিমের পক্ষ থেকেও কোন প্রতিবাদ জানানো হয়নি তখন। বিতর্ক শুরু হয় বাংলাদেশ ম্যাচ হারার পর। ব্যাটসম্যান নুরুল হাসান শান্ত পাঁচ রানের দাবি জানিয়ে বসেন বিরাট কোহলির ফেক ফিল্ডিংয়ের জন্য।

অস্ট্রেলিয়া বনাম আফগানিস্তান (৪ নভেম্বর)
এই ম্যাচে আম্পায়ারদের একটি বড়সড় গাফিলতি চোখে পড়েছে সকলের। অস্ট্রেলিয়া ব্যাটিং করার সময় পাঁচ বলেই একটি ওভার ডেকেছেন আম্পায়ার। ম্যাচটি টানটান উত্তেজনার মধ্যে শেষ হয়েছে। রশিদ খান ম্যাচকি আরেকটু হলে আফগানিস্তানের দিকে টেনেই দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৫ রানে ম্যাচ প্রকটস্থ করে অস্ট্রেলিয়া। ওই বলটি খেলা হলে ম্যাচের ফলাফল না পাল্টালেও অস্ট্রেলিয়া আরও বেশি রানে ম্যাচ জিততে পারত। ফলত অস্ট্রেলিয়ার নেট রান রেট বাড়তে পারত। যে বলটি আম্পায়ার দেননি, সেখানে ৪ বা ৬ রান হতে পারতো, আবার কেউ আউটও হতে পারতেন। আউট হলে অবশ্য খেলা কোন দিকে মোড় নিত তা বলা যায় না। এই ঘটনাটি ঘটে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের চতুর্থ ওভারে। তখন ব্যাট করছিলেন মিচেল মার্শ এবং ডেভিড ওয়ার্নার। বল হাতে ছিলেন আফগানিস্তানের নবীন উল হক। দু’জন ব্যাটারই প্রথম দু’টি বলে একটি করে সিঙ্গলস নেন। এর পর ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট দিয়ে বাউন্ডারি মারেন মার্শ। পরের বলে তিন রান নেন তিনি। পঞ্চম বলে কোনও রান নেননি। এরপরই আম্পায়ার ওভার ডেকে দেন। আম্পায়ারের দোষে তা হয়নি। যদিও অস্ট্রেলিয়ার দুই ক্রিকেটার এর কোনও প্রতিবাদ করেননি।

 

বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তান (৬ নভেম্বর)
এই ম্যাচটিকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল বলা উচিত। এই ম্যাচের পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়ে যায় যে জিতবে সেইই পৌঁছে যাবে সেমিফাইনালে। এহেন মরণ-বাঁচন ম্যাচে দেখা যায় এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত। ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করতে নামে বাংলাদেশ। সৌম্য সরকার আউট হওয়ার পর ব্যাট করতে নামেন শাকিব। সাদাব খানের স্লো ফুলটস শাকিবের ব্যাটে লাগার পর পায়ে লেগে অন্য দিকে যায়। সঙ্গে সঙ্গে এলবিডব্লিউর আপিল করেন সাদাব খান। আম্পায়ারও আউট দিয়ে দেন। শাকিব সঙ্গে সঙ্গে ডিআরএস নেন। এই ডিআরএস ঘিরে শুরু হয় বিতর্ক।

স্নিকোমিটারে স্পষ্ট দেখা যায় ব্যাট বলের সঙ্গে লাগায় গ্রাফটি উঁচু-নিচু স্পাইক করছে। তার মতে আসলে স্নিকোমিটারে যা ধরা পরেছে তা ব্যাটের মাটিতে আঘাতের শব্দ। বল সরাসরি শাকিবের পায়ে লেগেছে। তৃতীয় আম্পায়ার বলে দেন, ব্যাটের সঙ্গে বলের কোনও যোগাযোগ হয়নি। আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত আসার পর প্রথমে শাকিব বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। মাঠেই তিনি তর্ক জুড়ে দেন আম্পায়ারের সঙ্গে। কিন্তু শেষমেশ আর কিছুই করার না থাকায় মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন তিনি। শাকিবের শরীরী ভঙ্গিমা বলে দিয়েছিল কতটা বিরক্ত তিনি। বলাই বাহুল্য, শাকিব মাঠে থাকলে খেলার ফলাফল আলাদা হতেই পারত।

More Articles