একটি জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের মর্মকথা

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় 'জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র' বলতে বোঝায় এমন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা, যার প্রধান উদ্দেশ্য হল রাষ্ট্রের নাগরিকদের জীবনের সর্বাঙ্গীন কল্যাণ সাধন করা। অর্থাৎ প্রত্যেক নাগরিকদের জীবন যাতে সামগ্রিকভাবে বিকশিত হয় তা সুনিশ্চিত করা। 'ভারত' সেই রকমই একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্র | আমাদের দেশের তথা রাষ্ট্রের সংবিধানের মুখবন্ধেও তেমন কথাই বলা হয়েছে|

সেইরকম জনকল্যাণকামী প্রচেষ্টার একটি উজ্জ্বল সুসংহত এবং কার্যকরী দৃষ্টান্ত হল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে গঠিত "স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প"।এর মাধ্যমে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে দু'কোটিরও বেশি পরিবারকে আনা হয়েছে 'স্বাস্থ্যসাথী' প্রকল্পের আওতায়||

যে কোনও জনকল্যাণকামী প্রকল্প সফল হতে পারে যদি সেই প্রকল্পকে রূপদানের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ একদিকে এবং অন্যদিকে সেই প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের (Target Beneficiary ) সততার পরিচয় দেন।মানুষ সততার পরিচয় দেবে......এইরকম আশা বুকে নিয়েই দেশের কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার যে কোনও জনকল্যাণকামী প্রকল্পের রূপরেখা গঠন করেন।

কিন্তু বিগত ১৫ই জুলাই,২০২১, প্রকাশিত একটি সংবাদ সেই সযত্ন-লালিত আশাকে চুরমার করে দিয়েছে, ভরসার ভিত্তিভূমিতে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে।জানা গিয়েছে, বাঁকুড়া জেলার সোনামুখী অঞ্চলের দুটি নার্সিংহোম এবং ওন্দা রামসাগর এলাকার একটি নার্সিংহোম সম্পূর্ণ জুয়াচুরি করে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গোয়ালতোড় গ্রামের অনেক সুস্থ মানুষকে প্রলোভনের কিছু টাকা ধরিয়ে রোগী সাজিয়ে তাদের নার্সিংহোমে ভর্তি করিয়েছে। সামান্য গায়ে ব্যথা বা জ্বরে ৮-১০দিন করে তাদের নার্সিংহোমে রেখে রোগীপিছু ৭০-৭৫ হাজার টাকার বিল করেছে।এইরকম Non-Specific শারীরিক সমস্যা নিয়ে ভর্তি রোগীদের সামনে রেখে নার্সিংহোম গুলি সরকারের কাছ থেকে সেইসব বিলের টাকা আদায় করেছে।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য-দফতরের তরফে গঠিত একটি তদন্ত কমিটির সদস্যদের সামনে এই সব হতাশাজনক তথ্য উঠে এসেছে। এ কি শুধু হিমশৈলের চূড়া? ব্যাপকভাবে তদন্ত হলে কি গোটা হিমবাহের সন্ধান পাওয়া যাবে?

আরও প্রশ্ন জেগেছে, তাহলে কে-ই বা কল্যাণ করবেন? কাদের জন্যই বা কল্যাণ কামনা? তাহলে রাষ্ট্রব্যবস্থা বলতে কি শুধুমাত্র সরকারী কর্মী-অফিসার, আদালতের বিচারপতি, সৈন্যবাহিনী, পুলিশবাহিনী,মন্ত্রীবর্গ এদেরই বোঝায়? এঁরাই কেবলমাত্র রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার জন্য দায়ী? সাধারণ মানুষ কি রাষ্ট্রব্যবস্থার অংশ নন? রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উন্নত করে গড়ে তোলার জন্য  প্রতিটি নাগরিকের কি কোনও দায়িত্ব নেই?

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকার জনসাধারণের। তা, জনসাধারণের দ্বারা এবং জনসাধারণের জন্য গঠিত। তাই আমাদের দেশের প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব আছে সেই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পোষণ করবার | সেই পুষ্টিবিধানের অপরিহার্য ভিত্তি হল, প্রতিটি নাগরিকের নৈতিকতাপূর্ণ এবং সততাপূর্ণ জীবনচর্চা।  এরকম চলতে থাকলে সরকারের পক্ষে জনকল্যাণকামী প্রকল্প গ্রহণ এবং রূপদান করা আর সম্ভব হবে না। তাতে কার লাভ হবে?

বলাই বাহুল্য সততাই একমাত্র বল, সততাই মূলধন। আর কেবলমাত্র ঈশ্বরে অনুরাগ ধর্মশিক্ষা ও ধর্মভাবই মানুষের মধ্যে সততার ফুল ফোটাতে পারে। যুগাবতার শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের শিক্ষা....'যে আছে, সে ঈশ্বরের কোলে শুয়ে আছে' আমাদের দেশের আবহমান কালের শিক্ষা...... 'তুমি সত্যকে রক্ষা করলে, সত্যও তোমাকে রক্ষা করবেন"|

কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বাহ্যিক আড়ম্বর এবং ধর্মীয় উন্মাদনার এত বাড়বাড়ন্ত হয়েছে, যে তার দমকা হাওয়ায় নাগরিক জীবনে সত্যানুরাগের শান্ত দীপশিখাটির প্রায় নিভন্ত অবস্থা।

অনেক বছর আগে একটি বাংলা আধুনিক গানের গীতিকার তাঁর মনের বেদনা ব্যক্ত করেছিলেন এই বলে...."এ কোন্ সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার?
এ কি সূর্য নাকি স্বপনের চিতা?
এ কি পাখির কূজন না কি হাহাকার?"
গানটির বাণীর এত বিষাদঘন রূপ অনেক শ্রোতাকেই ব্যথিত ও বিস্মিত করেছিল।

এ হাহাকার ছড়িয়ে পড়ুক, তা কাম্য নয়| কিন্তু, এই হাহাকার যে তীব্রতম রূপ ধরে আমাদের এই সিস্টেমের ভিতরটির সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে তাকে কুরেকুরে খেয়ে নিচ্ছে, তা বাস্তব এবং সেটাই দুঃখের।

 

তথ্য সূত্র : লেখক-এর নিজস্ব সংগ্রহ 

More Articles