সিবিআই ছুঁলেই উডবার্ন ওয়ার্ড, শাসকদলের নেতাদের স্থায়ী ঠিকানা?

মঙ্গলবার বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় স্কুলে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ মামলায় প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী ( বর্তমান শিল্পমন্ত্রী) পার্থ চট্টোপাধ্যায় কে সিবিআই হাজিরার নির্দেশ দেন। এই প্রসঙ্গে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন হাজিরা এড়াতে মন্ত্রী যেন উডবার্নে ভর্তি না হন। কিন্তু কেন হঠাৎ  উডবার্নের প্রসঙ্গ শোনা গেল বিচারপতির গলায়? 

২০১১ এ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শাসকদলের অন্য ডেরায় পরিণত হয়েছে এস এস কে এমের উডবার্ন ওয়ার্ডের ১২.৫ নম্বর কেবিন। প্রথা অনুযায়ী, কলকাতা শহরে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে যদি তাঁদের কোনো মেডিক্যাল ইমারজেন্সি হয় তখন তাঁদের জন্য বরাদ্দ থাকে এস এস কে এম সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডের ১২.৫ নম্বর কেবিন। কিন্তু তৃণমূল জমানার ইতিহাস বলছে অন্য কথা। ১২.৫ এ বাস্তবে রয়েছে বর্তমান শাসক দলের নেতা মন্ত্রীদেরই দখলে।

২০১৪ এর ডিসেম্বরে সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তলব করে তৎকালীন তৃণমূল সরকারের ক্রীড়া ও পরিবহন মন্ত্রী এবং কামারহাটির বিধায়ক মদন মিত্রকে। সাতদিন সিবিআই ম্যারাথন জেরা পর্ব শেষ করে গ্রেপ্তার করে মদন মিত্রকে। আদালতের নির্দেশে ১৪ দিনের জেল হেফাজত হয় পরিবহণ মন্ত্রীর। জেলে পৌঁছানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই বুকে ব্যথা নিয়ে মদন মিত্র ভর্তি হন পিজি হাসপাতালে। আশ্রয় স্থল সেই উডবার্ন ওয়ার্ডের ১২.৫ নম্বর কেবিন। সেই বারে প্রায় মাসখানেক মন্ত্রী ছিলেন ১২.৫ এর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুপার ডিলাক্স কেবিনে। মদনের চিকিৎসার জন্য সেইবার গঠন করা হয়েছিল স্পেশাল মেডিক্যাল বোর্ড। তারপর এস এস কে এমের নিরাপদ আরামের আবাস থেকে মদনকে জেল হেফাজতে পাঠাতে কম ভোগান্তি হয়নি সিবিআই-এর।

তৃতীয় জয়ের এক বছরেই নড়বড়ে তৃণমূল? দল কি ভাঙছে আড়াআড়ি?

আবার ঠিক তার এক মাসের মধ্যেই আলিপুর জেল থেকে রুটিন চেক আপ করাতে পিজি হাসপাতালে যান মদন। সেই সময় নবান্ন থেকে সরাসরি নির্দেশ যায় পিজির উডবার্ন ওয়ার্ডে। অসুস্থ জেলবন্দী মন্ত্রীকে যেন ভর্তি নিয়ে নেয় পিজি। কিন্তু সিবিআইয়ের চোখে অসুস্থ দেখানোর মতো যথেষ্ট যুক্তি দেখাতে পারেননি স্বয়ং এসএসকেএমের ডাক্তাররাই। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তারা সরাসরি জানিয়ে দেন এক্ষেত্রে নবান্নের আদেশ পালন অসম্ভব। ডাক্তারি শাস্ত্রের কোনও কারিকুরি দিয়েই মদন মিত্র কে এবার রেখে দেওয়া যাবে না হাসপাতালে। অগত্যা উডবার্নের ১২.৫ নম্বর কেবিনে ঠাঁই না পেয়ে বিফল মনোরথ হয়েই জেলে ফিরে যেতে হয় মদনকে। উডবার্ন ওয়ার্ড কীভাবে শাসক দলের নেতা মন্ত্রীর আইনি আড়াল হয়ে উঠেছে , নবান্নের নির্দেশে সেদিনই তা বেআব্রু হয়ে গেছিল।

তবে এখানেই শেষ নয়, এই ইতিহাসের এখনও বেশ খানিকটা বাকি আছে। আবার ২০২১ এর ১৮ ই মে আবার সেই একই ঘটনা। তখন সদ্য তৃতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় এসেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। এর মধ্যেই সিবিআই গ্রেপ্তার করে শাসক দলের তিন নেতা ও মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং মদন মিত্রকে। এছাড়াও নারদা মামলায় জড়িয়ে থাকায় প্রাক্তন তৃণমূল নেতা ও কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেপ্তার করে নিজাম প্যালেসে নিয়ে যায় সিবিআই। ঘটনার পরপরই সেখানে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেখানে পৌঁছে ধর্নায় বসেন। যদিও সিবিআই গ্রেপ্তারের খানিকক্ষণের মধ্যেই রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ শ্বাসকষ্ট নিয়ে পিজির উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হন মদন মিত্র। তারপরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন শোভন চট্টোপাধ্যায়। দুজনকেই উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। কাকতালীয় হলেও, ঠিক পরের দিনই শারীরিক সমস্যা নিয়ে পিজিতে ভর্তি হন শাসক দলের আরেক মন্ত্রী তৃণমূলের বর্ষীয়ান নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায়। আদালত থেকে জামিন মঞ্জুর না হওয়া অবধি তিন নেতার নিরাপদ আশ্রয় ছিল পিজির উডবার্ন ওয়ার্ড।

ব্যতিক্রম হয়নি বীরভূমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের ক্ষেত্রেও। ভোট পরবর্তী হিংসা মামলায় সিবিআই ডেকে পাঠায় অনুব্রতকে। সিবিআইয়ের ডাক আসার পরই প্রবল শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে পিজির উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হন কেষ্ট। সেখান থেকেই হাইকোর্টের দ্বারস্থ্ হন তিনি। একবার নয় বারবারই সিবিআই এর ডাক এড়াতে অনুব্রত ভর্তি হয়েছেন উডবার্ন ওয়ার্ডে। আবার দিন সাতেক আগেও সিবিআইয়ের ডাকে সাড়া দিয়েই নিজাম প্যালেসে যাচ্ছিলেন অনুব্রত মণ্ডল। কিন্তু সেখানেও কাহানি মে টুইস্ট। হঠাৎই নিজাম প্যালেসের রাস্তায় ঢুকে কেষ্টর গাড়ি এগিয়ে যায় পিজি হাসপাতালের দিকে। এইবার ও রক্ষাকবচ সেই উডবার্ন ওয়ার্ডের ১২.৫ নম্বর ওয়ার্ড। সেই তালিকায় নবতম সংযোজন হতে গিয়ে ও পারলেন না আরেক শাসক দলের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়।

শাসক দলের নেতদের উডবার্ন প্রীতি নিয়ে দলের অন্দরেও যে যথেষ্ট চাপানউতোর রয়েছে তার প্রমাণ কুণাল ঘোষের কথা। সম্প্রতি তৃণমূল মুখপাত্র কুনাল ঘোষ ঠাট্টা করে বলেছেন, ‘এখন এস এস কে এমের উডবার্ন ওয়ার্ড অসুস্থদের চিকিতসাস্থল নয়, ওটা কয়েদিদের আশ্রয়স্থল’।

More Articles